পিসিজেএসএস’র জাতীয় সম্মেলন সম্পন্ন: বৃহত্তর আন্দোলন জোরদার করাসহ ১৮দফা প্রস্তাবাবলী গৃহীত

0
303

হিল ভয়েস, ৩০ জুলাই ২০২৩, রাঙ্গামাটি: ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তম আন্দোলনে সামিল হউন’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে গত ২৮-২৯ জুলাই ২০২৩ দুইদিন ব্যাপী রাঙ্গামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জেলা, থানা ও ইউনিয়ন শাখাসমূহ এবং এর সহযোগী সংগঠন- পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম ও গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠীর সাড়ে চার শতাধিক প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক যোগদান করেন।

জাতীয় সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট ১২তম কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি পদে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সহ সভাপতি পদে ঊষাতন তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক পদে প্রণতি বিকাশ চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে শক্তিপদ ত্রিপুরা নির্বাচিত হয়েছেন।

সম্মেলনে বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক একটি সামগ্রিক প্রতিবেদন পেশ করা হয় এবং উপস্থাপিত সামগ্রিক প্রতিবেদনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনসহ জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপ, পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা, পার্টির ভবিষ্যত কর্মপন্থার উপর আলোচনা হয়। সম্মেলনে প্রতিনিধিগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনরায় আসীন হওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হওয়ায় চরম ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সরকার একদিকে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তালবাহানা করে চলেছে, অন্যদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্মস্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম গ্রহণ করে চলেছে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূল করা এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা হচ্ছে বলে সম্মেলনের প্রতিনিধিগণ মত ব্যক্ত করেন।

সম্মেলনে প্রতিনিধিগণ আরো বলেন, সরকার সামরিকায়নের নীতিকে বৈধতা দিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’, ‘চাঁদাবাজ’ ইত্যাদি তকমা দিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে জুম্মদের মধ্য থেকে সুবিধাবাদী, তাঁবেদার ও উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের দিয়ে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে এবং তাদেরকে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে চলেছে। তারই অংশ হিসেবে জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত অধিকারকর্মী ও জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ, ওয়ারেন্ট ছাড়া ঘরবাড়ি তল্লাশি ও ঘরবাড়ির জিনিসপত্র তছনছ, মারধর, হয়রানি ইত্যাদি ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বর্তমানেও পার্টির কেন্দ্রীয়সহ বিভিন্ন স্তরের বহু নেতাকর্মী মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে অথবা বিচারবহির্ভূত জেল-জুলুম-মিথ্যামামলা-হত্যার ঝুঁকিতে নিজের বাড়ি ও এলাকা ছেড়ে ফেরারি অবস্থায় জীবনযাপনে পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।

সরকারের বিশেষ মহল একদিকে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও মদদ দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে, অপরদিকে সন্ত্রাসী দমনের নামে জনসংহতি সমিতিসহ জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতার দায়ভার জনসংহতি সমিতির উপর চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ নামক একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠনে সংগঠিত করে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম, ভূমি বেদখল, নারীর উপর সহিংসতা, রোহিঙ্গাসহ বহিরাগত অনুপ্রবেশ ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণ, সাম্প্রদায়িক হামলা ইত্যাদি তৎপরতায় লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সরকারী দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের চাকুরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এসব কারণে জুম্ম জনগণ এক নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। সম্মেলনে প্রতিনিধিবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তম আন্দোলনে সামিল হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

সম্মেলনে প্রতিনিধিদের আলোচনা-পর্যালোচনার পর বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত প্রস্তাবাবলী সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়;

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জোরদার করা।

২. তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৩. পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিধিমালা অতিসত্তর প্রণয়নের জন্য সরকারের নিকট অব্যাহত তাগাদা রাখাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৫. প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক যথাযথ পুনর্বাসন করা।

৬. ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন বাতিল পূর্বক সেনা, আনসার, এপিবি ও ভিডিপি’র সকল অস্থায়ী ক্যাম্প চুক্তি মোতাবেক প্রত্যাহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং প্রত্যাহারকৃত জায়গায় পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা।

৭. ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ (স্থানীয়), বন ও পরিবেশসহ পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরযোগ্য বিষয়সমূহ কার্যকর করা।

৮. তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় পুলিশবাহিনী গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৯. ভূমি ব্যবস্থাপনার বিধানাবলী প্রণয়ন পূর্বক ভূমিহীনদের ভূমি বন্দোবস্তী প্রদানের মাধ্যমে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১০. পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও পরিষদীয় প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১১. বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের জন্য অধিকতর সংখ্যক কোটা সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং বিসিএস ক্যাডার নিয়োগে বাতিলকৃত উপজাতীয় কোটা পুনর্বহাল করা।

১২. তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনের সাথে সঙ্গতি বিধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

১৩. ১৯৫৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ আইন বাতিলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১৪. দেশের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে অধিকতর সামিল হওয়া।

১৫. দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা প্রতিরোধ আন্দোলনে অধিকতর শরিক হওয়া।

১৬. দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সারা বিশ্বের আদিবাসী ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অধিকতর শরিক হওয়া।

১৭. ক্যাম্প সম্প্রসারণ, অবৈধভাবে ইকো-পার্ক ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা, বহিরাগতদের পুনর্বাসন ইত্যাদির নামে জুমভূমিসহ স্থায়ী অধিবাসীদের রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জায়গা-জমি অধিগ্রহণ ও বেদখলের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১৮. ৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত গৃহীত বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী সিদ্ধান্তাবলী প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আজ ৩০ জুলাই ২০২৩ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সহ সম্পাদক সজীব চাকমা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উপরোক্ত তথ্য জানানো হয়েছে।