৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস: স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ অর্জনে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত কর

0
644

হিল ভয়েস, ৮ মার্চ ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক:আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সভ্যতার অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে নারী ও পুরুষের সমান অবদান অনস্বীকার্য। নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের একক অংশগ্রহণে সমাজের উন্নয়নের কথা কল্পনা করা যায় না। সমাজে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সকল ক্ষেত্রে নারীর উপর চলমান বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামসহ সমাজ অগ্রগতির আন্দোলনে ৮ মার্চ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।

১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্বের সংগ্রামী ও সমাজতান্ত্রিক নারীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারেই ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদযাপনের সূত্রপাত ঘটে। মূলত ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে কাজের অমানবিক অবস্থা ও বৈষম্যমূলক মজুরীর প্রতিবাদে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের স্মরণে এই দিবসটিকে বেছে নেওয়া হয়।

জাতিসংঘ এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারন করেছে- GENDER EQUALITY TODAY FOR SUSTAINABLE TOMORROW যা বাংলায় “স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ অর্জনে শর্ত লিঙ্গ সমতা”। লিঙ্গ সমতা ব্যতীত সমমর্যাদা ও সমঅধিকার ভিত্তিক একটা সমাজ যেমন বিনির্মাণ করা যায় না, তেমনি নারীর উপর রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, জাতিগত-সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, নিপীড়ন ও বঞ্চনা জিইয়ে রেখে কোন দেশে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণ সম্ভব হতে পারে না।

সমাজে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী জুম্ম নারী সমাজও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল হয়েছে। এলক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার উদ্যোগে অগ্রনী জুম্ম নারী সদস্যদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি গঠন করা হয়। গঠনের পর পরই ১৯৭৬ সালে মহিলা সমিতির ৩৫ জন সদস্য সশস্ত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। জুম্ম নারীদের ইতিহাসে এটাই প্রথম সামরিক প্রশিক্ষণ।

জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ গড়ে উঠে হিল উইমেন্স ফেডারেশন নামে জুম্ম ছাত্রীদের একটি লড়াকু রাজনৈতিক সংগঠন। এরপর ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল যোগ দিয়ে জুম্ম নারীদের অবস্থার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন। জুম্ম  নারীরা জাতিসংঘের নারী বিষয়ক কমিশন, আদিবাসী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ, স্থায়ী ফোরাম ও বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থার অধিবেশনেও যোগ্যতার সাথে অংশগ্রহণ করে আসছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাহাড়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমার সাহসী ভূমিকা এবং সমতল অঞ্চলে বিপ্লবী আদিবাসী নারী নেত্রী হাজংমাতা রাশিমণি হাজং-এর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আদিবাসী নারী মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রেরণার এক অনন্য উৎস।

অতীতের তুলনায় সাম্প্রতিক কালে জুম্ম নারী সমাজের অগ্রগতি কিছুটা হলেও লক্ষ্যণীয়। প্রশংসিতভাবে বলা যায় বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলে অবস্থান করে নিয়েছে আদিবাসী নারীরা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নারীদের ক্যাম্পে ২৭ জেলার ৭০ জন ফুটবলার রয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জন এসেছেন আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে। এর মধ্যে আছেন মারমা ৫ জন, চাকমা ৩ জন, সাঁওতাল ২ জন,এবং গারো ২ জন।

অতীতের তুলনায় সাম্প্রতিক কালে জুম্ম নারী সমাজের অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও এখনও সার্বিকভাবে তারা পারিবারিক, সামাজিকও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে যেমনি মুক্ত নয়, তেমনি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও অবহেলার কারণে তারা তীব্রভাবে জাতিগত নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতারও শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ২০২১ সালে সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ১৫ জুম্ম নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে বাক প্রতিবন্ধী ২ জনসহ ৪ জন ধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয় ১০ জন,হয়রানির শিকার ৪ জন, অপহরন ২ জন, মারধরের শিকার ২ জন এবং হত্যার চেষ্টার শিকার হয় ১ জন নারী।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জাতির উপর যে জাতিগত নিপীড়ন ও সহিংসতা, তা থেকে জুম্ম নারী সমাজ আজো মুক্তিলাভ করেনি। তার অন্যতম কারণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া। জুম্ম নারীর নিরাপত্তা, সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। তাই আসুন, সমাজে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি, এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলি।