তিন ছাত্রনেতার নিঃশর্ত মুক্তি ও সেনাশাসন প্রত্যাহারের দাবিতে রাঙ্গামাটিতে পিসিপি’র বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি পেশ

0
125

হিল ভয়েস, ৫ মে ২০২৪, রাঙ্গামাটি: সেনাবাহিনী কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি থেকে আটককৃত তিন ছাত্রনেতার দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তি এবং ‘অপারেশন উত্তরণ’ এর নামে সেনাশাসন প্রত্যাহারের দাবিতে আজ (৫ মে) রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে সংগঠনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের (এডিসি) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি স্মারকলিপিও পেশ করা হয়েছে।

আজ বিকাল ৩ টার দিকে পিসিপি’র জেলা শাখার কার্যালয় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে বনরূপা বাজার প্রদক্ষিণ করে ডিসি অফিস প্রাঙ্গণে এসে সমাপ্ত হয় এবং সেখানেই প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক রনেল চাকমার সঞ্চালনায় ও সভাপতি জিকো চাকমা সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন চাকমা। সমাবশে আরও বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিপন ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি ম্রানু মারমা।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, যুগে যুগে যেখানে অন্যায় হয়েছে, নিপীড়ন হয়েছে ছাত্র সমাজই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আজকে জুম্মরা রাস্তায় নেমেছে অস্তিত্বের জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললে আজ সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে। কিন্তু সন্ত্রাসের চাষ করে সেনাবাহিনী। আজকে শুভলং কিংবা জীবতলিতে তারাই সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়।

বক্তারা আরও বলেন, নিজের মতামত প্রকাশ করা, সভা-সমাবেশ ও রাজনীতি করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের সংবিধান সিদ্ধ অধিকার। সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের রাষ্ট্রের ইতিবাচক দিককে যেমন প্রশংসা করার অধিকার রাখে, তেমনি রাষ্ট্রের মন্দ, নেতিবাচক দিককে সমালোচনা করার অধিকার রাখে। সংবিধানের অধিকার চর্চা করতে গিয়ে সেনাবাহিনী পিসিপি’র তিন নেতাকে আটক করেছে যা সংবিধান পরিপন্থী। আসল সন্ত্রাসীদের পুষে রেখে জনগণের উপর হয়রানি, নিপীড়ন ও নির্যাতন চালাচ্ছে তারাই। সেনা প্রশাসন দ্বিমুখী আচরণ করে চলেছে। এটা কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না।

বক্তারা জুরাছড়ির তিন ছাত্রনেতা রূপম, সুরেন ও রনি চাকমাদের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তিসহ, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক সেনা অপারেশন উত্তোরণ নামে সেনাশাসন প্রত্যাহার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত ও যথাযথভাবে সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানান।

সমাবেশ শেষে পিসিপি’র একটি প্রতিনিধিদল জেলা প্রশাসকের অবর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তিন ছাত্রনেতার মুক্তির দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেন।

স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ অত্যন্ত দু:খের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছে যে, গতকাল ৪ঠা এপ্রিল ২০২৪ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জুরাছড়ি সদর এলাকা থেকে জুরাছড়ি অন্তর্গত বনযোগীছড়া সেনা জোনের নিয়ন্ত্রণাধীন যক্ষা বাজার সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্য কর্তৃক পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রূপম চাকমা, সাংগঠনিক সম্পাদক সুরেন চাকমা এবং তথ্য ও প্রচার সম্পাদক রনি চাকমাকে কোন অভিযোগ ও ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক করা হয়েছে। সেসময় তারা চলমান ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সুরেশ কুমার চাকমার পক্ষে প্রচারণা কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। শুধু তাই নয়, গত ২৬ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে উক্ত ছাত্রদেরকে যক্ষা বাজার ক্যাম্পের চেকপোষ্টে তিন ঘন্টা ধরে আটকে রেখে অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করা হয়।

আরো উদ্বেগজনক যে, সেনাবাহিনী উক্ত ছাত্রদের গতকাল গ্রেফতারের পর নিষিদ্ধ ইয়াবা ট্যাবলেট ও চাঁদার রসিদ গুঁজে দিয়ে ছবি তুলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সাজানো মাদকদ্রব্য মামলা দিয়ে আজ (৫ মে ২০২৪) জুরাছড়ি থানায় সোপর্দ করেছে।

এখানে বিশেষভাবে প্রণিধান যে, সরকার বর্তমানে চলমান ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সরকারের এমনিতর গণতান্ত্রিক উদ্যোগের সময় সেনাবাহিনী নির্বাচনী প্রচারণার জড়িত ছাত্রদেরকে ইয়াবা ও চাঁদার রসিদ গুঁজে দিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার অপচেষ্টার ফলে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে বাধ্য।’

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, ‘ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে আপনার ঐকান্তিক উদ্যোগে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বেসামরিকীকরণের লক্ষ্যে উক্ত চুক্তিতে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এখনো সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি। অধিকন্তু ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে একপ্রকার সেনাশাসন কায়েম করা হয়েছে। উক্ত ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে সেনাবাহিনী সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে শুরু করে সকল প্রকার নির্বাচনে অগণতান্ত্রিকভাবে হস্তক্ষেপ করে চলেছে।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে সেনাবাহিনী প্রতিনিয়ত রাত-বিরাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে সেনা অভিযান, ধর-পাকড়, ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে বিচার-বহির্ভূত হত্যা, সেটেলার বাঙালিদের উস্কে দিয়ে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর এহেন পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী তথা অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্যতম উদ্দেশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্য ধুলিস্যাৎ হতে বসেছে।’

স্মারকলিপিতে নিম্নোক্ত ৪টি দাবি জানানো হয়-

১। অনতিবিলম্বে প্রথম ধাপের (৮ মে ২০২৪) নির্বাচনের পূর্বে জুরাছড়িতে গ্রেফতারকৃত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের তিনজন ছাত্রকে বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করা।

২। ছাত্রদেরকে অবৈধভাবে গ্রেফতারের সাথে জড়িত সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিধান মোতাবেক ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প অচিরেই প্রত্যাহার করা।

৪। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।