পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে টাস্ক ফোর্স কমিটি পুনর্গঠন

0
1203
ভারতের ত্রিপুরায় জুম্ম শরণার্থী, ছবি: Jenneke Arens, IWGIA (1990).

৫ জুলাই ২০২১, হিল ভয়েস, ঢাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে ভারতপ্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্ক ফোর্স কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ২২ জুন ২০২১ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আশীষ কুমার সাহা কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উক্ত ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্ক ফোর্স কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে।

উক্ত পুনর্গঠিত কমিটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে পদদলিত করে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার জেলাপ্রশাসকদেরও কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া টাস্ক ফোর্স কমিটির এস এম শফির স্থলে এ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন কবীরকে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন যে, সরকার/পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্তাবলী গ্রহণ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা বা তাদের সম্মতি ব্যতিরেকে একতরফাভাবে। যা কোনোভাবেই পার্বত্য চুক্তির অন্তর্নিহিত আকাঙ্খা ও চেতনার সাথে সামঞ্জসপূর্ণ নয়।

এর আগে গত ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ভারতপ্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছিল।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা হিল ভয়েসকে বলেন, জেলাপ্রশাসকদেরকে টাস্ক ফোর্সের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো বিধান বা রীতি নেই। এ কারণে পূর্বে পুনর্গঠিত কোনো কমিটিতে জেলাপ্রশাসকদেরকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়নি। কিন্তু এবারে পুনর্গঠিত টাস্ক ফোর্স কমিটিতে জনসংহতি সমিতির সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে জেলাপ্রশাসকদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা বর্তমান সরকারের পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘনের সর্বশেষ উদাহরণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন যে, সরকার পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে জেলাপ্রশাসকদেরকে টাস্ক ফোর্স কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য টাস্ক ফোর্সের বিভিন্ন সভায় প্রস্তাব দিয়ে আসছে। পার্বত্য চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বিধায় জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দ সরকার পক্ষের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা বৃদ্ধিপূর্বক পার্বত্য চুক্তি ও ২০-দফা প্যাকেজ চুক্তি পদদলিত করে সরকারের ইচ্ছামাফিক ভারতপ্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার হীনউদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলাপ্রশাসকদেরকে টাস্ক ফোর্স কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির উক্ত কর্মকর্তা অভিমত ব্যক্ত করেন।

জনসংহতি সমিতির সজীব চাকমা আরো জানান যে, পূর্বের টাস্ক ফোর্স কমিটিগুলোতে সদস্য-সচিব হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারকে রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি কাজে বিভাগীয় কমিশনার ব্যস্ত থাকায় নিয়মিত ও সময়ানুসারে টাস্ক ফোর্সের সভা আহ্বানে নানা জটিলতা দেখা দিয়ে আসছিল। তাই জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে টাস্কফোর্সের কাজের গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে বিভাগীয় কমিশনারের পরিবর্তে টাস্ক ফোর্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকতাকে (উপ-সচিব) সদস্য-সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার সেই প্রস্তাবের প্রতি কর্ণপাত না করে পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করে তিন পার্বত্য জেলাপ্রশাসকদেরকে সদস্য নিয়োগ দিয়েছে।

তিনি বলেন, সরকার চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য যেসকল পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার, সেগুলো না নিয়ে চুক্তি লংঘন করে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে বরং ক্রমশই জটিলতর করে তুলছে, যা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চুক্তিতে কেবলমাত্র আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কথা বুঝানো হয়ে থাকলেও পূর্বের আওয়ামীলীগ সরকার (১৯৯৬-২০০১) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বসতিদানকারী সেটেলার বাঙালিদেরকেও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী এই উদ্যোগের প্রতিবাদে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিদ্বয় টাস্ক ফোর্সের নবম সভা চলাকালে ওয়াকআউট করেন। পরবর্তীতে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে দীপঙ্কর তালুকদারের সভাপতিত্বে ১৫ মে ২০০০ অনুষ্ঠিত টাস্ক ফোর্সের অবৈধ একাদশ সভায় একতরফাভাবে ৯০,২০৮ উপজাতীয় পরিবার এবং ৩৮,১৫৬ অউপজাতীয় সেটেলার পরিবারকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অবশেষে পার্বত্যবাসীর প্রবল প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন টাস্ক ফোর্সের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে।

১৯ জুলাই ১৯৯৮ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগ থেকে সেটেলার বাঙালিদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের জন্য যে পত্র টাস্ক ফোর্সকে দেয়া হয়েছে তা প্রত্যাহারের জন্য গত ২৪ অক্টোবর ২০১০ জনসংহতি সমিতির তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আজ অবধি এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর একের পর এক প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্স গঠিত হলেও এবং আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে ৯০,০০০ জুম্ম পরিবার পরিচিহ্নিত করা হলেও এখনো প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদেরকে তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণপূর্বক পুনর্বাসন করা হয়নি। টাস্ক ফোর্সের সভায় সিদ্ধান্ত হলেও এখনো আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের রেশন প্রদান করা শুরু হয়নি। ফলে বিগত ২৩ বছর ধরে আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুরা অনিশ্চিত জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। অপরদিকে ভারত প্রত্যাগত ১২,২২২ শরণার্থী পরিবারের মধ্যে এখনো ৯,০০০ পরিবারের জায়গা-জমি ফেরত দেয়া হয়নি এবং প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের ৪০টি গ্রাম এখনো সেটেলারদের দখলে রয়েছে।