লংগদু সাম্প্রদায়িক হামলার ৫ বছর: বিচারকাজে অগ্রগতি নেই, অপরাধীরা শাস্তিহীন

0
624
ফাইল ফটো

হিল ভয়েস, ২ জুন ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ ভয়াবহ লংগদু সাম্প্রদায়িক হামলার ৫ বছর পূর্ণ হলো। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর পরবর্তী প্রায় ২০টির অধিক বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার অন্যতম একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। ২০১৭ সালের এই দিনে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন লংগদু উপজেলা সদরের তিনটিলা ও এর আশেপাশের একাধিক গ্রামে আদিবাসী জুম্মদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশের ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীন স্থানীয় আওয়ামীলীগ-যুবলীগের নেতৃত্বে সেটেলার বাঙালিরা এই হামলা চালায়। হামলায় লংগদু সদরের তিনটিলা, পার্শ্ববর্তী মানিকজোড় ছড়া ও বাত্যাপাড়া এলাকায় জুম্মদের অন্তত ২১৮টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত এবং ৮৮টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ও লুটপাটের শিকার হয়। সরকার পক্ষ কর্তৃক শেষ পর্যন্ত ভস্মীভূত বাড়ির সংখ্যা ২১২টি বলে স্বীকার করা হয়। তিনটিলা এলাকায় গুণমালা চাকমা নামে ৭৫ বছরের এক অশীতিপর বৃদ্ধ নারী পালিয়ে যেতে না পারার কারণে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়ে মারা যান। এছাড়া স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ২৫৬ জন ছাত্র-ছাত্রীর পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষা সামগ্রী, পোষাক পরিচ্ছদ অগ্নিসংযোগে পুড়ে যায়। জুম্মদের তালিকা অনুযায়ী বসত-বাড়ি ও সহায়-সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৪ কোটি টাকা।

হামলাকারী সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র ও মালামাল, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী লুট করে নিয়ে যায় এবং শুকরগুলো মেরে ফেলে দিয়ে যায়। পুড়ে যাওয়া তিনটিলা, মানিকজোড়ছড়া ও বাত্যা পাড়ার ২১২ পরিবারের কেউই কোনো সহায়-সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেনি এবং এক কাপড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে কোন রকমে জীবন রক্ষা করে। শুধু তাই নয়, এই হামলায় লংগদু উপজেলার আনুমানিক তিনটিলার ১৫০ পরিবার, মানিকজোড়ছড়ার ১৫০ পরিবার, বাত্যা পাড়ার ১২০ পরিবার, বড়াদমের ২০০ পরিবার, সোনাইয়ের ১০০ পরিবার, আটারকছড়ার ১০০ পরিবার, যাত্রামুড়ার ৫০ পরিবার ও মাজনপাড়ার ৫০ পরিবারসহ আনুমানিক প্রায় এক হাজার পরিবারের ৬,০০০ জুম্ম গ্রামবাসী ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী রণছড়া, বামে লংগদু, রাঙ্গাপানিছড়া, ভূইয়াছড়া, মানিক্যা কার্বারী পাড়া, দজর পাড়া, মধ্যছড়া, গধাবান্যাছড়া ইত্যাদি গ্রামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

ঘটনার সূত্রপাত:

১ জুন ২০১৭ দুপুর ১২:০০টায় খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের চার মাইল নামক স্থানে নুরুল ইসলাম নয়ন নামে ভাড়ায় চালিত একজন মোটর সাইকেল চালকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২ জুন সকালে পৌঁনে ৭:০০টার দিকে খাগড়াছড়ি থেকে লংগদু উপজেলাধীন বটতলী নামক গ্রামে তার লাশ নিয়ে আসা হলে দুইজন পাহাড়ি ভাড়া নিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে মর্মে অভিযোগ এনে সেটেলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াতে থাকে। ভোর থেকে মাইক যোগে জুম্মদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে নয়নকে হত্যার প্রতিবাদে আহুত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিতে সেটেলার বাঙালিদেরকে আহ্বান জানানো হয়। ফলে সদরের আশেপাশের এলাকাসহ গাদোছড়া, মাইনী, বগাচদর ইত্যাদি এলাকা থেকে গাড়ি ও বোট যোগে শত শত সেটেলার বাঙালি বাত্যা পাড়ায় সমবেত হয়।

এরপর সকাল ৯:৩০টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ছত্রছায়ায় লংগদু উপজেলার বাত্যা পাড়া থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে সেটেলার বাঙালিদের এক জঙ্গী সাম্প্রদায়িক মিছিল বের করা হয়। এই জঙ্গী সাম্প্রদায়িক মিছিলটি জুম্ম অধ্যুষিত এলাকার মধ্য দিয়ে আনুমানিক ১০:০০টার দিকে লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকার কাছাকাছি পৌঁছলে সেটেলার বাঙালিরা কোন উস্কানি ছাড়াই জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকান লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে এবং জুম্মদেরকে ধাওয়া করতে থাকে। এই হামলা চলে বেলা ২:০০ টা পর্যন্ত।

হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ:

সেটেলার বাঙালিদের মিছিলটি সকাল আনুমানিক ১০:০০টার দিকে লংগদু সদরের তিনটিলা এলাকায় পৌঁছলে সেটেলার বাঙালিরা কোন উস্কানি ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও হেডম্যান এসোসিয়েশনের মাল্টিপারপাস কমিউনিটি সেন্টারের অফিসসহ জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং জুম্মদের উপর হামলা করতে শুরু করে। এতে জুম্ম গ্রামবাসীরা প্রাণের ভয়ে মানিকজোড়ছড়া এলাকার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ হামলায় তিনটিলা এলাকায় ১০টি দোকানসহ জুম্মদের কমপক্ষে ৯৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়। সেটেলাররা প্রথমে জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানগুলো লুটপাট করে। তারপর পেট্রোল ও কেরোসিন ঢেলে দিয়ে একের পর এক অগ্নিসংযোগ করে থাকে। এমনকি এক ধরনের গ্যাসের বোতল থেকে স্প্রে করে ঘরবাড়ির চালে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বলে জানা গেছে। ফলে পাকা বা আধা পাকা ঘরবাড়িগুলোও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে দ্রুত পুড়ে যায়।

তিনটিলা এলাকায় অগ্নিসংযোগের সময় লংগদু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও লংগদু মৌজার হেডম্যান কুলিনমিত্র চাকমা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া গুণমালা চাকমা নামে ৭৫ বছরের একজন বৃদ্ধ নারী আগুনে পুড়ে মারা যায়। সেটেলার বাঙালিরা উক্ত বাড়িতে আগুন দিলে বার্ধক্যের কারণে গুণমালা চাকমা পালিয়ে যেতে পারেননি। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার আগে সেটেলাররা এই বৃদ্ধ মহিলাকেও নৃশংসভাবে মারধর করে আহত করে বলে জানা গেছে।

মিছিল শেষে লংগদু সদরের উপজেলা মাঠে সেটেলার বাঙালিদের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় একদিকে জুম্ম বিরোধী সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ চলতে থাকে, অন্যদিকে তিনটিলার জুম্ম ঘরবাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হতে থাকে। উক্ত প্রতিবাদ সমাবেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও সেটেলার বাঙালি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, লংগদু সেনা জোনের জোন কম্যান্ডার ও লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বক্তব্য প্রদান করেন।
এরপর সেটেলার বাঙালিরা পার্শ্ববর্তী মানিকজোড়ছড়া নামক জুম্ম গ্রামে হামলা করতে যায়। সেটেলার বাঙালিরা জুম্ম ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে গেলে প্রথমে জুম্ম গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। ফলে সেটেলার বাঙালিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিছু সময়ের জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। তখনো পর্যন্ত সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরাতে সক্ষম হয়নি। এমতাবস্থায় একদল সেনা সদস্য জুম্মদেরকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে আসে এবং জুম্মদেরকে গুলি করার হুমকি দিতে থাকে। ফলে জুম্মরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তখন সেটেলার বাঙালিরা নির্বিঘ্নে জুম্মদের ঘরবাড়ি লুটপাট করে এবং পেট্রোল ও কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এতে মানিকজোড়ছড়ায় ৫টি দোকানসহ কমপক্ষে ৮৮টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়।

বেলা ১২:০০টার দিকে জেলা প্রশাসন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ১২:০০টার পরেও ২:০০টা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর প্রহরায় সেটেলার বাঙালিরা বাত্যা পাড়ায় অগ্নিসংযোগ শুরু করে। এতে ৪টি দোকানসহ বাত্যা পাড়ায় ৪২টি ঘর পুড়ে যায় বলে জানা যায়। একপর্যায়ে বাত্যা পাড়া থেকে সেটেলাররা ফিরে এলে পার্শ্ববর্তী বড়াদম গ্রামের ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে।

সেনা ও পুলিশের ভূমিকা:

লাশ নিয়ে সেটেলারদের জঙ্গী মিছিল বের করার খবর জানাজানি হলে জনসংহতি সমিতির লংগদু থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক মণি শংকর চাকমাসহ স্থানীয় জুম্ম জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ সাম্প্রদায়িক হামলার একদিন আগে ১ জুন সন্ধ্যায় ২ ইবিআরের লংগদু সেনা জোন ও লংগদু থানা কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার কথা জানান এবং সেটেলার বাঙালিদেরকে লাশ নিয়ে মিছিল করার অনুমতি না দিতে অনুরোধ করেন। তারই প্রেক্ষিতে সেদিন রাত ৯:০০টার দিকে সেনা জোনের পক্ষ থেকে টুআইসি মেজর রফিক ও সুবেদার মেজর মো: রফিক নিজে এসে জুম্মদেরকে এই মর্মে আশ্বাস দেন যে, ‘মিছিল করা সেটেলারদের গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলটি করবে। মিছিলের সাথে সার্র্বক্ষণিকভাবে সেনা-পুলিশ থাকবে। কোন অঘটন ঘটতে দেয়া হবে না।’ তাই নিরাপত্তা নিয়ে জুম্মদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে জুম্মদেরকে তিনি আশ্বস্ত করেন। তারও আগে লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলামও একই সুরে জুম্মদেরকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এমনকি ২ জুন সকালে এসে সুবেদার মেজর মো: রফিক আবারও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে যান।

কিন্তু লংগদু সেনা জোনের জোন কম্যান্ডার লে: কর্ণেল আবদুল আলিম চৌধুরী পিএসসি, টুআইসি মেজর রফিক ও লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে সেনা-পুলিশের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও লাশ নিয়ে সেটেলার বাঙালিদের মিছিল উপজেলা সদরের তিনটিলা এলাকার কাট্টলতলায় পৌঁছার সাথে সাথে সেটেলাররা জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুট করতে শুরু করে এবং পেট্রোল ও কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। কর্তব্যরত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের লুটপাট ও অগ্নিসংযোগকারী সেটেলার বাঙালিদেরকে বাধা প্রদান করতে দেখা যায়নি। সেনা ও পুলিশ সদস্যরা এ সময় হামলাকারী কাউকে আটক করেনি।

অন্যদিকে জোন কম্যান্ডার লে: কর্ণেল আবদুল আলিম চৌধুরীর নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা মানিকজোড়ছড়ায় না গেলে সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে সক্ষম হতো না। সেনা সদস্যরা না পৌঁছা পর্যন্ত জুম্ম গ্রামবাসীরা সেটেলার বাঙালিদের প্রতিরোধ করেছিল। সেনা সদস্যরা পৌঁছার পর জুম্মদের গুলি করার হুমকি দিলে জুম্মরা মানিকজোড়ছড়া গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং সেনা-পুলিশের প্রহরায় সেটেলাররা অবাধে জুম্মদের ঘরাবাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর সেনা-পুলিশ প্রহরায় সেটেলার বাঙালিরা বাত্যা পাড়া ও বড়াদমে হামলা করতে যায়। এমনকি দুপুর ১২টায় ১৪৪ ধারা জারি করার পরও সেনা-পুলিশকে কোন ফাঁকা গুলি বা কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। সেটেলার বাঙালিদের নিবৃত্ত না করে বরঞ্চ তাদেরকে জুম্মদের হুমকি ও ধাওয়া করতে দেখা গেছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, সেনা ও পুলিশ সদস্যরাও হামলাকারীদের পক্ষাবলম্বন করে।

হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মূল হোতা:

সেই সময় হামলার ঘটনার জন্য মূল উস্কানিদাতা হিসেবে অভিযোগ ওঠে অন্যান্যদের মধ্যে বিশেষ করে লংগদু সেনা জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর রফিক ও ওয়ারেন্ট অফিসার মোঃ রফিকের বিরুদ্ধে। এছাড়া জনগণের পক্ষ থেকে ঘটনায় অংশগ্রহণকারী ও মূল হোতা হিসেবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তারা হলেন- (১) মো: সাইফুল ইসলাম (৫৫), তিনটিলা বাজার, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী; (২) খলিলুর রহমান খান (৪০), তিনটিল বাজার, বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী এবং সমঅধিকার আন্দোলনের লংগদু সভাপতি; (৩) মো: জুয়েল (৩৭), পীং-আবদুল হামিদ, বাত্যা পাড়া, যুবলীগ; (৪) আবদুল হালিম (৪০), তিনটিলা, বিএনপি; (৫) মোহাম্মদ এরশাদ (৩৫), পীং-আবদুল বারেক সরকার, গাদোছড়া, মাইনী, আওয়ামী লীগ; (৬) মো: শাহ আলম মুরাদ (৪২), তিনটিলা, বিএনপি; (৭) আবদুল সাত্তার (৩০), কাট্টলতলী, তিনটিলা, বিএনপি; (৮) মো: আবু (৩০), পীং-মোহাম্মদ আলী, বাত্যা পাড়া, আওয়ামীলীগ; (৯) মো: মোস্তফা, পীং-মোহাম্মদ আলী, বাত্যা পাড়া, আওয়ামীলীগ; (১০) ছোটন দাশ, মাইনী, আওয়ামীলীগ; (১১) শামীম, পীং-তাজুল ইসলাম, বাত্যাপাড়া, আওয়ামীলীগ; (১২) মো: নজরুল ইসলাম, পীং-মাহবুব মেম্বার, বাত্যা পাড়া, আওয়ামীলীগ; (১৩) আলমগীর হোসেন মোনা, মোটর সাইকেল চালক সমিতির সভাপতি, ৯নং ওয়ার্ড, বগাচদর ইউনিয়ন, লংগদু; (১৪) মো: দেলোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, বাঙালি ছাত্র পরিষদ, জাল্যাপাড়া, বগাচদর ইউনিয়ন, লংগদু; (১৫) মেজর রফিক, টুআইসি, লংগদু সেনা জোন, ২ ইবিআর; (১৬) সুবেদার মেজর মো: রফিক, লংগদু সেনা জোন, ২ ইবিআর; (১৭) তোফাজ্জল হোসেন, লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি লংগদু শাখার সভাপতি; (১৮) এ্যাডভোকেট আবছার আলী, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের নেতা; (১৯) নাসির উদ্দীন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও জামায়াতে ইসলামীর লংগদু শাখার আমীর; (২০) শফিকুল ইসলাম, লংগদু যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক; (২১) সারোয়ার হোসেন মোল্লা, তথ্য প্রচার সম্পাদক, লংগদু আওয়ালীলীগ; (২২) ফারুক মেম্বার, আওয়ামী লীগ; (২৩) মো: কাইয়ুম, মেম্বার, মাইনীমুখ ইউপি, আওয়ামী লীগ; (২৪) মো: রাসেল, আওয়ামী লীগ; (২৫) মোছাম্মৎ আফরোজা তানিয়া ওরফে হাওয়া, সভাপতি, মহিলা লীগ, লংগদু প্রমুখ।

মামলা ও বিচার প্রক্রিয়া:

জুম্ম গ্রামে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের পক্ষ থেকে হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে লংগদু থানায় ৪টি মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু এগুলির মধ্যে ৩টি মামলা কেবল জিডি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে ৯ জুন ২০১৭ তিনটিলা গ্রামের কিশোর চাকমা কর্তৃক দায়েরকৃত মামলাটিই কেবল মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এতে ৯৮ জন হামলাকারীর নাম উল্লেখ পূর্বক ৩০০/৪০০ জন সেটেলার বাঙালির বিরুদ্ধে পাহাড়িদের বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া ২ জুন ২০১৭ বিকালে লংগদু থানার এসআই দুলাল হোসেন কর্তৃক ১৫ জনের নাম উল্লেখ পূর্বক অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনের বিরুদ্ধে লংগদু থানায় একটি পুলিশী মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে উক্ত উভয় মামলায় সর্বমোট ৩৪ জন সেটেলার বাঙালিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের কয়েক মাসের মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, এক পর্যায়ে পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ের সম্মতিতে সর্বশেষ সংশ্লিষ্ট মামলার চট্টগ্রাম সিআইডি কর্মকর্তা, লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান, লংগদু সেনা জোন কম্যান্ডার, লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহের সমঝোতা বৈঠকের মাধ্যমে ৩০ জন আসামীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু উক্ত সিদ্ধান্তও কার্যকর করা হয়নি। মামলায় উল্লিখিত আসামীর নাম বাদ দিয়ে মামলার তালিকা বহির্ভূত কিছু ব্যক্তির নাম আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত চূড়ান্ত চার্জশিট প্রদান করা হয়। তবে উক্ত চার্জশিটের বিপরীতে আদালতে বাদীপক্ষ হতে নারাজি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে মামলাটির কোনো অগ্রগতি নেই বলে খবর পাওয়া গেছে।

ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ:

ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের হিসাব অনুযায়ী সম্পূর্ণ ভস্মীভুত বাড়ির তালিকা ২১৮টি হলেও ঘটনার পর সরকারের রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন কর্তৃক ২১২টি পরিবারকে রেশন প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রতি পরিবারকে নগদ ৬ হাজার টাকা, ২ বান্ডিল ঢেউ টিন, ৩০ কেজি চাল ও ২টি করে কম্বল প্রদান করা হয়। সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ মাত্র ঐ একবারই ক্ষতিগ্রস্তদেরকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। তবে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নগদ ৫০০০ টাকা, ১টি লুঙ্গি, ১টি গামছা, তাতের পিনন-খাদি সেট, মশারী ১টি ও শিশুদের জন্য কিছু পোশাক-পরিচ্ছদ দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়া সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে পরিবার প্রতি ২৫,০০০ টাকা, ইউএনডিপি থেকে প্রতি পরিবারকে ২৫০ ইউএস ডলার এবং রেডত্রিসেন্ট সোসাইটি থেকে পরিবার প্রতি ১২,০০০ টাকা করে অর্থ সাহায্য দেয়া হয় বলে জানা যায়।

সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় সরকার কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৭৬ বাড়ি নির্মাণ করা হয়, এর মধ্যে একজন বাঙালির ঘরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জানা গেছে, অনেক জুম্ম পরিবারের একাধিক ঘর পুড়ে গেলেও তাদেরকে একটি করে ঘর ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। অনেক পরিবারের ক্ষতির তুলনায় সরকার প্রদত্ত ক্ষতিপূরণ অনেক কম হয়েছে বলে জানা যায়।

উপসংহার:

এই হামলার ঘটনাটি পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের উপর সংঘটিত অন্যতম জঘন্য সাম্প্রদায়িক হামলা এবং ভয়াবহ অগ্নিসংযোগের ঘটনা। নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও চরম মানবাধিকার লংঘন বৈ কিছু নয়। বিশেষ করে, পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তির পর প্রকাশ্য দিবালোকে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতিতে এবং খোদ চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকারের আমলে এই ধরনের হিংসাত্মক হামলার ঘটনা কোনোভাবেই আশা করা যায় না। এটি সম্পূর্ণরূপে সরকার, প্রশাসন ও সেটেলার বাঙালিদের জুম্মবিদ্বেষী, হিংসাত্মক, সাম্প্রদায়িক ও আগ্রাসী মানসিকতা ও ধারাবাহিক কর্মকান্ডের ফসল। এই ঘটনার দায় সরকারের উপরই বর্তায়। চুক্তি স্বাক্ষরের কিছুদিন পরেই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের গড়িমসি এবং খোদ সরকারি মহল কর্তৃক চুক্তিবিরোধী ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক এক ফল হল এই হামলা। ঘটনার পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার হামলার ঘটনায় দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে কিছু ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হলেও এতবড় মানবাধিকার বিরোধী সাম্প্রদায়িক হামলার যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা হয়নি। উপরন্তু যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদেরকেও জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত অনেক আসামী লংগদু ও এমনকি রাঙ্গামাটিতে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানা গেছে। যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক এবং হতাশাব্যঞ্জক। এটি কোনোভাবেই সুশাসন ও সুবিচারের লক্ষণ বলা যায় না। এই ধরনের বাস্তবতা সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য, ভেদাভেদ, বিদ্বেষ, অপরাধকেই উৎসাহিত করবে। যার কুফল একদিন সরকার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেই ভোগ করতে হবে। তাই সামগ্রিক স্বার্থে লংগদু সাম্প্রদায়িক হামলায় দোষীদের অচিরেই গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি।