প্রসঙ্গঃ দেশভাগে পার্বত্য চট্টগ্রাম

0
806
                                          দেবশ্রী বন্দোপাধ্যায়                                        
      সেদিনের সম্ভাবনা আজকের অলীক কল্পনা। ১৯৪৭ সালের সম্ভাবনা আজকের ২০১৯ সালে অলীক কল্পনা। তবে অসম্ভব কিছু নয়। ১৯১৭ মহাত্মাগান্ধী  সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেমে বা ১৯২২ এ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে কখনো ভাবেনি ভারত একদিন স্বাধীন হবে। একইভাবে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নেমে বাঙালি জাতি বা বঙ্গবন্ধুও কল্পনা করেনি ১৯৭১ এ তারা স্বাধীনতা পাবে।

১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারতভুক্তি ছিল সম্ভাবনা আর ২০১৯ সালে এটি একটি দুর্ভাবনা, অবাস্তব, অলীক কল্পনা। কিন্তু তবু পার্বত্য চট্টগ্রামের কেবল চাকমা নয় সকল আদিবাসী সংখ্যালঘু জাতি (বিশেষত রাঙ্গামাটি ও তার উত্তরাংশের মানুষ নিবৃতে লালন করে এই কামনা, বাসনা। ভারতে বসবাসরত চাকমা, ত্রিপুরা ও মগ (মারমা) সম্প্রদায়ের সকল মানুষও ভাবে চট্টগ্রামের ঐ অংশটা ভারতে জুরে থাকলে আজ আমাদের ভবিষ্যত অন্যদিকে মোর নিতে পারত। চাকমা ন্যাশন্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (সি এন সি আই) নামের একটি সংগঠন ১৭ই আগষ্ট দিন টিকে কালোদিন হিসেবে আক্ষেপের সাথে পালন করছে। ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা আর ১৫ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা হলেও ১৭ই আগষ্টের রাতেই ঘোষিত হয় বেঙ্গল বাউন্ডারী কমিশনের রিপোর্ট। এদিনই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকিস্তান অর্ন্তভুক্তি প্রকাশিত হয়।

এই ১৭ই আগষ্ট কালো দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ পালন করলে সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী বলেই ধারণা জন্মাতে পারে। যেহেতু  বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ যে উত্তরাধিকার সূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পেয়েছে তাতে কারোর কিছু বলার নেই। এম এন লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ স্বাতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকার আন্দোলন করতে গিয়েই কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলকে স্পর্শকাতর হিসেব করে অতি মাত্রায় সামরিকায়ন ও লক্ষ লক্ষ সমতলের মুসলিম উদ্ভাস্তুর প্রত্যাবাসন দিয়ে তার কব্জাকে আরো শক্তিশালী করে ফেলেছে। বাংলাদেশ তার দেশের সীমা অখন্ড রাখতে যা করেছে সবই ঠিক করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা ক্যান্টনমেন্ট বসিয়েছে। লক্ষ লক্ষ সমতলের ভূমিহীন বাঙালী মুসলিম পরিবারকে পার্বত্য এলাকার আনাচে কানাচে, বিশেষত ভারত সীমান্ত এলাকায় বসতি দিয়েছে। পৃথিবী জুড়ে সরকারের এই পলিসীকে বলা হয় পপুলেশন ট্রান্সফার বা জনসংখ্যা স্থানান্তর ।

১৯৯০ সালে ইউরোপিয়ন দেশগুলির বেশকিছু সংস্থা নিয়ে গঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন’ রিপোর্ট অনুসারে প্রতি ৫ জন পাহাড়ির পেছনে ১ এক জন সেনা সদস্য। এটি একটি ভয়ঙ্কর সামরিক উপস্থিতি। ১৯৪৭ সালে পাহাড়ি ও মুসলিমদের অনুপাত ছিল ৯৮ জন পাহাড়ি ১ জন মুসলিম। আজ ৭৩ বছর পর এই অনুপাত উল্টো হতে শুরু হয়েছে। এখন ৬০ জন মুসলিম ৪০ জন পাহাড়ি। আর ৫০ বছরে ঠিক ১৯৪৭ সালের উল্টো চিত্র অর্থাৎ ৯৮ জন মুসলিম ১ জন পাহাড়ি, এমনই অনুপাত দাঁড়াবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক অঞ্চলে জন সংখ্যার।

ভারতে থাকি আর নাই থাকি আমরা ভারতীয় । আমরা ভারতেই তো ছিলাম। ভারতই আমাদের মূল ভূখন্ড। আজকের পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর এই ইন্ডিয়া, বিশাল ভারত উপমহাদেশ নামেই ছিল। কি শিক্ষায় বা সংস্কৃতিতে, চিন্তা আর চেতনায় সবই তো ভারতীয়। তখনকার সময়ে শুধু নয় আজো অন্তত চাকমা ও ত্রিপুরা এই দু’ই জনগোষ্ঠীর মানুষ রামায়ন, মহাভারতের কাহিনী এবং মূল্যবোধই তো লালন করে চলেছি। আমাদের স্ব স্ব ভাষা সংস্কৃতি আছেই। তার উপর ভারতীয় সভ্যতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছি। শুধু চাকমারাই নয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার কামনায় ছিল ১৯৪৭ – এর ভারত ভাগের সময়ে। ভূমিকায় চাকমা নেতৃত্ব অগ্রগামী ছিল বলেই হয়তো তাদের নাম সর্বাগ্রে আসছে। ওখানকার ত্রিপুরা জনগনও চেয়েছিল ত্রিপুরা রাজ্যের হয়ে ভারতে অর্ন্তভুক্ত হতে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থেকেও  ওরা ভারতীয়ই ছিল। বাঙালি মুসলিমরা পর্য্যন্ত পাকিস্তানী হতে পারেনি। ১৯৫২ সালে  উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে না পারার ঘটনা থেকেই তো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অব্দি গড়ালো। ভারত না হলে বাংলাদেশ কল্পনারই বাইরে। ভারতের আশ্রয় এবং সার্বিক সাহায্য ন হলে সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ৯ বছরেও শেষ হতো কিনা সন্দেহ। মগ বা মারমাদের কথা বাদ দিলে ত্রিপুরা ও চাকমা জাতির লোকদের নামকরণ পর্য্যন্ত আগাগোড়াই ভারতীয়। নামও তাদের তাই, ভারত চন্দ্র, রাম চন্দ্র, সীতা দেবী, লক্ষণ সেন চাকমা বা দুর্গা রাম ত্রিপুরা, লক্ষ্ণীরানী ত্রিপুরা। ঘরে ঘরে রামায়ন, মহাভারতের বই থাকত এক সময়। বয়স্কদের মুখেও রাম লক্ষ্ণণের গল্পই তো শুনতাম। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, শক্তিধর ভীম, অর্জুনদের গল্পই তো পছন্দ করতাম। শুধু ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি পূর্বপাকিস্তানে ঢুকিয়ে দিয়েছে বলেই আজ এই দুর্গতি। বল্লভ ভাই প্যটেল পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতেই অর্ন্তভুক্তির কথাই বলেছিলেন। প্রয়োজনে অস্ত্র দিয়ে হলেও। তাই স্নেহ কুমার চাকমাকে সাহস যুগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “যাও আমরা আছি তোমাদের সাথে। প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধ করে হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে রাখতে হবে। ওরা সবাই অমুসলিম। ওটা ভারতেই ঢুকবে। এখানে কোন সন্দেহ নেই।” কিন্তু জওহর লাল নেহেরু ঐ দিকে পাঞ্জাবের ফিরোজপুর ও কাশ্মীর হারানোর ভয়ে শংকিত ছিলেন । সেই স্বাভাবিক কারনে বৃটিশের প্রতিনিধি পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা শাসক জি এল হাইড নিজেও চাকমা নেতাদের সাথে রাঙ্গামাটিতে তার বাস ভবনেও সরকারীভাবে ভারতীয় তেরঙ্গা পতাকা তুলেছিলেন।

আজ ৭ দশক পেড়িয়ে এসেও পাহাড়ের মানুষ সেদিনের বেঙ্গল বাউন্ডারী কমিশনের অন্যায় ভুলেনি। কেবল পাহাড়ের মানুষ নয় আজ ভারতীয় ভূখন্ডে পড়ে যাওয়া তাদেরই লক্ষ কোটি সহমর্মী ভারতবাসী বৃটিশদের কৃতকর্মের প্রতিবাদ জানায় আর পার্বত্যাঞ্চলের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান সংখ্যালঘু জনগণের উপর জাতিগত নির্যাতনে মর্মাহত না হয়ে পারিনা।

বাংলাদেশ সরকার বা সকল বাঙালি জাতি বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্ট পক্ষ নয় ১৭ই আগষ্ট কালো দিবস পালনের ক্ষেত্রে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন বাংলাদেশেরই অবিচ্ছদ্য অংশ এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কেউ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি, মানুষ, সম্পদ সবই বাংলাদেশের। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের যে জনগণ এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে শান্তিতে তাদের স্বকীয়তা রক্ষা করে বাঁচতে চায় তাদের সাথে বৈষম্যের শাসন কাম্য নয়। চুক্তি করেছো অথচ সেই চুক্তির বাস্তবায়ন হবে না এটা মানা যায় না। চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি করলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য কাশ্মীর হয়ে দাঁড়াতে পারে এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বৃটিশদের ভারতবাসীর প্রতি অন্যায় বৈষম্যই নিজেদের বিতাড়িত হওয়ার ঐতিহাসিক বীজ বুনেছিল। বাংলাদেশও অতি ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীকে যদি সহৃদতায় আগলে না রাখে তবে তার পরিনামও অশুভ হতে কতক্ষন? অন্যদিকে ভারত যদি ভারতপ্রেমী (পার্বত্যবাসী হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান) অতি ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর প্রতি দয়া দেখাতে দেরী করে তাহলে ৫০ টি বছর লাগবে না ত্রিপুরা বা মিজোরামের একাংশ আসামের বদরপুর, করিমগঞ্জ বা হাইলাকান্দির চেহারা নিতে। কারণ আর কিছুই নয়, সমতলের জনস্রোত যে গতিবেগে ঢুকছে পাহাড়ে তার উপর যোগ হয়েছে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অবাধ অনুপ্রবেশ। তখন আর বেশী দেরী নেই যখন এ প্রান্তে জন্ম নেবে অন্য কাশ্মীর।