রাঙ্গামাটির তিন উপজেলার ৯টি পদের ৮টিতেই জয়ী জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীরা

0
790

হিল ভয়েস, ১০ মে ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গত পরশু (৮ মে) সারা দেশের ন্যায় পার্বত্য তিন জেলায়ও অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। তন্মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলার দশ উপজেলার মধ্যে চারটি উপজেলায় (রাঙ্গামাটি সদর, বরকল, জুরাছড়ি ও কাউখালি) প্রথম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এদের মধ্যে রাঙ্গামাটি সদর, বরকল ও জুরাছড়ি উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান (সাধারণ) ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শুধু জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বাদে অন্য সকল পদেই বিজয়ী হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সমর্থিত প্রার্থীরা।

জেএসএস’এর জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থীর স্বল্প ভোটের ব্যবধানে সরকারি দল আওয়ামীলীগের প্রার্থীর কাছে পরাজয়ের পেছনেও জুরাছড়ির বনযোগীছড়া সেনা জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত তথা সেনাবাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপ ও ভূমিকা ছিল বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায়ও সরকারি দলের প্রার্থীর সমর্থনে সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করার চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যায়।

রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা পরিষদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষিত প্রার্থীরা হলেন- চেয়ারম্যান পদে জেএসএস সমর্থিত অন্ন সাধন চাকমা, তিনি ভোট পেয়েছেন দোয়াত-কলম প্রতীকে ১৪,৮৮৫ ভোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামীলীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা পেয়েছেন ১০,০২৯ ভোট; মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জেএসএস সমর্থিত রিতা চাকমা, তিনি ভোট পেয়েছেন প্রজাপতি মার্কায় ২০,৭৯৮ ভোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী নাসরিন ইসলাম সেলাই মেশিন প্রতীকে পেয়েছেন ৫,২৭৩ ভোট; ভাইস চেয়ারম্যান (সাধারণ) পদে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী পলাশ কুসুম চাকমা, তিনি মাইক প্রতীকে পেয়েছেন ১১,৪৫০ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দয়াময় চাকমা তুক্কে উড়োজাহাজ মার্কায় ভোট পেয়েছেন ৫,১১৮ ভোট।

বরকল উপজেলা পরিষদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষিত প্রার্থীরা হলেন- চেয়ারম্যান পদে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী বিধান চাকমা, তিনি ভোট পেয়েছেন দোয়াত-কলম প্রতীকে ১১,৩২৮ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থী সন্তোষ কুমার চাকমা আনারস প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ৬,৬৭৭ ভোট; মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী সুচরিতা চাকমা, তিনি হাঁস প্রতীকে পেয়েছেন মোট ১২,৩৮৭ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রাখি চাকমা সেলাই মেশিন প্রতীকে পেয়েছেন ৫,১৫২ ভোট; ভাইস চেয়ারম্যান (সাধারণ) পদে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী জ্ঞান জ্যোতি চাকমা, তিনি টিউবওয়েল প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ১৩,০৫৩ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পুলিন বিহারী চাকমা উড়োজাহাজ প্রতীকে পেয়েছেন ৪,১৭১ ভোট।

জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষিত প্রার্থীরা হলেন- চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, তিনি ভোট পেয়েছেন আনারস প্রতীকে ৪,৬৯৩ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী সুরেশ কুমার চাকমা দোয়াত-কলম প্রতীকে পেয়েছেন ৩,৩৫৯ ভোট; মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী অনিতা দেবী চাকমা, তিনি হাঁস প্রতীকে পেয়েছেন ৭,০২২ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জ্যোৎস্না তালুকদার পদ্ম ফুল প্রতীকে পেয়েছেন ৩,৭৮৯ ভোট; ভাইস চেয়ারম্যান (সাধারণ) পদে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী কামিনী রঞ্জন চাকমা, তিনি চশমা প্রতীকে পেয়েছেন ৫,৩৯২ ভোট, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রন্টু চাকমা উড়োজাহাজ প্রতীকে পেয়েছেন ৫,৩১৬ ভোট।

কাউখালী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থী শামসুদ্দোহা চৌধুরী আনারস প্রতীকে ২৩,৬৯৩ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষিত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, নির্বাচনে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় উল্লেখযোগ্য কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা অভিযোগের কথা জানা না গেলেও, জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায় সেনাবাহিনী কর্তৃক সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে বিধিবহির্ভূতভাবে পক্ষপাতিত্ব, ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করার ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যায়। বিশেষত জুরাছড়ি উপজেলায় বনযোগীছড়া সেনা জোনের জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত কর্তৃক নিজে এবং তার নেতৃত্বে জেএসএস সমর্থিত জনগণ ও ভোটারদের আটক, মিথ্যা মামলা দায়ের, ঘরবাড়িতে ভাঙচুর, হুমকি প্রদান ও ভোটদানে ভোটারদের বাধা প্রদানের ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের অনেক মুরুব্বির অভিযোগ, নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্ব থেকে এবং নির্বাচনের দিনও সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা ও ভোটারদের চাপ প্রয়োগের কারণে জুরাছড়িতে স্বতস্ফূর্তভাবে ভোটগ্রহণ হতে পারেনি। অনেকে সেনাবাহিনীর বাধা পেয়ে ও তাড়া খেয়ে ভোট কেন্দ্রে আসতে পারেনি। স্বয়ং বনযোগীছড়া সেনা জোনের জোন কমান্ডার জুলফিকলী আরমান বিখ্যাত নিজে উপজেলার সকল হেডম্যান ও কার্বারিদের ফোন করে আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমাকে ভোট দিতে হবে বলে নির্দেশ দেন এবং না দিলে অসুবিধা হবে বলে হুমকি প্রদান করেন।

অপরদিকে, গত ৪ মে, সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআাইয়ের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেনামদদপুষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদের ২০-২২ জনের একটি সশস্ত্র দল দুটি স্পীডবোট যোগে সুবলং থেকে বরকলের উজানে ছোট হরিণা বাজার পর্যন্ত সশস্ত্র মহড়া দেয়। পথে এরাবুনিয়া এলাকায় বিজিবি সদস্যদের দ্বারা উক্ত সন্ত্রাসীরা হাতেনাতে সশস্ত্রভাবে ধরা পড়েন এবং সেনাবাহিনীর কথামত তারা সেখানে আসছিলেন বলে বিজিবির কাছে জানান। পরে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের হস্তক্ষেপে বিজিবি সদস্যরা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও গোলাবারূদ ফেরত দিতে এবং চা-নাস্তার আপ্যায়ন করে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তবে একাধিক ভিডিওতে উক্ত ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সন্ত্রাসীরা অবস্থা বুঝে সেদিনই সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য যে, সন্ত্রাসীরা গত ৩ মে সন্ধার দিকে সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রহরায় লংগদু বাজার থেকে দুটি জেটবোটে করে সুবলং বাজারে এসে রাত্রি যাপন করে।

উল্লেখ্য যে, এটি দেশের ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এতে প্রথম ধাপে মোট ১৩৯টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। প্রথম ধাপে রাঙ্গামাটি জেলার চার উপজেলা ছাড়াও খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি, রামগড় ও লক্ষীছড়ি উপজেলায় এবং বান্দরবান জেলার বান্দরবান সদর উপজেলা ও আলীকদম উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। জনসংহতি সমিতি শুধু রাঙ্গামাটি জেলার তিন উপজেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রথম ধাপে রাঙ্গামাটি জেলার ৪ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ১২ জন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ জন এবং পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।