রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটেলারদের সংঘবদ্ধ হামলায় সংঘটিত নান্যাচর গণহত্যার ২৭ বছর

0
858

নিপন ত্রিপুরা

আজ ১৭ নভেম্বর ২০২০। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটেলারদের সংঘবদ্ধ হামলায় সংঘটিত নান্যাচর গণহত্যার ২৭ বছর।

গণহত্যার প্রেক্ষাপট
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের জন্য তৎকালীন খালেদা জিয়া সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক আলাপ চলছিল। মূলত এ সমস্যাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ১৯৯৩ সালে ১৭ নভেম্বর নান্যাচর গণহত্যা চালানো হয়।

রাঙ্গামাটি থেকে ২০ মাইল উত্তরে হ্রদ বেষ্টিত নান্যাচরের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে নৌযান। লঞ্চঘাটের একমাত্র যাত্রীছাউনিতে দীর্ঘদিন ধরে ৪০ ই,বি আর, সেনা চেক পোস্ট বসিয়ে জুম্ম যাত্রীদের নিয়মিত হয়রানি, ধরপাকড়, নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো। সেখানে কর্তব্যরত সেনারা জুম্ম নারীদের শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে আসছিলো দীর্ঘ দিন ধরে। তার আগে ২৭ শে অক্টোবর ন্যান্যাচর থেকে খাগড়াছড়িগামী পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দকে গাড়ি আটকে রেখে হয়রানি ও নির্যাতন চালানো হয়েছিল। পরবর্তীতে নেতৃবৃন্দ হেঁটে খাগড়াছড়িতে যেতে বাধ্য হয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ হয়রানি, আটক ও আটকের প্রতিবাদ এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের দাবিতে ন্যান্যাচরে এক বিশাল সমাবেশ থেকে লংগদু গণহত্যা (৮৯), মাল্যে গণহত্যা (৯১), লোগাং গণহত্যা (৯২) সহ সকল গণহত্যার বিচারের দাবিসহ ৫ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। ২ নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ন্যান্যাচরের যাত্রীছাউনি থেকে সেনাপোস্ট প্রত্যাহারের সময় বেঁধে দেয়া হয়।
ঘটনার দিন

১৭ নভেম্বর ১৯৯৩। দিনটি ছিল বুধবার। নান্যাচরের সাপ্তাহিক বাজার দিন। স্বাভাবিকভাবে দূর-দূরান্ত থেকে শত শত জুম্ম শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ বাজারে এসেছিল। অন্যদিকে ১৭ নভেম্বর পিসিপির বেঁধে দেয়া সময় সীমার শেষ দিন। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বেঁধেঁ দেয়া সময় শেষে সেই দিন বেলা ১২ টায় দাবি আদাযের জন্য মিছিলের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। ছাত্রদের সাথে যোগ হয় সাধারণ জুম্ম জনতাও। ঠিক বেলা ১২ টায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে মিছিলটি স্থানীয় ন্যান্যাচর বাজারের লাইব্রেরি প্রাঙ্গন থেকে শুরু হয়। হাজার হাজার জুম্ম ছাত্র-জনতার মিছিলে তখন সারা নান্যাচর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ মিছিলটি শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে কৃষি ব্যাংক এর সামনে সমাবেশ করে।

এদিকে পিসিপির ৫ দফা দাবি মানতে নারাজ নান্যাচরের স্থানীয় প্রশাসন-সেনা বাহিনী যড়যন্ত্রের জাল বুনে। তারা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে গড়ে তুলে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি- পার্বত্য গণ পরিষদ ও পার্বত্য ছাত্র পরিষদসহ মৌলবাদী গোষ্ঠী। তাদেরকে ব্যবহার করে সেনা-প্রশাসন পাল্টা প্রতিরোধের নামে আঁকে গণহত্যার নীলনকশা।

অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সংগঠন পার্বত্য গণ পরিষদ ও পার্বত্য ছাত্র পরিষদ শহরে জঙ্গী মিছিল বের করে। তারা মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের মিছিল থেকে এক জুম্ম বৃদ্ধকে হামলা করে আহত করা হয়। এ হামলা জুম্মদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। এক পর্যায়ে সেটেলাররা দা, বল্লম ইত্যাদি দিয়ে হামলা শুরু করে। বিপরীতে জুম্ম ছাত্র সমাজ জনতা প্রবল প্রতিরোধ করে। এতে সেটেলার বাঙালিরা পিছু হটলে কর্তব্যরত আর,পি ল্যান্স নায়ক জুম্ম জনতার উপরে ব্রাশ ফায়ার করে। ব্রাশ ফায়ারে মুহূর্তের মধ্যে ৮ জন শহীদ হন। গুলির মুখে নিরস্ত্র জুম্মদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া জুম্মদের উপর সশস্ত্র সেনা, ভিডিপি ও সেটেলার বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেনারা বন্দুকের আঘাতে আহত করার পর সেটেলাররা পশুর মত জবাই করে হত্যা করে। অনেকে কাপ্তাই লেকের পানিতে ঝাঁপিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে নি। লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টাকারীদের টেনে হিচড়ে বের করে হত্যা করা করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পাশের জুম্ম গ্রামগুলি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সময় রাঙ্গামাটি থেকে অনেক যাত্রীদের উপরেও হামলা করা হয়। এ হামলায় বোধিপ্রিয় নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়। প্রায় দু ঘন্টা ধরে জুম্মদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ঘটনার দিন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক বিকাল ৪:০০ টায় পৌঁছালে জুম্ম নিধন বন্ধ হয়ে যায়। এ গণহত্যায় প্রায় ২৯ জন নিহত, ১৬৪ জন আহত ও প্রায় ৫০ জন জুম্মকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।

এই বর্বর গণহত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেয় বুড়িঘাট ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মো: আয়ুব হোসাইন, তৎকালীন বুড়িঘাট ইউ,পি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ, মেজর সালাউদ্দিন।

এ নির্মম হত্যাকান্ডের পর দেশ-বিদেশের ব্যাপক চাপের কারণে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্টের বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে একটি এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সে তদন্ত কমিটির রির্পোটও পরে আলোর মুখ দেখে নি। এভাবে এযাবৎ প্রায় ১৫ টি বড় বড় গণহত্যা পার্বত্য চট্টগামের বুকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষ মদদে সংঘটিত হয়। কোন ঘটনারই বিচার পাওয়া যায়নি।