সাজেকে সড়ক ও ক্যাম্প নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের আকুতি: ‘উন্নয়ন নয়, আগে বাঁচতে হবে’

0
914
ছবি: সাজেক এলাকাবাসীর মানববন্ধন

হিল ভয়েস, ৩০ এপ্রিল ২০২১, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক এলাকার আদিবাসী জুম্ম জনগণ বাঁচার আকুতি এবং ভূমি বেদখল বন্ধ করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, উন্নয়ন নয়, আগে বাঁচতে হবে। তারা আরো বলেছেন, আমার ভূমি আমার মা, কেড়ে নিতে দেবো না; আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।

গত ২৮ এপ্রিল ২০২১ বিকাল আনুমানিক ৪:০০ টার দিকে সাজেকের কমলাক, তালছড়া ও ছৈনালছড়া এলাকাবাসী জুম্ম জনগণ এক মানববন্ধন আয়োজন করে এসব দাবি ও মতামত উত্থাপন করেন। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী জুম্মরা স্থানীয় জুম্মদের ভূমি জোরপূর্বক বেদখল করে বিজিবি ও সেনা ক্যাম্প স্থাপন এবং সাজেক সড়ক নির্মাণের বিরোধীতা করেন এবং প্রতিবাদ জানান।

মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী গ্রামবাসীরা অতি সম্প্রতি কমলাক এলাকায় জুম্মদের জুম চাষে বাধা দিয়ে ও তাদের জুম ভূমি বেদখল করে এবং জুম্মদের সেগুন বাগান ও ফলজ বাগান ধ্বংস করে সেনাবাহিনীর ইসিবি (ইঞ্জিনিয়ার্স কন্সট্রাকশন ব্যাটিলিয়ন) সড়ক নির্মাণ এবং বিজিবি নতুন ক্যাম্প স্থাপন করছে বলে অভিযোগ করেন। জানা গেছে, সেখানে ৬ পরিবার জুম্মর প্রায় ২০ একর পরিমাণ ভূমি বেদখল করে সড়ক ও বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলি হল- (১) বৃষ চাকমা (৪০), পিতা-বীরসেন চকমা; (২) ডালিম কুমার চাকমা (৩৩), পিতা-প্রতি রঞ্জন চাকমা; (৩) নীল কুমার চাকমা (৫৫), পিতা-ধর্মধন চাকমা; (৪) লক্ষী কুমার চাকমা (৩৭), পিতা-কালাচোগা চাকমা; (৫) রাজ্যমনি চাকমা (৩৩), পিতা-বরুণ কুমার চাকমা ও (৬) শুক্র চাকমা (৩৫), পিতা-ললিত মোহন চাকমা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি শিজকছড়া থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা উদয়পুর পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করছে। এছাড়া উদয়পুর থেকে উত্তরে ১০ কিলোমিটার এবং দক্ষিণে ১০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণাধীন রয়েছে। উদয়পুরের দক্ষিণে কমলাক পাড়া এবং তালছড়া গ্রামের অবস্থান। সেখানেই সেনাবাহিনী জুম্মদের ভূমি বেদখল করে সড়ক নির্মাণ করছে এবং একটি বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। আর এলাকার জুম্মদের জুমচাষে বাধা প্রদান করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এখন পাহাড় এলাকায় জুমচাষের মৌসুম শুরু হয়েছে।

কমলাক পাড়ার বাসিন্দা রাজ্যমনি চাকমা জানান, ‘এই এলাকার মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হচ্ছে জুম। এখন আমাদের জুমচাষে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং জুমভূমি বেদখল করা হচ্ছে। এখন আমরা কী খেয়ে বাঁচবো?’

জানা গেছে, কেবল সিজকছড়া হতে উদয়পুর পর্যন্ত ৫টি সেনা ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে জুম্মদের ভূমি বেদখল করে সিজকছড়া মুখ নামক স্থানে একটি এবং উদয়পুর এলাকায় একটি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এর পূর্বে সাজেক এলাকায় সেনাবাহিনী কর্তৃক ৩২ কিলোমিটার পরিমাণ সড়ক নির্মাণ করতে চারটি গ্রামের অন্তত ৬০ আদিবাসী জুম্ম পরিবারের ভূসম্পত্তি ও মূল্যবান বাগান-বাগিচা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্মাণাধীন উক্ত সাজেক-কমলাক সড়ক সংলগ্ন ক্ষতির সম্মুখীন এই চারটি গ্রাম হল- দাঁড়িপাড়া, ছয়নালপাড়া, বড় কমলাকপাড়া ও উদয়পুর।

ভুক্তভোগীদের সূত্রে জানা গেছে, এই চারটি গ্রামের ৬০ পরিবারের অন্তত ৪৩ একর ভূমি বেদখল করা হয় এবং সেখানে গড়ে তোলা দীর্ঘ দিনের সেগুন, কলা, আম, লিচু, সুপারি, ফুল ঝাড়ু ইত্যাদি বাগান ও হলুদ, তিল ইত্যাদি ক্ষেত ধ্বংস করে দেয়া হয়।
এমনকি সড়কের পাশে থাকা বেশকিছু জুম্ম গ্রামবাসীর বাড়িঘরও ভেঙে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বলাবাহুল্য, সেনাবাহিনী এতে শুধু জুম্মদের মূল্যবান ফলজ ও বনজ বাগান ধ্বংস করে দেয়নি, বড় বড় বুলডোজার ও ট্রাক্টর দিয়ে একরের পর এক প্রাকৃতিক বন ও পাহাড় ধ্বংস করে।

জানা গেছে, সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি ভারতের মিজোরামের সীমান্তবর্তী এই সাজেক-কমলাক সড়কটি নির্মাণ করছে যার প্রস্থ ৪০ ফুট করা হবে। মুলত জুম্মদের ভোগদখলীয় জায়গার উপর দিয়েই এই সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, স্থানীয় জুম্মরা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিকট এবিষয়ে অভিযোগ ও প্রতিবাদ করলেও সেনা কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। ক্ষতিপূরণের দাবি করলেও তা এড়িয়ে যায়।

উল্লেখ্য, স্থানীয় জুম্ম জনগণের অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে পদদলিত করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ জনমতকে উপেক্ষা করে, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে লংঘন করে সরকার ও প্রশাসন একতরফাভাবে সাজেক-কমলাক সীমান্ত সড়ক ও থেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গত ১০ মার্চ ২০২০ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ আসাদুজ্জামান খান কামাল সাজেকে গিয়ে এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন।

আরও উল্লেখ্য যে, শুরু থেকে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকারের কথা বিবেচনা করে এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বন্ধ রাখার পক্ষে মতামত প্রদান করে। তারা পার্বত্য জেলা পরিষদে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়টি নির্বাহী আদেশে হস্তান্তরিত ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিধানাবলী প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এবং আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ঠেগামুখ-কোয়ার্পুচ্ছয়া স্থলবন্দর উন্নয়ন এবং ঠেগামুখ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার লিখিত সুপারিশ পেশ করে। কিন্তু এরপরও সরকার ও সেনাবাহিনী এই সড়ক নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখে।

রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলাধীন ঠেগামুখে একটি স্থল বন্দর নির্মাণসহ প্রতিবেশী ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট-এর আওতায় বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনী এই সড়ক নির্মাণ করছে বলে জানা গেছে।