হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস

0
884

শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা

৮ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী সমাজের লড়াকু সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও বিশ্ব নারী দিবস একসাথে পালিত হচ্ছে।

প্রত্যেক বছরের মতন ৮ মার্চ ঘনিয়ে এলে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নারী অধিকার নিয়ে কথাবার্তা ও পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্লাটফর্মে লেখালেখি হয়। এ দেশের সরকার প্রধান সুন্দর সুন্দর বাণী দেন। পত্র-পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নারী সংগঠনগুলো শোভাযাত্রা ও সমাবেশ আয়োজন করে থাকে। এ সমস্ত আয়োজন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার ছিটেফোঁটাটুকুও পৌঁছায় না। বিশ্ব নারী দিবসের তাৎপর্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। তাদের কাছে ৮ মার্চ প্রতিদিনের মতন একটি দিন। এদিনটি এলে সরকার প্রধান ও মন্ত্রীরা নারীদের অধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। কার্যত সে দিনটি গেলে তাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখা যায় না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী যিনি টানা ১২ বছর যাবত ক্ষমতায় আসীন। তারপরেও দেশে নারীর উপর নিপীড়ন কমেনি। নারীর প্রাপ্য মর্যাদা ও সমধিকার সে তো দূরের কথা। অথচ প্রতিদিন বিভিন্ন খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলালে দেখা যায়, নারীর উপর ভয়াবহ নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, হত্যা, শ্লীলতাহানি, যৌন সহিংসতার খবর।

নারীর উপর নির্যাতন মূলত যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে সে তথ্য মেলে। শুধু এ দেশেই নয়, সারা বিশ্বে নারীর উপর নানা ধরনের সহিংসতা দেখা যায়। সে উন্নত দেশ কিংবা অনুন্নত দেশ যাই বলি। শুধু যুগের পরিবর্তনের সাথে নারীর কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক অবস্থানের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নারীর অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি রয়েছে অপরিবর্তিত।

মানব সমাজের ইতিহাসের ক্রমবিকাশের দিকে যদি তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখা যায়, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমমর্যাদা ও সমধিকারের অস্তিত্ব ছিল। এমনকি তখন নারীর মর্যাদা ছিল উচ্চ পর্যায়ের। কারণ সে সময়ে উৎপাদন ব্যবস্থা নারীদের করায়ত্বে ছিল। সন্তান উৎপাদন থেকে সন্তান লালন-পালনে নারীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সে সমাজটাকে বর্বর ও অশিক্ষিত সমাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও নারীদের উপর তেমন কোন বৈষম্য ছিল না। এক সময় আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে আর নতুন একটি সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীদের কর্তৃত্ব পুরুষের হাতে চলে যায়। তার সাথে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও নিউইয়র্ক শহরে শ্রমের ন্যায্যমূল্য দেয়া হত না। কারখানার ভেতরে নারী শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর কক্ষে কাজ করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্য পোশাক সেলাই করে দিতে হত। নারী শ্রমিকদের জন্য ছিল না কোন বিশ্রাম। সেলাই করতে গিয়ে কখনো কোন কোন নারী শ্রমিক মৃত্যুবরণ করত। নারী শ্রমিকদের উপর এহেন অমানবিক শোষণের প্রতিবাদে কারখানার শ্রমিকরা নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে করেন। তাদের প্রতিবাদ মিছিলে ধনিক শ্রেণির সরকার কর্তৃক লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী গুলি চালায়। শত অত্যাচারের মধ্যেও নারী শ্রমিকরা ক্রমাগত বিজয় ও অধিকার আদায়ের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের সেই আত্মত্যাগ ও অটল সংগ্রামের স্মরণে জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন ১৯১০ সালে নারীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেন। এরপর বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি পালিত হতে থাকে। পরে জাতিসংঘও ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তাই ৮ মার্চ বিশ্বের নারী সমাজের কাছে একটি বিজয়সূচক, স্মরণীয় ও বরণীয় দিন।

মানবের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, নারীরাও মানুষ এবং তার বিকাশের নিয়ন্তা তিনি নিজেই। তবে তার জন্য প্রয়োজন সংগঠিত শক্তি। কিন্তু জুম্ম সমাজ ব্যবস্থা এখনো ক্ষয়িষ্ণু সামন্তীয় হওয়ায় তা নারীদের ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত ও সংগ্রামে অবতীর্ণ করণে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করে। তাই প্রগতিশীল আর্দশকে পাথেয় ও ধারণ করেই নারীর নেতৃত্ব গঠন ও মুক্তির কথা ভাবতে হবে। কিন্তু আজকের দিনে যারা শিক্ষা-দীক্ষায় আলোকিত হচ্ছে তাদের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা লক্ষ্য করা গেলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে সংগ্রামে এগিয়ে আসতে তাদের তেমন দেখা যায় না। তারা ভাবেন শিক্ষিত হলেই বুঝি নারীর মর্যাদা ও মুক্তি নিশ্চিত হলো। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না আগাগোড়া বৈষম্যমূলক এই সমাজব্যবস্থাকে বদলাতে না পারলে এবং তার জায়গায় বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে নারীর সত্যিকারের মর্যাদা ও সমঅধিকার অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব না।

বিশ্বে নারী মুক্তি আন্দোলনের সাথে সংহতি রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্রগামী জুম্ম নারী সমাজ সমাজে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে চলেছে। প্রয়াত বিপ্লবী ও সাংসদ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মুক্তির দূত মহান নেতা এম এন লারমা সত্তর দশকের গোড়ার দিকে সর্বপ্রথম জোরালোভাবে নারী মুক্তির কথা তুলে ধরেন। এ লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে জুম্ম নারীদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। পরে ১৯৭৫ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি গঠন করা হয়। একই বছরের ১০ আগস্ট মহিলা সমিতির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মিনুপ্রু মারমা এবং এতে ৬৬ জন জুম্ম নারী প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে মাধবীলতা চাকমাকে সভাপতি, জয়শ্রী চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও দিপ্তী চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

উল্লেখ্য যে, সেই বছরে পুরুষের পাশাপাশি মহিলা সমিতির সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। নানা বাস্তবতার কারণে জুম্ম নারীদের পক্ষে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব না হলেও গ্রামের মহিলাদের সংগঠিত করা ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করাসহ জনসংহতি সমিতির সদস্যদের নানাভাবে সহায়তা দিয়ে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জুম্ম নারী সমাজকে বিশেষত জুম্ম ছাত্রী সমাজকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনটিতে ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’ আত্নপ্রকাশ করে। আন্দোলনের পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে। তখনকার সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অগ্রসর প্রতিবাদী নারী গৌরিকা চাকমা এবং শিলা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশন গঠনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। আজ তার উত্তরসূরিরা এ সংগঠনের পতাকা তলে এসে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও নারী মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি। জুম্ম নারীর উপর থেকে সরে যায় নি জাতিগত নিপীড়নের বিভৎস ছোবল। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২৩ বছরেও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ বহিরাগত সেটেলারদের কর্তৃক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। জাতিগত নিপীড়নের পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক জীবনেও জুম্ম নারীর অধিকার বঞ্চনা ও বৈষম্যের চাপে পদদলিত হয়ে আসছে। জুম্ম সমাজে মেয়েদের বিয়ে করতে যৌতুক প্রথার প্রচলন নেই। তবে পুরুষ শাসিত সমাজ হিসেবে নারীদের সম্পত্তি লাভের অধিকার তেমন স্বীকৃত নয়। তাই একজন নারী পুরুষের চাইতে অসহায় সম্বলহীন এক অবলা। ফলে প্রায়ই একটুখানি টক্কর খেলে সহজেই ভেঙে পড়ে। জুম্ম সমাজে নারী পুরুষের যে বৈষম্য তা প্রচলিত সামন্ত সমাজে এভাবেই প্রতিফলন ঘটে।

আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আজ জুম্ম নারী ব্যবসা, বাণিজ্য, উচ্চ শিক্ষা, চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমাজে আদৌ নারী অধিকার স্বীকৃত নয়। সামগ্রিকভাবে নারীদের এখনো পণ্যের মত বিবেচনা করা হয়। দেশের সমগ্র নারীরা এখনও পুরুষের সমান রাজনৈতিক মর্যাদা পায় না।

১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে জেলা পরিষদের তিনজন নারী ও আঞ্চলিক পরিষদে তিনটি নারী আসন সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমগ্র সমাজে ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নারীদের অধিকারের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট নয়। সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নারী সমাজকে বাদ দেয় নি। তার একটা সুস্পষ্ট কারণ হচ্ছে জনসংহতি সমিতির মধ্যে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার চর্চা রয়েছে এবং আজো অবধি তারা লালন করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীরাও মূলত প্রগতিবাদী। কারণ তারা সরাসরি উৎপাদন সংগ্রামের সাথে জড়িত। এমনকি জুম্ম পুরুষের তুলনায় তারা আরও বেশি পরিশ্রমী, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল। আজও জুম্ম সমাজে নারীরা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি নিজেদের প্রয়োজনীয় পিনোন-খাদি, বুরগি, চাদর বুনন করে শিল্প কর্মে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছে।

বলাবাহুল্য, ২০২০ সাল থেকে চলমান করোনাকালে নারীরা নানাভাবে পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। সংকটময় সময়ে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম তা সমাজকে মেনে নিতেই হবে। সমাজে জুম্ম পুরুষরা যেটা করতে পারে, জুম্ম নারীরা তার দ্বিগুণ শৈল্পিক গুণ নিয়ে সে কাজটি করতে পারে। পুঁজিবাদী বিশ্বে অপসংস্কৃতির নানা প্রভাব পড়া সত্ত্বেও জুম্ম নারীরা তার জাতিগত স্বাতন্ত্র্যতার একমাত্র বাহক ও সংরক্ষক। সেদিকে তাকালে জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্যতম প্রতীক ও ধারকবাহত হিসেবে নারীরাই সবচাইতে অগ্রগামী অংশ। তারপরেও সামগ্রিকভাবে জুম্ম নারীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি। তাই এ সমাজকে পরিবর্তন করতে জুম্ম নারীদের অধিকতরভাবে এগিয়ে আসা জরুরী।

যুগে যুগে পুরুষতন্ত্র নারীকে পদানত করে রাখতে চাইলেও পদানত রাখতে পারেনি। নারী তার প্রতিজ্ঞা, সংগ্রাম এবং আন্তরিক ক্ষমতার বলে পুরুষের উপর বিজয় লাভ করেছে। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় বহু মহিয়সী নারীর কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভাল-মন্দ নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে রয়েছে। ইতিহাসে যতজন বিখ্যাত পুরুষের নাম লিপিবদ্ধ আছে, অনেক বিখ্যাত নারীর নামও গুরুত্ব সহকারে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। যেমন রাশিয়ার রাণী ক্যাথারিন দি গ্রেট, স্পেনের রাণী ইসাবেলা, মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রা, ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের চাকমা রাণী কালিন্দীসহ আরও অনেকে। তাদের জীবন ভালো-মন্দে চিত্রিত হলেও নারীত্বের মহিমা তাদের রাজশাসনে প্রতিফলিত হয়েছে।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও জাত্যভিমানী শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ ও প্রতারণা। সুতরাং যে জাতি শোষিত-শাসিত, অধিকার বঞ্চিত সে জাতির নারীরা কিভাবে মুক্ত থাকতে পারে? পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সমস্যার সমাধান তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। আমরা আশা করেছিলাম, এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে এবং আদিবাসী জুম্মদের উপর যুগ যুগ ধরে যে চলমান বৈষম্য, বঞ্চনা, অবহেলা ও নিপীড়ন তার অবসান ঘটবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে জুম্ম নারীর অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত হবে না। এমনকি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না এবং সামগ্রিক অগ্রযাত্রা সম্ভব হবে না। বলাবাহুল্য, জুম্ম নারীর অধিকার কখনো পার্বত্য চুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরঞ্চ এই চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে প্রশস্ত হতে পারে জুম্ম নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জুম্ম নারীর মুক্তির পথ। তাই জাতিগত নিপীড়ন ও সহিংসতা থেকে মুক্তি পেতে এবং জুম্ম নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরী।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র বিভিন্নভাবে ছড়াচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের একটি মহল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান আইন জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনী উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে হোটেল, পর্যটন এবং সেনা ক্যাম্প বসানোর নামে শত শত একর ভূমি দখল করে জুম্মদের উচ্ছেদ করছে। ফলে জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী ও চুক্তিবিরোধী কার্যকলাপ পরিচালনার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে নারীরাই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ধর্ষণসহ নানাবিধ সহিংসতার শিকার হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের কাছে নিত্য নৈম্যক্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক নারী ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। কিছু প্রকাশ পাচ্ছে, কিছু প্রকাশ পাচ্ছে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্প্রতি ২৩ বছর অতিক্রম করেছে। এখনো চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে চুক্তিটা এমনি আসেনি। এ চুক্তির সাথে দীর্ঘ দুই যুগের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস জড়িত রয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আন্দোলন-সংগ্রাম ব্যতীত কোন জাতি বা শ্রেণি অধিকার পায়নি। তাই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জুম্ম জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সরকারকে তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, চুক্তি বাস্তবায়নের এবং অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে নারী সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তবে নারীদের অধিকার ও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে নারীরা সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে নারীদের রাজনৈতিক ভূমিকার ক্ষেত্রে বা নেতৃত্বদানে নারী নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। তাই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। নারী নেতৃত্ব জোরদার করতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে। সমাজ পরিবর্তন ছাড়া নারী মুক্তি ভাবা যায় না। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে জুম্ম নারী সমাজ, জুম্ম জনগণ এবং দেশের সকল প্রগতিশীল অধিকারকামী জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

লেখক: শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেন্স ফেডারেশন