বাঘাইছড়িতে সেনা ও বিজিবির অদ্ভুত সাইনবোর্ড: সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ভূমি বেদখলের নতুন কায়দা

0
888

হিল ভয়েস, ২২ মার্চ ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদন:সম্প্রতি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে সীমান্ত সড়ক ও সীমান্ত সংযোগ সড়ককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসী জুম্মদের বিভিন্ন আবাসভূমিতে স্থানীয় নামের বিপরীতে বহিরাগত মুসলিম ব্যক্তির নামে নতুন নাম সম্বলিত অদ্ভুত সাইনবোর্ড স্থাপন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় জনগণ ও পর্যবেক্ষমহলের ধারণা, সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন বিজিবি মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং স্থানীয় জুম্মদের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের লক্ষেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এইসব সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে। বলাবাহুল্য, ওই সাইনবোর্ডে উল্লিখিত স্থানের নামের সাথে স্থানীয় জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোনো সম্পর্কই নেই।

এধরনের সাইনবোর্ড স্থাপনের কয়েকটি উদাহরণ হল- বাঘাইছড়ির সার্বোয়াতলী এলাকার ভিজে হিজিং নামক স্থানের জায়গায় ‘শাহীন টিলা’, সাজেক এলাকার কিংকরপাড়া স্থানের জায়গায় ‘মাহমুদ টিলা’, সাজেক এলাকার দুরবাছড়া স্থানের জায়গায় ‘এনামুল টিলা’, সাজেক এলাকার বটতলা নামক স্থানের জায়গায় ‘সজিব টিলা’, সাজেক এলাকার কিংকরপাড়ার স্থানে আরো একটি ‘শামিম টিলা’, সাজেক এলাকার ভুইয়োছড়া নামক স্থানের জায়গায় ‘সাইদুর টিলা’, সাজেক এলাকার কিংকরপাড়ায় আরো একটি ‘ইসমাইল টিলা (বিওপি পোস্ট)’, সাজেক এলাকার ভুইয়োছড়া নামক জায়গায় আরো একটি ‘আল-আমিন টিলা’ ইত্যাদি নাম সম্বলিত সাইনবোর্ড।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঐ এলাকাতে যুগ যুগ ধরে আদিবাসী জুম্মরাই বসবাস করে আসছে এবং জুমচাষ ও বাগান-বাগিচা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। ঐ সকল স্থানে কোনো মুসলিম বাঙালির বসতি ছিল না এবং নেই। সংশ্লিষ্ট বাসিন্দারা যাদের নামে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে তাদের নামও কখনো শোনেনি ঐ এলাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘাইছড়ির এক অধিকারকর্মী বলেন, এটা জুম্ম বিদ্বেষী সেনাবাহিনীরই ষড়যন্ত্র। এটা জুম্মদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বদলে দেবার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ধরনের সাইনবোর্ড স্থাপন বহিরাগত অনুপ্রবেশকেও উস্কে দেবে।

এছাড়া সীমান্ত সড়ক ও সীমান্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের সময় সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সড়কের আশেপাশে আকর্ষণীয় বহু জায়গা বাছাই করে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে সেখানে ‘সংরক্ষিত এলাকা’ বলে উল্লেখ করে দখল করে রাখার অভিযোগ পাওয়া যায়। পাশাপশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমত কারো কারো জায়গায়, এমনকি স্কুল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জায়গায়ও সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সাইনবোর্ড স্থাপন করতে দেখা যায়। এতে তারা স্থানীয় জনগণকেও ঐ এলাকায় চলাচল নিষিদ্ধ করছে।

এর কয়েকটি উদাহরণ হল- (১) বাঘাইছড়ির সারোয়াতলী ইউনিয়নের রেগাছড়া নামক স্থানে স্থাপিত ‘মহাসাতিপট্ঠান ভাবনা কুটির’ নামক বৌদ্ধ মন্দিরের জায়গায় সম্প্রতি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ‘সংরক্ষিত এলাকা’ বলে সাইনবোর্ড দিয়ে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ, মাটিকাটা সহ চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে; (২) লংগদু সেনা জোনের পক্ষ থেকে বাঘাইছড়ির সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর খাগড়াছড়ি এলাকায় জুম্ম বসতবাড়ির পাশে ‘নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নির্ধারিত স্থান’, বৌদ্ধ মন্দির সহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ বলে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে; (৩) লংগদু উপজেলার গুলশাখালীতে শান্তিনগর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গাতেই ‘শান্তিনগর বিজিবি ক্যাম্প, রাজানগর জোন ৩৭ বিজিবি’ উল্লেখ করে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।

এই ধরনের কর্মকান্ডকে জুম্মদের উপর চরম ইসলামী সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসন এবং জুম্মদের ঐতিহ্য ও নাম-নিশানা নিশ্চিহ্ন করার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে বিবেচনা করা যায়। এটা নিশ্চিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম (উপজাতি) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের যে অঙ্গীকার ও বিধান রয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার ও সেনাবাহিনী তা সম্পূর্ণভাবে বরখেলাপ করছে এবং জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যের উপর গভীর আঘাত সৃষ্টি করে চলেছে বলে বিবেচনা করা যায়।

স্থানীয় জুম্মদের আশংকা, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় এবং চুক্তির আলোকে স্থাপিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ায়, সর্বোপরি সেনাবাহিনী ও সরকারের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম বিদ্বেষী ভূমিকার কারণে এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প জুম্মদের বর্তমান ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও সুদুরপ্রসারী আরও অনেক ক্ষতি ডেকে আনবে। এতে বহিরাগত অনুপ্রবেশ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বহিরাগত পুঁজির আধিপত্য, ভূমি বেদখল ও স্থানীয়দের ভূমি বেহাত হওয়ার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে, যাতে জুম্মদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও স্বশাসন নিয়ে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তে ৩১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সীমান্ত সড়ক (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা) নির্মাণ প্রকল্প-১ম পর্যায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কারণে এ পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) অন্তত ৭৭৬টি জুম্ম পরিবার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন এবং কমপক্ষে ৭৮টি পরিবার নিজের বাড়ি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি সীমান্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজে জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ির সীমান্তবর্তী পাশাপাশি ২টি জুম্ম গ্রামের মোট ২৩ পরিবার জুম্ম পরিবার উচ্ছেদের মুখে রয়েছে। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে তাদের গ্রামে ছেড়ে চলে যেতে বলেছে এবং জুমচাষে বাধা প্রদান করছে।