আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার বঞ্চনার ২০ বছর

0
826

নিপন ত্রিপুরা

‘চেঙ্গী নদীর কান্না, ভীমপুরে মিশে গেলো আলফ্রেড সরেনের তাজা রক্তে’- মাদলের এ গানটা যখন শুনি তখন ভূমিদস্যুদের হাতে নিহত হাওয়া শহীদ আলফ্রেড সরেনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তার আপোষহীন দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের কথা। ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা। আজ তার ২০তম শহীদ দিবস।

২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ঘড়ির কাটায় সকাল ১১:০০ টায় ভূমিদস্যু হাতেম ও গদাই লস্কর তার দেড়শতাধিক ভাড়াটিয়া খুনি বাহিনী নিয়ে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর গ্রামের ১৩টি আদিবাসী পরিবারের উপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তান্ডবলীলা চালায় তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। অতর্কিত এই আক্রমণে আদিবাসীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। খুনিরা চিৎকার করে খুজতে থাকে আলফ্রেড সরেনকে। একেরপর এক বাড়ী আগুনে জ্বালিয়ে দিতে দিতে অগ্রসর হয় খুনিরা। সামনে যাকে পায় তার উপর চলে পৈশাচিক নির্যাতন। শিশুদের হাত পা ধরে পুকুরে ছুড়ে মারা হয়। আদিবাসী পরিষদের নেতা বৃদ্ধ জগন্নাথ সরেন ও যতীন সরেন নামে ৩০ বছরের এক যুবককে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। আলফ্রেড সরেনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী পানসিরির পেটে লাথি দেওয়ার ফলে তার গর্ভচ্যুতি ঘটে।

চারিদেকে যখন আদিবাসীদের আত্ম-চিৎকার আর আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে, তখন খুনিরা উন্মত্ত খুনের নেশায় আলফ্রেড সরেনকে খুঁজছিল। আলফ্রেড সরেনের বোন রেবেকা সরেন ভাইকে নিয়ে বাঁচার জন্য পাশের বাড়ীর ভিতরে ধানের বস্তার ফাঁকে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরেও আগুন ধরিয়ে দেয় খুনিরা। আগুনের উত্তাপে টিকতে না পেরে রেবেকা সরেন ঘরের জানালা ভেঙ্গে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই খুনিরা আলফ্রেড সরেনকে ধরে ফেলে। রামদা, কুড়াল, বল্লম দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। এক পর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আলফ্রেড সরেন। আহত অবস্থায় খুনিদের কাছে হাত পা কেটে ফেললেও প্রাণে মেরে না ফেলার আকুতি জানালেও খুনীরা সে কথা শুনেনি। বরং খুনীরা উপর্যপুরি বর্শার ফালা দিয়ে আলফ্রেড সরেনের উপর আঘাত হানে। তারপর আরফ্রেড মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বোন রেবেকা সরেন মাত্র ৫০ গজ দুরে দাঁড়িয়ে থেকে ভাইয়ের মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি।

সেসময় আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে ছাই হয়ে যায় ভীমপুরের আদিবাসী পল্লীর ১৩টি পরিবার। ৩০/৩৫ জন আদিবাসী মারাত্মকভাবে আহত হয়। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা ব্যাপী এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে। দীর্ঘ সময় ব্যাপী এই নারকীয় তান্ডব চললেও পুলিশ নিরব ও নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

উল্লেখ্য, ভীমপুর গ্রাম ও মৌজার ১৬৬ ও ১৬৮ দাগের এক একর জমির উপর তখন যে ১৩টি আদিবাসী সাঁন্তাল পরিবার বসবাস করত। তার থেকে কিছু দুরে ৯০/৯৫ বিঘা খাস জমি ছিল। সেই জমি দরিদ্র আদিবাসী ও এলাকার ভূমিহীনদের কাছে বন্দোবস্ত দেবার জন্য আলফ্রেড সরেন এলাকার ভূমিহীন ও আদিবাসীদের সংগঠিত করে তাদের মাঝে বিতরণ করতে চেয়েছিল। এতে ভূমিদস্যু হাতেম গদাই গং ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী আলফ্রেড সরেনকে নির্মমভাবে খুন করে। যে দিন আলফ্রেডকে হত্যা করা হয় সেই দিন স্থানীয় নওহাটা মোড়ে ভূমিহীনদের সমাবেশ হবার কথা ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সমাবেশের মঞ্চ তৈরীর কাজ দেখাশুনা করে ১০টা ৩০ মিনিটের দিয়ে বাড়ীতে গিয়ে দুপুরে আহারের পর পরই এই ঘটনা ঘটে।

আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দু’টি মামলা করেন। মামলায় মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারও করে। ওই সময় নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। মামলার প্রধান ২ আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাইসহ ৬০ জনের অধিক আসামি জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। ওই সুযোগে আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। উচ্চ আদালতে রিট পিটিশননম্বর ২৩২২/২০০১ এবং সিভিল পিটিশন নম্বর ৪২০/২০০৩। আসামিরা বর্তমানে এলাকায় অবস্থান করছেন। উচ্চ আদালতে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে।

এদিকে আসামিরা জামিনে বের হয়ে বিভিন্ন সময় আলফ্রেড সরেনের পরিবার ও সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে অনেক আদিবাসী সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে ও দেশত্যাগ করেছে। এমনকি নিহত আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী-সন্তান এখন আর সেখানে থাকেন না।

আলফ্রেড সরেন হত্যার আজ ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত হত্যাকা-ের কোন বিচার হয়নি। যে জমিকে কেন্দ্র করে আলফ্রেড সরেনকে জীবন দিতে হয়েছে, সেই জমির বেশিরভাগ এখন খুনিদের দখলে। নওগাঁ জেলা ও দায়রা আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হলেও ওই ৯৫ একর খাসজমির মধ্যে ৬৩ বিঘা আলফ্রেড সরেন ও গংয়ের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেন। কিন্তু ভূমিদস্যুদের পক্ষ হয়ে মহাদেবপুর থানা পুলিশ প্রশাসন আলফ্রেড সরেনের বোন রেবেকা সরেনের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে নামমাত্র ৩০ বিঘা জমি আদিবাসীদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়। বর্তমানে আদিবাসীরা সেখানকার ৩০ বিঘা জমি ভোগদখল করছে।

আলফ্রেড সরেনের সংগ্রাম ছিল ভূমিহীন ও আদিবাসী মানুষের অধিকার আদায়ের। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার আন্দোলনে আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগ আদিবাসীদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। আজকের এই দিনে আলফ্রেড সরেনকে স্মরণ করছি বিনম্র ভালবাসা এবং শ্রদ্ধায়। আদিবাসীদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার চলমান সংগ্রামে আলফ্রেড সরেন বেঁচে থাকবেন অগ্নি মশাল হয়ে।