রুমার ১৬টি গ্রামের জুম্মদের বগালেক ক্যাম্পে বেগার শ্রম দেয়া বাধ্যতামূলক

0
1182

হিল ভয়েস, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০, বান্দরবান, বিশেষ প্রতিবেদক: বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় বগালেক আর্মী ক্যাম্পের আওতাধীন ১৬টি গ্রামের জুম্ম পাড়াবাসীরা প্রত্যেক বছর দুইবার করে বগালেক ক্যাম্পে বিনামজুরীতে কাজ করে দিতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

পাড়ার কার্বারীরা (গ্রাম প্রধান) অভিযোগ করেন, ক্যাম্প থেকে চিঠি আসলে পাড়াবাসীদেরকে ক্যাম্পে কাজে পাঠাতে হয়। না পাঠালে ক্যাম্প কমান্ডার পাড়ায় এসে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করে থাকেন। আর ক্যাম্পে কাজ করার বিনিময়ে মজুরী দাবি করলে তারা বলেন যে, এটা সরকারি কাজ। তাই মজুরী ছাড়া কাজ করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাড়ার একজন কার্বারী বগালেক ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রশ্ন করেন, “স্যার, আপনি বলেন এটা সরকারি কাজ। তাই পাড়াবাসীরা যদি আপনার ক্যাম্পে কাজ করে দিলে মজুরী পাওয়া যায় না। তাহলে আপনারাও তো সরকারি চাকরি বা সরকারি কাজ করেন, তাহলে আপনারা সরকার থেকে মাসে মাসে বেতন নেন কেন স্যার?

কার্বারীর প্রশ্নের উত্তরে ক্যাম্প কমান্ডার বলেন, আমরা সেনাবাহিনীর লোক। আমাদের বেতন নিতে হবে। তোমরাতো পাবলিক, তোমাদের আবার কিসের বেতন। তাই ক্যাম্পে মজুরী ছাড়া কাজ করে দিতে হবে।

এভাবে রুমা জোনের অধীন বগালেক ক্যাম্প, চুংচংপাড়া ক্যাম্প, পুকুরপাড়া ক্যাম্প, বাকলাই ক্যাম্প, মুননোয়াম ক্যাম্প এবং রনিনপাড়া ক্যাম্পের আওয়াতাধীনে থাকা পাড়াবাসীদের প্রত্যেক বছরে দুইবার করে বিনামজুরীতে ক্যাম্পে কাজ করে দিতে হয়। তাছাড়া প্রতি পরিবার থেকে বিনামূল্যে দশটি করে বাঁশও ক্যাম্পে দিতে হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

গত ১১ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ১৫ দিন যাবত বগালেক ক্যাম্প থেকে সুবেদার রফিকের নেতৃত্বে একদল সেনা কিস্তপাড়ায় একটি অস্থায়ী ক্যাম্প করে অবস্থান করেছিল। ১৫ দিন ধরে অবস্থান করার সময় প্রতিদিন তিনজন করে পাড়াবাসীকে ১,৫০০ ফুট নীচের ঝিরি থেকে সেনাবাহিনীর জন্য পানি তুলে দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। বিনিময়েপাড়া বাসীদেরকে কোন মজুরী দেয়া হয়নি।

অস্থায়ীক্যাম্পে অবস্থান করার সময়ে সেনা সদস্যরা দুইটি ছাগল কিনে নিয়েছিল।কিন্তু সেনাবাহিনী ছাগল দুটির ন্যায্য দাম দেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন প্রংকুমক খুমীপাড়া থেকে ১,৮০০ টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনে নেয়। অথচ মালিক উক্ত ছাগলটি বাজার থেকে কিনে আনেন ৩,০০০ টাকা দিয়ে। অন্যদিকে কিস্তপাড়ার নিবাসী বাদুরাম ত্রিপুরা বাজার থেকে ৮,০০০ টাকা দিয়ে একটি ছাগলটি কিনে আনেন। সে ছাগলটি সেনাবাহিনী কিনে নেয় ৪,৭০০ টাকায়। বাকী ৩,০০০ টাকা ঐপাড়ার কার্বারীকে ছাগলের মালিককে দেয়ার জন্য সুবেদার নির্দেশ দেন।

এছাড়া সেনাবাহিনীর রান্না করার জন্য জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ থেকে শুরু করে ক্যাম্প জায়গা পরিস্কার করা সমস্ত কাজে কোন মজুরী দেয়া হয়নি।

বগালেক ক্যাম্পের অধীন নানা ধরনের অত্যারের শিকার ১৬টি পাড়া হলো- ১।মেনরনম্রোপাড়া, ২।লেংপুং ম্রোপাড়া, ৩।ফাইনাং ম্রোপাড়া, ৪।জনেরাং ত্রিপুরাপাড়া, ৫।কিস্তপাড়া ত্রিপুরাপাড়া, ৬।মংথোয়াইচিং মার্মাপাড়া(বগালেকপাড়া), ৭।বগামুখ হেডম্যানপাড়া মার্মাপাড়া, ৮।প্রংখ্যংসু মার্মাপাড়া, ৯।ম্রোখ্যং খুমীপাড়া, ১০।রুনতং খুমীপাড়া, ১১।সইরাতং মার্মাপাড়া, ১২।লেতং খুমীপাড়া, ১৩।ক্যউতাইং খুমীপাড়া, ১৪।লালসংথাং বমপাড়া (হারমনবমপাড়া), ১৫।সইকত বমপাড়া এবং ১৬।এগারকিলো ম্রোপাড়া।

এভাবে বগালেক ক্যাম্পের মতো রুমা জোনের অধীন চুংচংপাড়া ক্যাম্প, পুকুরপাড়া ক্যাম্প, বাকলাই ক্যাম্প, মুননোয়াম ক্যাম্প এবং রনিনপাড়া ক্যাম্প কর্তৃক জুম্ম অধিবাসীরা বেগার খাটাসহ নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে।

সামন্ত সমাজে এভাবে ভূস্বামীদের নিকট প্রজাদের বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খাটার বাধ্যগত রেওয়াজ ছিল। দেশ থেকে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হয়েছে। সারাদেশে সামন্ত সমাজ অনেকাংশে ভেঙ্গে গেছে। দেশে কোথাও ভূস্বামী নেই, তাই বেগার খাটার নিয়মও নেই। বেগার খাটানোর পদ্ধতি এখন সম্পূর্ণভাবে বেআইনী। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে তা এখনো বলবৎ রয়েছে। ভূস্বামীদের পরিবর্তে এখন সেনা ক্যাম্পের নিকট এই বেগার খাটতে হয় আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীদের।

এভাবে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেয়া ও জোরপূর্বক নামমাত্র মূল্যে মালামাল করতে বাধ্য করার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ। জুম্মদের ভূমি দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করা, নানা অজুহাতে সেটেলার কর্তৃক জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখলে সহায়তা করা, ঘরবাড়ি তল্লাসী ও তছনছ করা, নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে অস্ত্র ও সন্ত্রাসী মামলায় জড়িত করা, জুম্ম নারীর উপর যৌন সহিংসতা ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

কেবল তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে সেনাবাহিনী। মুসলিম সেটেলারসহ মৌলবাদী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীকে ভূমি কমিশনের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিসহ চুক্তি বিরোধী তৎপরতায় মদদ দিয়ে চলেছে। পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা ও নিজেদের হীন কায়েমী স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ এনে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে।