রাঙ্গামাটিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস

0
968

হিল ভয়েস, ৮ মার্চ ২০২১, রাঙ্গামাটি: আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী ও জুম্ম জাতির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইকারী অন্যতম নারী (ছাত্রী) সংগঠন ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’ এর ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর যৌথ উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলা সদরে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সকাল ১০:০০ টায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

এবারে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Women in Leadership: Achieving an Equal Future in a Covid-19 World’। উক্ত প্রতিপাদ্যের সাথে সামঞ্জস রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও মহিলা সমিতি তাদের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘করোনাকালে সমভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠায় নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদার করি’।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এছাড়া মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রিতা চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য এই আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে টিআইবি’র ট্রাস্টি এডভোকেট সুষ্মিতা চাকমা, অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন এর সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নান্টু ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশিকা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি রিনা চাকমা উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।

উক্ত কর্মসূচি ছাড়াও সংগঠন দুটি একটি প্রচারপত্র এবং শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যার সম্পাদনায় ‘জাগরণ’ নামে একটি বিশেষ প্রকাশনা প্রকাশ করেছে।

প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা আজ এমন সময়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি, যখন করোনা নামক মহামারী ব্যাধিতে পুরো বিশ্ব স্থবির হয়ে আছে। কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। বিশেষ করে মানুষের সেবা করতে গিয়ে যে সকল অন্দোলনকর্মী, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবী ও নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের অবদানও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

বৈশ্বিক এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে ৮ মার্চ। আপনারা জানেন, সমাজে শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে নারী সমাজের জাগরণ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের গতিধারায় এবং বিশ্বব্যাপী নির্যাতন, নিপীড়ন, বঞ্চনা, বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার নারীর নিরাপত্তা, সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তথা নারী মুক্তি আন্দোলনসহ মানবসমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে ৮মার্চ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক একটি দিন। বিশ্বব্যাপী কেবলই নয়, এ দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী সমাজের জন্য ঐতিহাসিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।’

এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের এহেন অনিশ্চিত ও নাজুক পরিস্থিতিতে জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা যেমনি প্রতিনিয়ত ভূলুন্ঠিত হয়ে চলেছে, তেমনি তাদের নিরাপত্তাহীন জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। সর্বোপরি জুম্ম নারীর জাতীয় অস্তিত্ব আজ চরম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও বিশেষত সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। গভীর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব অপরাধের যথাযথ বিচার হয়নি এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হয়নি।’

প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালে একজন সেনা সদস্যসহ সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ১৬ জন জুম্ম নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়। তার মধ্যে আগস্ট মাসে লামায় বহিরাগত ৬ বাঙালি সেটেলার কর্তৃক এক বিধবা ত্রিপুরা নারীকে (২৫) গণধর্ষণ এবং সেপ্টেম্বর মাসে খাগড়াছড়ি সদর এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেও ৯ জন বাঙালি সেটেলার কর্তৃক মানসিক প্রতিবন্ধী এক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণ এবং বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাটের ঘটনা ছিল সবচেয়ে লোমহর্ষক ও পৈশাচিক।

উল্লেখ্য, ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্বের সংগ্রামী ও সমাজতান্ত্রিক নারীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সমাজতান্ত্রিক নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারেই ৮ মার্চ তারিখে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদযাপনের সূত্রপাত ঘটে। মূলত ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে কাজের অমানবিক অবস্থা ও বৈষম্যমূলক মজুরীর প্রতিবাদে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের স্মরণে এই দিবসটিকে বেছে নেয়া হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের দেশে দেশে অব্যাহতভাবে নারী সমাজের জাগরণ ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৬ হতে ১৯৮৫ সময়কালকে নারী দশক হিসেবে ঘোষণা করে।

এদিকে ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চে বাংলাদেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সামরিক শাসন-শোষণ আর পুরুষতান্ত্রিক সামন্তীয় শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঝাঁক সাহসী জুম্ম তরুণীর উদ্যোগে গঠিত হয় ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’।