রাঙ্গামাটির রাজদ্বীপে ব্যাপক সেনা অভিযান ও বাড়িঘরে তল্লাশি, জনমনে আতঙ্ক

0
4758
হিল ভয়েস, ১৩ এপ্রিল ২০২০, রাঙ্গামাটি:  আজ ভোর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা সদরের আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত রাজদ্বীপ ও রাজবাড়ি এলাকায় ব্যাপক টহল অভিযান চালায় এবং বাড়িঘরে তল্লাশি চালিয়ে অনেককে হয়রানি করে।
 
উল্লেখ্য, এমুহূর্তে একদিকে মহামারী করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে একপ্রকার লকডাইনের কারণে জনজীবনে চলছে অচলাবস্থা, নানা অভাব-অনটন, অপরদিকে আদিবাসী জুম্মদের প্রাণের ঐতিহ্যবাহী বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু উৎসব পালনে এসেছে স্থবিরতা আর হতাশা। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর এমন অভিযান, তল্লাশি ও হয়রানি মানুষকে আরও উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
 
জানা গেছে, ১৩ এপ্রিল ২০২০ ভোর রাত ৪:০০ ঘটিকা থেকে সেনাবাহিনীর ১৫০ জনের একটি দল কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাঙ্গামাটি শহরের অন্তর্গত রাজবাড়ি এলাকাসহ এর নিকটবর্তী উত্তর রাজদ্বীপ, মধ্য রাজদ্বীপ, বড়ুয়া পাড়া, হিন্দু পাড়া ও লিচুবাগান এলাকা সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও করে। এসময় তারা এলাকাবাসীদের বাড়ির দরজায় লাঠি মেরে দরজা খুলতে বলে এবং রাজবাড়ি এলাকার বাসিন্দা সাবেক পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার বিটু চাকমা (৫২)-কে বলে যায় যে, তারা আবার আসবে। তবে সেনাসদস্যরা রাজবাড়িতে প্রবেশ করেনি।
 
এলাকায় সেনা অভিযানের সময় নিম্নোক্ত বাড়িসমূহে তল্লাসী চালানো হয়-
 
১. ফরেন্ট চাকমা (৩৫), পীং বিনোদ বিহারী চাকমা, মধ্য রাজদ্বীপ;
২. বিজয়গিরি চাকমা (৫৫), পীং মৃত জয়ধন চাকমা, মধ্য রাজদ্বীপ। তিনি রাঙ্গামাটি সদর উপজেলাধীন বালুখালি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান;
৩. সুমেরু দেওয়ান (৬৫), লিছুবাগান;
৪. চিত্রসেন চাকমা (৬২), পীং যমুনাশ্বর চাকমা, রাজদ্বীপ। তিনি একজন প্রাক্তন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান;
৫. কালাপুনা চকমা (৩৮), পীং দয়া মোহন চাকমা, উত্তর রাজদ্বীপ;
৬. হাঙেলা চাকমা (৩৫), পীং পূর্ণ রতন চাকমা, উত্তর রাজদ্বীপ।
 
তল্লাশির সময় বাড়ির লোকদের ভোটার আইডি কার্ড চেয়ে এবং কে কি করে, বাড়িতে কতজন থাকে ইত্যাদি  জিজ্ঞাসা করে এবং নানাভাবে হয়রানি করে সকাল ৯:০০টার দিকে চলে যায়। যাওয়ার সময় সমস্ত গ্রুপগুলো রাঙ্গামাটির জলযান ঘাটে চলে যায় বলে জানা যায়।
 
অন্যদিকে গত ১১ এপ্রিল ২০২০ জুরাছড়ির শীলছড়ি সেনা ক্যাম্প হতে একজন মেজরের নেতৃত্বে ৪২ জনের একদল সেনা বটতলী হয়ে বিলাইছড়ি উপজেলার বেগেনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করে। একই সময়ে বিলাইছড়ি জোন, গাছকাটাছড়া ক্যাম্প হতে প্রায় ৪০/৫০ জন সেনা বিলাইছড়ি উপজেলার নাড়াইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে অবস্থান নেয়।
 
কাপ্তাই আইসল্যান্ড ক্যাম্প হতে প্রায় ৪০ জনের একদল সেনা দুটি ট্রলার যোগে ইজাছড়িতে এসে দুই দলে ভাগ হয়ে এক দল পিত্তেছড়ির দিকে চলে যায়, আরেকদল নাড়াইছড়িতে আগে থেকে অবস্থান করা সেনাদের সাথে মিলিত হয়।
 
বিকালের দিকে বেগেনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করা সেনারা নাড়াইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা সেনাদের সাথে মিলিত হয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর আবার বেগেনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিরে যায়। এদিকে বিলাইছড়ি জোন হতে প্রায় ৪০/৫০ জন সেনা সদস্য তাগলকছড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে টহল দেয়।
 
১২ এপ্রিল, রবিবার দুপুরের দিকে বেগেনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করা সেনা সদস্যরা বটতলি হয়ে শীলছছড়ি ক্যাম্পে ফিরে যায় বলে জানা যায়।
 
এদিকে  নাড়াইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করা সেনা সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন সেনা সদস্য নাড়াইছড়ি উজানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে তিন রাউন্ড ব্যাঙ্ক ফায়ার করে আবার উজানে গিয়ে শীলবাজ্যেতে (ছোট খাল) ঢুকে কিছুদূর গিয়ে  আবার পাঁচ রাউন্ড ব্যাঙ্ক ফায়ার করে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর নাড়াইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিরে যায়।
 
গোলাগুলির আওয়াজ শুনে স্থানীয় সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে সাধারণ মানুষ করোনা ভাইরাসে কারণে লকডাউনে থাকা ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে।
 
অন্যদিকে বাদলছড়িতে অবস্থান করা সেনা সদস্যদের মধ্যে একদল সেনা বাদোলহাটছড়া পর্যন্ত এসে কয়েকজন মানুষকে জড়ো করে ছবি তুলে আবার ফিরে যায়।
 
অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন শিজক এলাকায় সেনাবাহিনী ও বিজিবি টহল দেয়। গত ১০ এপ্রিল শিজক যৌথখামার ও চিন্তারামছড়ায় এবং ১১ এপ্রিল সকালে শিজক গলাচিবে ও তাংগুম যতিন মোহন পাড়ায় সেনা ও বিজিবি সদস্যরা টহল দেয় বলে জানা গেছে।
 
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনা শাসন জারি করে।
 
উক্ত ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে একদিকে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধে অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্রেফতার, মারধর, জেলে প্রেরণ, ঘরবাড়ি তল্লাসী, হয়রানি করে যাচ্ছে, অপরদিকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।