বান্দরবানে সেনাবাহিনী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক জোর করে ম্রোদের নিয়ে মানববন্ধন!

0
1161

হিলভয়েস, ১৭ নভেম্বর ২০২০, বান্দরবান: পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক আদিবাসী ম্রোদের ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মাণাধীন পাঁচ তারকা হোটেলের পক্ষে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের উচ্ছেদ করে সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক পাঁচতারা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠীসহ দেশে ও বিদেশে সচেতন মানুষ কর্তৃক যে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে, তা ধামাচাপা দিতে ও ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই এই তথাকথিত মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

আজ (১৭ নভেম্বর ২০২০) সকাল ৭:০০ টার দিকে আলিকদম উপজেলা সদরে একবার এবং বেলা ১১:০০ টার দিকে বান্দরান জেলা সদরে প্রেসক্লাবের সামনে আরেকবার এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এইসব মানববন্ধনে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই কর্তৃক সরবরাহকৃত লিখিত বক্তব্যে সেনাবাহিনীর পক্ষে এবং বিতর্কিত পাঁচতারা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের স্বপক্ষে কথা বলতে বাধ্য করা হয়। এছাড়া, ব্যানারে, পোস্টারে, ফেস্টুনে ম্রোদের উচ্ছেদের কথা না লিখে, লেখা হয়- ‘সেনাবাহিনী এবং ম্রো সম্পর্কের অপর নাম সহযোগিতার সেতুবন্ধন’, ‘ম্রো-সেনাবাহিনীর সম্পর্কের অপপ্রচার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিহত করি’, ‘পাহাড়ে হোক পর্যটন ম্রোদের হোক উন্নয়ন’, ‘সেনাবাহিনী-ম্রো এক হয়ে সন্ত্রাসবাদ রুখে দেই’ ইত্যাদি অন্তঃসারশূণ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শ্লোগান।

এসব মানববন্ধনের চারপাশে ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। অপরদিকে সেনামদদপুষ্ট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মুসলিম সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক সংগঠন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের নেতা মোঃ মুজিবর রহমানসহ অনেককেই বান্দরবান সদরের মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর প্রত্যেক্ষ ইশারায় লোক দেখানো মানববন্ধনে জীবন ত্রিপুরার সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামীলীগ থেকে বহিষ্কৃত জেলা সাধারণ সম্পাদক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এবং বিভিন্ন সময়ে ম্রো ও চাক আদিবাসীদের ভূমি দখলকারী মো: কাজী মুজিব।

সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিদের এই হীন অপচেষ্টায় সহযোগিতা করছে কতিপয় ম্রো জনগোষ্ঠীর আদিবাসী নেতাসহ ম্রোদেরই কিছু দালাল। বান্দরবান সদরের টংকাবতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের সদস্য পূর্নচন্দ্র ম্রো, মাংসার ম্রো, খাংলাই ম্রো, রাংলাই ম্রো এবং জেলা পরিষদের সদস্য ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের সদস্য সিয়ংইয়ং ম্রো, আলিকদমের ইয়ংলক ম্রো, সোলমন ম্রো, মেদন ম্রো, পাচ্ছিং ম্রো সহ কতিপয় দালাল নিজজাতির সাথে প্রতারণা করে সেনাবাহিনী ও সেটলারদের ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল থেকে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এই মানববন্ধন আয়োজন করতে তৎপর হয়। তারা কিছু এজেন্ট ও দালাল দিয়ে চিম্বুক পাহাড় এলাকা ও আলিকদমসহ বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী ম্রোদের মানববন্ধনে যেতে হবে বলে তাগিদ দিতে থাকে। তারা বিভিন্ন উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধার প্রলোভনও দেখায়। কিন্তু সাধারণ ম্রোরা এতে অপারগতা প্রকাশ করলে, এক পর্যায়ে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। এতে ম্রোদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত চিম্বুক পাহাড় এলাকার আদিবাসী ম্রোরা মানববন্ধনে যেতে রাজী হয়নি। তবে আলিকদমের ম্রোদের দিয়ে আলিকদম সদরে একটি মানববন্ধন আয়োজন করা হয়। এরপর আলিকদমের ওই ম্রো গ্রামবাসীদের তিনটি বাস ভাড়া করে দিয়ে বান্দরবান সদরে এনে আরো একটি মানববন্ধন আয়োজন করা হয়। জানা গেছে, অংশগ্রহণকারী ম্রো গ্রামবাসী প্রত্যেককে ১০০০-১৫০০ টাকা করে প্রদান করা হয়।

জানা গেছে, আজ সকালে আলিকদম সেনাজোন ৩৯ বীর এর দপ্তর থেকে ইয়াংলুক ম্রো এবং মেন্ডেন ম্রো নামে দু’জনকে ডেকে নেয়া হয়। উল্লেখ্য, ইয়াংলুক ম্রো আলিকদম উপজেলা ম্রো আবাসিক এর পরিচালক এবং মেন্ডেন ম্রো স্থানীয় ভিডিপির কম্যান্ডার। সেনাবাহিনী এসময় তাদের দুইজনকে টাকা দিয়ে ম্রোদেরকে সমাবেশ করতে বলে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ম্রোদের বলা হয়, সমাবেশে পাঁচতারকা হোটেলের পক্ষে বলতে এবং এই হোটেলের সাথে সেনাবাহিনী জড়িত নয় বলেও বক্তব্য দিতে বলা হয়।

জানা গেছে, সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই কর্তৃক ২৫০-৩০০ ম্রো গ্রামবাসীকে মানববন্ধনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত ৭০-১০০ জনের মত লোক নিয়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত করা হয়। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের লক্ষ্য করলে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, অংশগ্রহণকারী ম্রোরা কেউ সচেতন ও স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেনি। অনুষ্ঠান চলাকালে তারা ছিলেন অত্যন্ত বিমর্ষ, অন্যমনস্ক এবং উদ্বিগ্ন। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ম্রোর চোখে মুখে ছিল অসহায়ত্বের ছাপ।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রনেতা রেং ইয়াং ম্রো নাঙচেন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, “..বক্তব্যের কপি রাতে সরবরাহ করা হয়েছে আলিকদমে। হালকা পাতলা বাংলা পড়তে পারে এমন দুই একজনকে বেছে নিয়ে পাঠ করার জন্য বাধ্য করা হয়েছে। বক্তা হিসেবে যাদের বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের দুইজনের সাথে ফোনে কথা হয়েছিল রাতে। তাঁরা কোনভাবেই যেতে চাচ্ছিলেন না। তাঁরা তাদের অসহায়ত্বের কথা ব্যক্ত করেছিলেন।”
“নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে সকালে তিনটা বাসে করে আলিকদম থেকে ম্রোদের ধরে আনা হয়েছে। তাদেরকে ব্যানার, ফেস্টুন ধরিয়ে দিয়ে মানববন্ধন করানো হচ্ছে বান্দরবানে।”
তিনি আরও লেখেন, “আমরা ভয়ে আছি, আমরা নিজেদের কথা বলতে পারছি না। আমরা অসহায় আর বিপন্ন বোধ করছি।…ভূমি বেদখলকারিদের সাথে, ম্রো জাতিগোষ্ঠীর উচ্ছেদের সাথে, পর্যটনের সাথে, সিকদার গ্রুপের সাথে নিরাপত্তা বাহিনির সম্পর্কটা আসলে কী সেটা পরিষ্কার হওয়া উচিত।”

ব্লগার পাইচিংমং মারমা তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, “আর্মির মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের তত্ত্বাবধানে বান্দরবানে মানববন্ধন সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নিজেদের ইমেজ পরিষ্কার করতে আর জল ঘোলা করতে এই আয়োজন। সব খরচ, সব আয়োজন আর্মিরা করছে। আলিকদম থেকে শ’খানেক আদিবাসী যোগার করা হয়েছে। এটা একটা পাল্টা শোডাউন। দেদারসে পয়সা ছিটানো হইছে, পরিবহনের ব্যবস্থা, লিফলেট বিলিসহ পাল্টা শোডাউনের নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ম্রো ছাত্র জানান, “গতকাল আলিকদমে ম্রোসহ সাধারণ আদিবাসী ছাত্র-জনতা সেনাবাহিনীর ভূমি দখলের প্রতিবাদে সমাবেশ করতে চাইলে সেনাবাহিনী তাদের সরাসরি বাধা দেয় এবং বিভিন্ন ধরনের হুমকি প্রদান করে। অথচ আজকে তারাই এই মানববন্ধন করতে বাধ্য করছে।”

বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস্ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক চ্যং ইয়ুং ম্রো বলেন, “আজকের মানববন্ধনটি তৃতীয় পক্ষের সম্পূর্ণ একটি সাজানো মিথ্যা ও বানোয়াট মানববন্ধন। এটি কোনভাবে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রোদের ও সমগ্র ম্রো জাতির বক্তব্য প্রতিফলন করে না। সমগ্র ম্রো সমাজ চিম্বুক পাহাড়ের বুকে ম্রোদের উচ্ছেদ করে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের জন্য আন্দোলনে প্রস্তুত।”

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ বলেন, “ম্রোদের উচ্ছেদ করে পর্যটনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আজকের এ মানববন্ধনটি নিরাপত্তা বাহিনী আয়োজন করে।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা বলেন, “শিকদার গ্রুপ ও নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে ফাইভ স্টার হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের পথকে বৈধ করে ভূমি থেকে ম্রো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে পর্যটন স্থাপনা ও ফাইভ স্টার নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধের দাবিতে ম্রো আদিবাসীদের চলমান আন্দোলনকে বির্তকিত করতে ও মানুষের মনে বিভ্রান্তি ছড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে এ মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছে। তবে ম্রো আদিবাসীদের আন্দোলন চলমান থাকবে। তাদের কর্মসূচিতে পিসিপি’র পক্ষ থেকে সংহতি থাকবে।”

আর বান্দরবান সদরে বসবাসকারী মানববন্ধনের জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, “ম্রো হলে মহিলাদের মত চুল বাধা এবং চুল লম্বা থাকে। এখানে কিছু পরিচিত মারমাকেও দেখা গেছে।” তিনি আরও বলেন, “মানববন্ধনে উপস্থিতদের মধ্যে ৮০% ভাগ হলো মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, খেয়াং সম্প্রদায়ের এবং ১০% ভাগ বাঙালি আর ১০% হলো ম্রো।”

কয়েকজন সচেতন নাগরিক ও অধিকারকর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এভাবে ম্রোদের স্বার্থের বিরুদ্ধে ম্রোদের বাধ্য করে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করানোর উদ্যোগ ন্যাক্কারজনক ও মানবাধিকারের অবমাননা এবং আদিবাসীদের প্রতি চরম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ।”

উল্লেখ্য যে, শিকদার গ্রুপ এবং সেনাকল্যাণ ট্রাস্ট এর যৌথ উদ্যোগে ফাইভ স্টার হোটেল বানানোর নাম করে বান্দরবান সদর উপজেলার চিম্বুক পাহাড়ে প্রায় এক হাজার হেক্টর জুমের জমি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই হোটেল নির্মাণ হলে প্রত্যক্ষভাবে ম্রোদের চারটি পাড়া এবং পরোক্ষভাবে ৭০-১১৬টি পাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে, প্রায় ১০ হাজার জুমচাষি উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন বলে জানা গেছে।