জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাক্ষাৎকার

0
3329
ছবি: ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও গ্রন্থনা করেছেন মঙ্গল কুমার চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ সভাপতি ও সাংসদ ঊষাতন তালুকদার এবং তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রচারকার্যের উদ্দেশ্যে ১৮-২৫ জুন ২০১৬ যুক্তরাজ্য সফরকালে ২৪ জুন শুক্রবার জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে দেখা করতে ম্যানচেস্টারে যান। লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টার শহর ২০০ মাইল দূরে। ম্যানচেস্টার শহরের Salford এলাকায় তিনি থাকেন একটি সরকারি এপার্টমেন্টে। সুব্রত চাকমা ও প্রবীর শংকর চাকমার সহযোগে সুব্রত চাকমার গাড়ি যোগে জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদল সকাল নয় টায় নান্টু চাকমার লন্ডনের আপমিনিস্টার বাসা থেকে রওয়ানা দেন এবং বিকাল তিন/চার টার দিকে ড. দেওয়ানের এপার্টমেন্টে পৌঁছেন। সেখানে তাঁর সাথে দুই ঘন্টা কথা বলার পর তাঁরা ম্যানচেস্টার থেকে বিকাল ছয় টায় রওয়ানা দিয়ে নান্টু বাবুর বাসায় রাত সাড়ে দশ টার দিকে পৌঁছেন।
বলে রাখা ভালো যে, সুব্রত চাকমা পেশায় একজন তথ্য প্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর বাবা এককালে ছিলেন জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’র একজন সদস্য। সুব্রত চাকমা সপরিবারে লন্ডনের উপকণ্ঠে এসেক্সে বাস করেন। সহযাত্রী প্রবীর শংকর চাকমা রাঙ্গামাটির তবলছড়ি এলাকা থেকে যুক্তরাজ্য প্রবাসী। বুলগেরিয়ায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কলারশীপে লেখাপড়ার পর তিনি ১৫/১৬ বছর আগে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। ব্যক্তি জীবনে তিনি চিরকুমার।
যুক্তরাজ্য তথা ইউরোপে গ্রীষ্মকাল সবে শুরু হয়েছে। তবে আবহাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। এই রোদ আর এই অঝোরে বৃষ্টি। তাই ছাতা বা রেইন কোর্ট, গরম কাপড় ইত্যাদি সঙ্গে রাখতেই হয়। সকালে নান্টু বাবুর বাসা থেকে রওয়ানা দেওয়ার সময় ছিল রোদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে সকাল। কিন্তু যতই ম্যানচেস্টারের দিকে সুব্রত চাকমার দক্ষ ড্রাইভিং-এ এগুতে থাকি, ততই বৃষ্টি অঝোরে নামতে থাকে। বিশেষ করে মাঝপথে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহাম শহরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর সেই প্রবল বৃষ্টির মুখোমুখী হই আমরা। তাই সুব্রত চাকমা একটু সতর্কভাবে গাড়ি চালাতে থাকেন। এছাড়া নান্টু বাবুর মাধ্যমে টেলিফোনে ড. দেওয়ান সতর্ক করে দিয়েছিলেন সুব্রত চাকমা যেন গাড়ি সতর্কভাবে ও আস্তে চালান। ফলে ম্যানচেস্টারে পৌঁছতে প্রতিনিধিদল কিছুটা দেরি হন।
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে লেখক মঙ্গল কুমার চাকমা
ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান যিনি ড. আর এস দেওয়ান নামে সমধিক পরিচিত, তিনি একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক ও সংগ্রামী মানুষ। তিনি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারকার্যের অন্যতম পুরোধা। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে তাঁর মাধ্যমে জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের পত্তন ঘটেছে যা ধীরে ধীরে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং অধিকতর তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে আন্দোলনের অন্যতম সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান ও সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে সুদূর যুক্তরাজ্যে থেকেও নিজের দেশ ও স্বজাতির প্রতি তাঁর ভালবাসা ও প্রাণের টান এতটুকু কমেনি। পাশ্চাত্য সমাজ জীবনের ভোগবাদী সংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেকে সঁপে দেননি। 

কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি লাভ করার পর লোভনীয় চাকরির দিকে ধাবিত না হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বেকার ভাতা নিয়ে টানাপোড়েনের জীবন গ্রহণ করে দেশ ও জাতির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। জুম্ম জাতির সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দেয়ায় ব্যক্তি জীবনে ড. দেওয়ান বিয়েও করেননি। যুক্তরাজ্য সরকারের বরাদ্দ করা দু’ কামরা বিশিষ্ট একটি ছোট্ট ঘরে সাদাসিধে জীবনযাপন করেন তিনি। তিনি নিরিবিলি জীবনে অভ্যস্ত। জনসংহতি সমিতির সিনিয়র নেতৃত্বের আগামনী বার্তা পেয়েই তিনি সমিতির প্রতিনিধিদেরকে সাক্ষাৎ দিতে সম্মত হয়েছেন। তাই তাঁর সাথে দেখা করা এবং তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করা একটা বিরল সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

ড. আর এস দেওয়ান ১৭ই জানুয়ারি ১৯৩২ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খবংপয্যা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রমেশচন্দ্র দেওয়ান ও মাতা চন্দ্রমুখী দেওয়ান। পিতামাতার চার পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে তিনি একদিন বংশের নাম উজ্জ্বল করবেন। তাই তাঁর মা-বাবা তাঁকে আদর করে ডাকতেন কুলকুসুম (ধীমান খীসা)। বড় হয়ে তিনি তাই হয়েছেন। তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় খবংপয্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তৎসময়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। খবংপয্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণি পাশ করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম শিক্ষাবিদ, সংগ্রামী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব চিত্ত কিশোর চাকমা তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মহাপ্রুম এমই স্কুলে ছোটবেলায় ড. দেওয়ানকে নিয়ে আসেন এবং সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কর্ণধার মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার পিতা চিত্ত কিশোর চাকমা ছিলেন ড. আর এস দেওয়ানের আপন ভগ্নিপতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার আলো বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রে অগ্রণী পথিকৃৎ স্কুল ইন্সপেক্টর কৃষ্ণ কিশোর চাকমা ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতির বড়ভাই। কৃষ্ণ কিশোর চাকমা ও চিত্ত কিশোর চাকমা দুই ভাই পার্বত্যাঞ্চলের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার মশাল জ্বালানোর কাজ কার্যত সূচনা করেন এ মহাপুরম থেকে। তাই মহাপুরমকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার আলো বিস্তারের সুতিকাগার বললেও অত্যুক্তি হবে না। চিত্ত কিশোর চাকমা তৎসময়ে মহাপ্রুম মিডল ইংলিশ স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

মহাপ্রুম মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ড. দেওয়ান আবার সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর তিনি রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। তিনি সেসময় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন। সে সময় বিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের একসময়ের স্বনামধন্য প্রথিতযশা শিক্ষক নবীন কুমার ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি), বিশিষ্ট সমাজসেবক কংলাচাই চৌধুরী (খাগড়াছড়ি), মৃনাল কান্তি চাকমা (খবংপয্যা) ও ডা. সুব্রত চাকমা (রাঙ্গামাটি) প্রমুখ।

ছবি: ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের এপার্টমেন্টে প্রচারাভিযানের দলিলসহ তাঁর সাথে উষাতন তালুকদার

মেট্রিক পাশ করার পর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেই কলেজ থেকে ১৯৫৫-৫৬ সালে প্রথম ডিভিশনে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রাক্কালে তাঁর এক বন্ধু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ক্ষতি করার চেষ্টা করেন বলে তিনি জানান। পরীক্ষার ঠিক কয়েকদিন আগে ড. দেওয়ানের বাবা মারা গেছেন এই মর্মে টেলিগ্রাম এসেছে বলে তাঁর সেই বন্ধু তাঁকে মিথ্যা সংবাদ জানিয়ে দেন। ফলে পরীক্ষা না দিয়ে বাড়ি যাওয়াতে নির্ধারিত বছরে তাঁর পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। তার পরবর্তী বছরে তাঁর পরীক্ষা দিতে হয়েছে।

এরপর তিনি ঢাকাস্থ আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। উক্ত প্রতিষ্ঠানে দুই বছর পর্যন্ত পড়ার পর পাঠ্য বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হতে না পারায় কোর্স সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে ১৯৫৭ সালে তিনি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া ছেড়ে দেন। ঐ বছরই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান UTAH Company-তে চাকরি গ্রহণ করেন। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে উক্ত চাকরিতেও তিনি মন বসাতে পারেননি। বছর খানেক চাকরি করার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৫৮ সালে তিনি কেমিস্ট্রি অনার্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬১ সালে অনার্স এবং ১৯৬২ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তৎসময়ে তুখোড় ছাত্রনেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. দেওয়ানের সহপাঠি ছিলেন।

অধ্যয়ন শেষে ১৯৬৩-৬৪ সালে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা’র অধীনে চাকরি করেন। রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কারণে ছাত্রজীবন থেকে তাঁর উপর গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারি ছিল বলে জানা যায়। সেসময় ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার কাছে গোয়েন্দারা ড. আর এস দেওয়ানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র-বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে। ফলে এক পর্যায়ে ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা তাঁকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। এতে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। তিনি রাষ্ট্র-বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদাকে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে তিনি আদালতে যাওয়ার কথা বলেন। সেসময় জুম্ম ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন সরকারের পক্ষে ডিআইবি কাজে যুক্ত ছিলেন বলে তিনি জানান। তারাও তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ নিয়ে আসতে পারে বলে তিনি সন্দেহ করেন।

এ সময় তাঁর আনীত অভিযোগের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি ডিআইবি’র ডিরেক্টর (জাতিতে পাঞ্জাবী) এর সাথে দেখা করেন। ঐ কর্মকর্তা তাঁর সাথে খুবই রূঢ় ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। এমন আচরণ করেন যেন পারলে সেমুহূর্তে ড. দেওয়ানকে তিনি মেরে ফেলতেন এমন ভাব দেখান।

রাঙ্গামাটিতে লেখাপড়ার সময় থেকে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে তিনি জানান। চট্টগ্রামে পড়ার সময় তিনি জুম্ম (পাহাড়ি) স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। তাঁকে চিত্ত কিশোর চাকমা, চারু বিকাশ চাকমা, সুধাংশু শেখর চাকমা, সুরেশ্বর চাকমা, সলিল রায় সহ তাঁর অনেক শিক্ষক ও গুণগ্রাহী তাঁকে রাজনীতিতে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বলে তিনি জানান।

ড. দেওয়ান জানান, মহাপ্রুম মিডল ইংলিশ স্কুলের হেড মাস্টার চিত্ত কিশোর চাকমা তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন তাঁর একাধারে শিক্ষক ও ভগ্নিপতি। তিনিই ড. দেওয়ানকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেজন্য তাঁকে ভালভাবে লেখাপড়া করতে উৎসাহ যুগাতেন। সামন্ত ও বিজাতীয় শাসন-শোষণে জুম্ম জাতি নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য রাজনীতিতে যুক্ত হতে ড. দেওয়ানকে তিনি পরামর্শ দিতেন। ড. দেওয়ান মনস্থ করেন যে, আগে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করি। তারপর বিলেতে যাবো। সেখান থেকে কাজ করতে সুবিধা হবে। আন্তর্জাতিক প্রচারণার কাজ চালাতে সহজ হবে বলে তিনি পরিকল্পনা করেন।

তাঁর শিক্ষাগুরু চিত্ত কিশোর চাকমার কাছ থেকে ড. দেওয়ান এই শিক্ষালাভ করেছেন যে, দেশ-জাতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তাঁর জীবনে নানা ক্ষেত্রে তিনি এই শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে আলোকিত হয়েছেন বলে তিনি জানান। তিনি এই দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন যে, “জাতিকে সেবা করাই হলো একজন ব্যক্তির অন্যতম আসল কাজ”। মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহেরুসহ অনেক মনীষীর বই পড়ে তিনি রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং রাজনীতি করতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন।

চিত্ত কিশোর চাকমা তাঁকে আইন পড়তে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আইনের চেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার আগ্রহ বেশি ছিল তাঁর। সেজন্য তিনি অর্গানিক কেমেস্ট্রিতে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন। নব্বই দশকের দিকে যখন তিনি ভারতে যান, তখন তিনি তাঁর শিক্ষাগুরু চিত্ত কিশোর চাকমাকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সর্বশেষ একটি চিঠি লিখেন এবং অবহিত করেন, তাঁর উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি জাতির জন্য কাজ করে চলেছেন।

কেমেস্ট্রিতে এমফিল করার জন্য তিনি ১৯৬৭ সালের ৩ নভেম্বর বিলেতে পাড়ি জমান। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কুইন্স এলিজাবেথ কলেজে তিনি এমফিল শুরু করেন। পড়াশুনার খরচ যোগানোর জন্য তিনি Bush Boake Allen নামক একটি কোম্পানীতে চাকরি নেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত Lt. Col. Henry B Heath নামক ব্যক্তি তাঁকে সেই চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। উক্ত সেনা কর্মকর্তা তখন ঐ কোম্পানীর ম্যানেজার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উক্ত সেনা কর্মকতা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে নিয়োজিত ছিলেন। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের Member of British Empower উপাধি লাভ করেন।

ড. দেওয়ান স্মরণ করেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর ভাই বিনোদ লাল দেওয়ান, তাঁর ভগ্নিপতি খগেন্দ্র লাল চাকমা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের পর বিনোদ লাল দেওয়ানকে বার্মা সার্ভিসে চাকরি প্রদান করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জুম্মরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে অনেক সহায়তা করেছিল। খাদ্য, গোলা-বারুদ, নানা জিনিসপত্র বহনের জন্য তৎসময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী জুম্মদের সহায়তা নিয়েছিল। ড. দেওয়ান জানান যে, একজন ব্যক্তির ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ২৫ কেজি ওজনের জিনিস দৈনিক ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বহন করতে হতো। ড. দেওয়ানকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে পরিচয় পাওয়ার পর Lt. Col. Henry B Heath জুম্মদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ড. দেওয়ানের জন্য Bush Boake Allen নামক কোম্পানীতে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। তিনি ঐ কোম্পানীতে ছয় বছর চাকরি করেন।

ড. দেওয়ান কুইন্স এলিজাবেথ কলেজে Dr. Terry A. Rohan-এর অধীনে ১৯৬৮ সালে এমফিলে ভর্তি হন। এমফিল করতে তাঁর চার বছর লাগে। এমফিল করার সময় তিনি জুম্মদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। সেসময় ১৯৭৪ সালে সরকারের পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েল্থ সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে লন্ডন সফর করলে তৎকালীন জাতীয় সংসদ সমস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর সাথে যোগাযোগ করেন এবং ড. দেওয়ানকে জুম্ম জনগণের আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন চালানোর আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আন্দোলনের কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।

ছবি: এপার্টমেন্টের প্রাঙ্গণে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে (বাম থেকে) মঙ্গল কুমার চাকমা, উষাতন তালুকদার ও প্রবীর শংকর চাকমা

এমফিল শেষ করে ১৯৭৫ সালে Salford University-তে পিএইচডি শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি জোর কদমে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের পক্ষে ক্লান্তিহীন প্রচারাভিযান চালাতে থাকেন। Bush Boake Allen কোম্পানীতে চাকরি করার সময় জমাকৃত টাকা দিয়ে একদিকে তিনি পিএইচডি’র পড়াশুনার খরচ, অন্যদিকে ক্যাম্পেইনের খরচ চালাতে থাকেন। একাধারে পিএইচডি’র জন্য নিবিড় পড়াশুনা এবং ক্যাম্পেইনের জন্য দিন-রাত কাজ করার ফলে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে বলে তিনি জানান। অপরপক্ষে জমানো টাকাও প্রায় শেষ হয়ে আসে। ক্যাম্পেইনের অত্যাধিক কাজের চাপে তাঁর পিএইচডি পড়াশুনাও বিঘ্নিত হওয়ার উপক্রম হতে থাকে।

এমতাবস্থায় তাঁর অধ্যাপক যাঁর অধীনে তিনি Salford University-তে পিএইচডি করছিলেন তিনি আর এস দেওয়ানকে পিএইচডি’র গবেষণাপত্র (থেসিস) জমা দিয়ে তাড়াতাড়ি পিএইচডি কোর্স শেষ করতে পরামর্শ দেন। আর্থিক অনটনের কথা জানার পর তাঁর সেই অধ্যাপক মহোদয় ব্রিটিশ সরকারের সামাজিক সুরক্ষা ভাতার (Social Benefit) জন্য আবেদন করতেও আর এস দেওয়ানকে পরামর্শ প্রদান করেন। সেই অধ্যাপকের পরামর্শ মোতাবেক ড. দেওয়ান তাঁর গবেষণাপত্র দ্রুত শেষ করে জমা দেন এবং ১৯৮০ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণাপত্রের মূল কাজ ছিল আদা, এলাচি ইত্যাদির Perfume and Flavour-এর উপর। অন্যদিকে তাঁর আবেদন মূলে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সামাজিক সুরক্ষা ভাতা মঞ্জুর করে। সেসময় তিনি সপ্তাহে ৬ পাউন্ড সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পেতেন। বর্তমানে তিনি সপ্তাহে ১৩৮ পাউন্ড ভাতা লাভ করে থাকেন বলে তিনি জানান।

সেসময় সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পাওয়ার পর তিনি পরিমিত খাদ্য কিনে খেতে পারতেন। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর স্বাস্থ্য উন্নতি হতে থাকে। এর আগে অর্থের অভাবে তিনি দুধ কিনতে পারতেন না। কেবল রুটি খেয়ে আধা পেটা অবস্থায় থাকতে হতো। তিনি জীবনে ধুমপান করেন না। পাশ্চাত্য জীবনে থেকেও তিনি কখনোই মদ পান করেন না। সিনেমা দেখেন না। কৃচ্ছ্রতা সাধন করে পরিমিত খরচে তাঁর জীবন নির্বাহ করতে হয় বলে তিনি জানান।

তিনি সেসময় আন্তর্জাতিক স্তরে আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালানোর লক্ষে একটি তহবিল গঠনের জন্য প্রবাসী জুম্মদের প্রতি আহ্বান জানান। দু’একজন ছাড়া অধিকাংশ প্রবাসী জুম্ম এগিয়ে আসেননি। সবাই নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে তিনি জানান। নাম প্রকাশ না করে ড. দেওয়ান বলেন যে, এমনকি জনৈক ব্যক্তি তাঁকে এই ক্যাম্পেইনের কাজ ছেড়ে দিতে বলেন এবং চাকরি করতে পরামর্শ প্রদান করেন। সেসময় আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের জন্য বছরে ২৫০০ থেকে ৩০০০ পাউন্ড প্রয়োজন হতো। সেই সামান্য টাকাও প্রবাসী জুম্মরা দিতে কুণ্ঠাবোধ করতো বলে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন যৎসামান্য হলেও ক্যাম্পেইনের খরচ যোগার করতে দু’একজন জুম্ম এগিয়ে এসেছিলেন। বস্তুত ব্রিটিশ সরকারই পরোক্ষভাবে তাঁকে ক্যাম্পেইনের খরচ যুগিয়েছিলেন বলে ব্রিটিশ জনগণের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে যে সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পেতেন তা থেকে বাঁচিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইনের খরচ যুগিয়ে চলেছেন বলে তিনি জানান।

আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইনের ক্ষেত্রে তিনি লন্ডনের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তা লাভ করেন। তিনি প্রথম পর্যায়ে যোগাযোগ করেন এন্টি-স্লেভারী সোসাইটি (Anti-Slavery Society)-এর সাথে। সেসময় এ সংগঠনের Mr. Peter Devis নামে একজন মানবাধিকার কর্মী তাঁকে বিশেষভাবে সহায়তা করেন। এছাড়া Quaker Peace Service (QPS) নামে একটি সংগঠনের নাম তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তাঁর অনুরোধে লন্ডনস্থ QPS অফিসে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রচারণার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন বলে তিনি জানান। প্রচারণার অংশ হিসেবে জুম্মদের মধ্যে তিনিই প্রথম ১৯৮৪ সালে জেনেভাস্থ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনারের সদর দপ্তরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি Sub-Commission on the Prevention of Discrimination and Protection of Minorities এর অধীন Working Group on Indigenous Populations (WGIP)-এর অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর ভাষণ প্রদান করেন। সেসময় শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাথেরোও উক্ত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন বলে তিনি জানান।

ছবি: ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে (বাম থেকে) উষাতন তালুকদার, সুব্রত চাকমা ও প্রবীর শংকর চাকমা

তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লর্ডসভার সদস্য Lord Avebury-এর কাছে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতেন। লর্ড এভেবুরিও তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রচারণার কাজ চালাতেন। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে তাঁর সাথে যোগাযোগ থাকলেও ৭/৮ বছর (সম্ভবত ২০০৮/২০০৯ সালের দিকে) আগে লর্ড এভেবুরির সাথে তাঁর প্রথম ও শেষ বার দেখা হয় বলে তিনি জানান।

সত্তর ও আশি দশকের দিকে প্রাথমিক অবস্থায় যখন তিনি আন্তর্জাতিক প্রচারণার কাজে নেমে পড়েন এবং ব্রিটিশ সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন তখন ব্রিটিশ সরকারের অনেকে তাঁর পরিচয় জানতে চাইতেন বা পরিচয়পত্র (Accreditation) দেখাতে বলতেন। পরে জনসংহতি সমিতি তাঁকে সমিতির মুখপাত্র (Spokesman) হিসেবে পরিচয়পত্র প্রদান করে। এই পরিচয়পত্র পাওয়ার ফলে তাঁর পক্ষে ব্রিটিশ সরকারসহ ইউরোপে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা সহজ ও সুবিধা হয়েছে বলে তিনি জানান। এজন্য তিনি জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের প্রতি, বিশেষ করে জনসংহতি সমিতির বর্তমান সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। আন্তর্র্জাতিক প্রচারণার ক্ষেত্রে শ্রী লারমা থেকে তিনি নানা উপায়ে নিয়মিত নির্দেশনা পেতেন বলে জানান।

তিনি জানান, যদিও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল, কিন্তু আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে সেই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলের যে উদ্ভিদ ভান্ডার রয়েছে সেসব উদ্ভিজ্জ প্রাণের উপর তাঁর গবেষণা করার প্রবল আগ্রহ ছিল। তারই অংশ হিসেবে তাঁর পিএইচডি থেসিসও নিয়েছিলেন আদা, এলাচি ইত্যাদির Perfume and Flavour-এর উপর। তিনি নিজেকে নবিশ বিজ্ঞানী হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন। তিনি কাঁচা পিয়াজের Flavour-এর উপর পেটেন্ট করেন বলে জানান। তাঁর গবেষণায় পিয়াজের Flavour-কে তিনি আলাদা করতে সক্ষম হন বলে জানান।

রসায়নের (কেমেস্ট্রি) প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মানোর পেছনে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, তাঁর এক নিকট আত্মীয় বসুন্ধরা দেওয়ান ছোটবেলায় খাগড়াছড়ি স্কুলে পড়ার সময় হাঁটু ব্যাথায় ভোগেন। ব্যাথায় তিনি হাঁটতেও পারেন না। ফলে তাঁর স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ সময় বসুন্ধরা দেওয়ানের মা (বিনেত্রা মা) তাঁর মেয়ের হাঁটু ব্যাথার চিকিৎসার জন্য একজন বৈদ্য নিয়ে আসেন। ঐ বৈদ্য একটি গাছের শেকড় দেন। ঐ গাছের শেকড় ব্যবহার করে বসুন্ধরা দেওয়ানের হাঁটুর ব্যাথা সম্পূর্ণভাবে আরোগ্য হয়। ঐ গাছের শেকড় ছিল বরনা গাছের। এ থেকে ড. দেওয়ানের ধারণা হয় যে, জঙ্গলের গাছ-গাছালিতে প্রচুর ঔষধি গুণ রয়েছে যা অনাবিস্কৃত রয়েছে। এগুলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে গবেষণা করা গেলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কাজে লাগানো যায় বলে তিনি ভাবতেন। এ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি রসায়ন বিষয়ে লেখাপড়ার আগ্রহী হয়ে উঠেন বলে তিনি জানান।

ক্যাম্পেইনের জন্য তিনি এখনো নিয়মিত লাইব্রেরীতে যান। পত্রপত্রিকা পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য নেয়ার ও জানার চেষ্টা করেন। তার ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি করে এখনো নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান।

ছবি: ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান

কৃচ্ছ্রতা সাধনের অংশ হিসেবে তাঁর ঘর থেকে ড. দেওয়ান বৈদ্যুতিক সংযোগও বিচ্ছিন্ন করেছেন। বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বাঁচিয়ে উক্ত টাকা তিনি ক্যাম্পেইনের জন্য ব্যয় করেন বলে জানান। শীত প্রধান দেশে বিদ্যুৎ ছাড়া, হিটার বিহীন অবস্থায় কিভাবে জীবন কাটান বলে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান যে, জনসংহতি সমিতির সদস্যরা তীব্র শীতে রাত-বিরাতে জঙ্গলে ছড়াছড়িতে যদি থাকতে পারে ও যাতায়াত করতে পারে, তাহলে তিনি বিদ্যুৎ ও হিটার ছাড়া ঘরের মধ্যে থাকতে পারবেন না কেন, সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবেন না কেন এমন উল্টো প্রশ্ন করেছিলেন। বুক আর মাথা গরম রাখলে শীত সহ্য করা যায় বা শীত থেকে বাঁচা যায় বলে তিনি জানান। তাই তিনি মাথায় গরম উলের টুপি এবং শরীরে একসাথে গরম কাপড়ের গেঞ্জি, শার্ট, সুয়েটার, জেকেট ও ওভারকোট পরে থাকেন। বেশি শীত করলে তিনি লাইবেব্রী যান বলে জানান।

তিনি খুবই সজ্জন ও পরোপকারী ব্যক্তি। সরকারের ভাতা থেকে টাকা বাঁচিয়ে কেবল আন্তর্জাতিক প্রচারণার কাজে ব্যয় করেন না, তিনি আত্মীয়-স্বজন ও দু:স্থ মানুষের আপদে-বিপদেও সাহায্য দিয়ে থাকেন। সামাজিক উদ্যোগে তিনি সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন। প্যারিসে জুম্মরা একটি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপনের উদ্যোগ নিলে সেখানেও তিনি একটা বড় অংকের অর্থ দান করেছেন করে জানা গেছে।

তিনি ঘরে রান্না-বান্না করেন না। রুটি, কাঁচা শাক-সবজি, ফল-মূল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন। কাঁচা শাক-সবজি, ফল-মূল স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে জানান। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, রান্না না করে কাঁচা খেলে তার খাদ্যগুণ নষ্ট হয় না এবং স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তিনি মসুর ডাল রান্না না করে পানিতে ভিজিয়ে কাঁচা খেয়ে থাকেন। এটা স্বাস্থ্যসম্মত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, পাকা কলা বাকলসহ খেলে স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকার হয়। পাকা কলার বাকল খেলে Bowel দূরীভূত হয়। Bowel দূরীভূত হলে ক্যানসার হতে পারে না। Bowel শরীরে ক্যানসার বাসা বাঁধতে সহায়তা করে বলে তিনি জানান। তাঁর জীবনে তিনি এভাবে কাঁচা খেয়ে সুস্থ ও নিরোগ জীবনযাপন করছেন বলে দাবি করেন। আর টাকার অভাবে মাছ-মাংস খাওয়ার সুযোগ নেই বলে তিনি জানান। তার বদলে তিনি নিয়মিত বাদাম খান বেশি করে। পশু-পাখির জন্য যে বাদাম তা খুবই সস্তা এবং তাতে প্রোটিন ও প্রচুর খাদ্যগুণ রয়েছে। তাই তিনি পশু-পাখির জন্য যে বাদাম বিক্রি করা হয় সেই বাদাম কিনে খান। এতে তাঁর শরীরে শক্তি বাড়ে, তাঁর স্বাস্থ্য ভাল থাকে, অসুখ-বিসুখ হয় না বলে তিনি জানান।

তিনি এখনো আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে ৩০০ জনকে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠান, চিঠি লেখেন। ম্যানুয়েল টাইপ রাইটার-এ টাইপ করে পোস্টে তিনি সেসব রিপোর্ট পাঠিয়ে থাকেন। সরকারের বরাদ্দকৃত এপার্টমেন্টের দু’টি কামরা ও একটি কিসেন রয়েছে। ঐ দু’টি কামরা তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইনের দলিলপত্রাদিতে ঠাসা। যেহেতু তাঁর কোন আলমারী ও বইয়ের তাক নেই তাই এসব দলিলপত্রাদি তিনি অত্যন্ত যত্নের সাথে মেঝেতে সুবিন্যস্তভাবে সাজিয়ে রেখেছেন। ব্রিটিশ সরকার থেকে পাওয়া সামাজিক সুরক্ষা ভাতা থেকে টাকা বাঁচিয়ে ক্যাম্পেইনের জন্য তিনি খরচ করেন। টাকা বাঁচানোর জন্য নিজেই নিজের চুল কাটেন। নিজের কাপড় নিজে ধুয়ে থাকেন, সেলাই করে থাকেন। তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্ট তৈরি করার জন্য নিয়মিত লাইব্রেরীতে যান। টাইপ করে রিপোর্ট তৈরির জন্য তাঁর অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়। একাই তাঁর পক্ষে সব কাজ করে যেতে হয়। কেউ নেই যিনি তাঁকে সেই কাজে সাহায্য করবে। তাই তাঁর সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে সময় অতিবাহিত হয়ে যায় বলে তিনি জানান। আশির কোটায় ধাক্কা দেয়া এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি এখনো এক টগবগে তরুণের মতো ক্লান্তিহীন প্রত্যয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের জন্য নিরবে কাজ করে চলেছেন।

জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে দেখা করতে যাওয়ায় তিনি অত্যন্ত খুশী হন এবং বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রতিনিধিদলকে পেয়ে তিনি একেবারেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপোষহীন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। জনসংহতি সমিতির আন্দোলন সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। জুম্ম জনগণের ঐক্য-সংহতি অটুট রাখতে পারলে এবং সবাই একসাথে কাজ করতে পারলে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অধিকার অর্জিত হবেই হবে বলে তিনি দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন। তাঁর ঘরে গচ্ছিত আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচারাভিয়ান সংক্রান্ত দলিলপত্রাদি তিনি জনসংহতি সমিতির নিকট দিয়ে যাবেন বলে জানান। ঐসব দলিলপত্রাদি দিয়ে একটি ‘জুম্ম ন্যাশনাল লাইব্রেরী ও মিউজিয়াম’ স্থাপন করার স্বপ্ন রয়েছে তাঁর। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিনি জনসংহতি সমিতিকে আহ্বান জানান।