পাহাড়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ: উন্নয়নের আগ্রাসন (শেষ পর্ব)

0
272

অশোক কুমার চাকমা

৫. সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়েছে কী?

আগের আলোচনাতে পাহাড়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরেছি। একই সাথে মাঠ পর্যায়ে কী অবস্থা, সে ব্যাপারেও কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এই পর্বে পাহাড়ে সীমান্ত সড়ক প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পার্বত্য অঞ্চলে প্রযোজ্য আইন ও নীতিমালা মেনে চলা হয়েছে কী না সে ব্যাপারে কিছু তথ্য তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি। এই পর্বে আলোচনার মূল থিসিসটা হলো, পাহাড়ে সীমান্ত সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য আইন ও নিয়ম নীতি কোনটাই তোয়াক্কা করা হয়নি। এটি একটি চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প এবং পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ ও স্বশাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানসমূহকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

একটা কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিক থেকে দেশের সমতল অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। সেই বৃটিশ আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ আইন বলবৎ ছিলো এবং এখনো আছে। সর্বশেষ পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭-এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত’ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চুক্তির আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন বলবৎ হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অঞ্চল পর্যায়ে উন্নয়ন ও সাধারণ প্রশাসনের বিষয়াদির তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়ের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পর্যায়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ভূমির মালিকানার ধরণ সমতল অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামে কখনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা ছিলো না। সে কারণে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ‘খাস জমি’র যে ধারণা চালু আছে, সেটা পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় খাটে না। খাসজমি বলতে যা বুঝানো হয়, সেগুলো সব ‘প্রথাগত ভূমি’ বা সমষ্টিগত মালিকানাধীন ভূমির অংশ। সেই তথাকথিত খাসজমিও এখন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন। কাজেই যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপার থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। নিচের অধ্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনসমূহ দেখে নেওয়া যাক।

(ক) ১৯৫৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান (Chittagong Hill Tracts (Land Acquisition) Regulation 1958)

পাকিস্তান বরাবরই অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিলো। সেনাবাহিনীর জেনারেলরা রাষ্ট্র পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতেন এবং এখনো করে থাকেন। সেই অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেও ‘৬০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আইনি বৈধতা দিতে হয়েছিলো প্রবিধান প্রণয়ণের মাধ্যমে। সেই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকা (Tribal Inhabited Area) হিসেবে স্বীকৃত ছিলো। এই উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আইনি কাঠামো ছিলো না। ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান [Chittagong Hill Tracts (Land Acquisition) Regulation 1958] জারি করতে হয়েছিলো (যদিও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই প্রবিধানকে পাহাড়ি আদিবাসী জনগণের প্রথাগত ভূমি অধিকারের উপর প্রথম আইনি বলাৎকার হিসেবে গণ্য করা যায়। এই প্রবিধানের মাধ্যমে আইনের দোহাই দিয়ে পাহাড়ের আদিবাসী জনগণের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়)।

উক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান ১৯৫৮ নিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যা বিতর্ক থাকুক না কেন, সেখানে মন্দের একটা ভালো দিক ছিলো – ভূমি অধিগ্রহণ করার কারণে কোন ক্ষয়-ক্ষতি হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। মানুষের স্বাভাবিক ন্যায়বিচার (Natural justice) পাওয়ার যে ধারণা আছে, সেটাকে সম্মান করার চেষ্টা করা হয়েছে ঐ প্রবিধানের মাধ্যমে। উক্ত ভূমি অধিপ্রহণ প্রবিধান মোতাবেক কোন ভূমি অধিগ্রহণ করতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যথা:

১. যে তারিখে ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে, সে তারিখ মূলে ভূমির বাজার মূল্য নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা;

২. ভূমি অধিগ্রহণের সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (Person interested) কোন ক্ষয়-ক্ষতি হলে, যেমন কোন স্থাপনা, বাঁশ, গাছ বা দন্ডায়মান কোন শস্য ইত্যাদির জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান;

৩. ভূমি অধিগ্রহণের সময় যদি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (person interested) জমি এক অংশ থেকে অন্য অংশের মধ্যে বিভাজন করার প্রয়োজন হওয়ার কারণে কোন ক্ষয়-ক্ষতি হলে, সেটার জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান;

৪. ভূমি অধিগ্রহণের সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যদি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অথবা তার আয় উপার্জন কোন না কোনভাবে মারাত্মভাবে ব্যাহত হয় (Injuriously affecting), তাহলে সেটার ক্ষতিপূরণ;

৫. ভূমি অধিগ্রহণের কারণে যদি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোন বসত বাড়ী বা ব্যবসার স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়, তাহলে সেটার জন্য যৌক্তিক পরিমাণ খরচ নির্ধারণ করতে হবে এবং একই সাথে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের কারণে যদি অন্য কোন খরচ লাগে, সেটাও নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে;

৬. ভূমি অধিগ্রহণের প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ এবং ভূমি অধিগ্রহণকালীন সময়ের মধ্যে যদি কোন সঙ্গত কারণে ভূমির মূল্য বাড়ে এবং অধিগ্রহণের কারণে যদি স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোন ক্ষতি হয়, তাহলে সেটার জন্যও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।

উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ ছাড়াও কোন কারণে বাধ্যতামূলকভাবে ভূমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন দেখা দিলে জেলা প্রশাসক অধিগ্রহণকৃত ভূমির বাজার মূল্যের উপর সরকারি জমির ক্ষেত্রে ২০০% এবং ব্যক্তিগত জমির ক্ষেত্রে ৩০০% পরিমাণ অতিরিক্ত টাকা নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন [৩]।

এখানে আরো উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান ১৯৫৮-এর আওতায় ভূমি অধিগ্রহণের একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা বলা আছে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বা জনস্বার্থে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য কোন ভূমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হলে আগেভাগে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অবগতির জন্য নোটিস জারি করতে হবে। কারোর ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তারা সরকারের কাছে আবেদন করতে পারবে। তাদের নিকট হতে বক্তব্য শোনার সুযোগ রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসক কর্তৃক নোটিস জারি ছাড়া কোন ভূমি অধিগ্রহণ করার সুযোগ নেই।

প্রবিধান ১৯৫৮-এর আলোকে বিচার করলে প্রশ্ন করা যায় – সীমান্ত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ কী মানা হয়েছে?

আসুন দেখে নিই, সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের কারণে রাস্তার দুই পাশে বসবাসরাত সাধারণ মানুষের কী কী ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কারণে প্রকল্প এলাকাসমূহে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। সেখানকার মানুষদের যেসব ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো হলো:

  • জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – পাহাড় ও ধানি জমি উভয়ই;
  • পাহাড়র কাটার কারণে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়েছে, সে কারণে কোন কোন এলাকায় সড়কের উপর ও নীচের দিকে ঘোনা জমি চাষাবাদের অনুপোযোগী হয়েছে;
  • ফলজ গাছ, কাঠদায়ী গাছসহ নানা ফসল ও শস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে;
  • সরাসরি কারোর ঘর ভেঙে দেওয়া না হলেও ঘরের উঠোন বা বসত বাড়ীর একটা বড় অংশ কেটে নেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক ঘরবাড়ী ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে;
  • শ্মশানভূমির জায়গার (যেমন ঘিলাতুলি গ্রামে) উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে;
  • ফলজ বাগান কেড়ে নিয়ে স্থাপনা (বিজিবি ক্যাম্প) তৈরী করা হয়েছে;
  • পাহাড় কাটার ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।

আমরা দেখেছি, এসব ক্ষয়ক্ষতির জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহ কোন ক্ষতিপূরণ এখনো পায়নি। ভূমি অধিগ্রহণও আইন মেনে করা হয়নি। আইন মেনে করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহ জানতে পারতো তাদের জন্য কবে কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তারা এখনো অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে আদৌ ক্ষতিপূরণ পাবে কী না? যাদের বাড়ী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেগুলো স্থানান্তরের প্রয়োজন হলে তার খরচ কে বহন করবে? সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প থেকে সে রকম কোন সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়নি।

যেসব ক্ষতির কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো এখন দৃশ্যমান। সেগুলোর বাইরেও অনেক পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে, সেগুলো এখনো দৃশ্যমান নয়। সেগুলো আরো পরে দৃশ্যমান হবে। পরিবেশগত প্রভাবগুলোর মধ্যে কিছু প্রভাব অচিরেই দৃশ্যমান হবে। যেমন, প্রবল বর্ষা শুরু হওয়ার সাথে অনেক জায়গায় ভূমি ধস হবে, কাটা শিথিল মাটিগুলো পানিতে ধূয়ে নিয়ে যাবে নিম্নাঞ্চলে, ফলে ঘোনা জমিগুলোতে চাষাবাদ বিভিন্নভাবে ব্যাহত হবে। সীমান্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর করে তুলবে। ফলে সীমান্ত এলাকার বনাঞ্চল আর থাকবে না। গাছ-বাঁশ সহজেই উজাড় হয়ে যাবে। সীমান্ত এলাকা বিরাণভূমিতে পরিণত হতে বেশিদিন লাগবে না।

জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। পাহাড়ি অঞ্চলে পানির বড় উৎস হলো বন বা সবুজ গাছগাছালি। ছোট ছোট ছড়া বা ঝর্ণা বেয়ে পানি নিচের দিকে বয়ে যায়। সেই পানি দিয়ে জমি চাষ হয়। গ্রামের লোকজন গৃহস্থালীর প্রয়োজনে পানি সংগ্রহ করে ছড়া বা ঝর্ণা থেকে। বন উজার হয়ে গেলে নিচের এলাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হবে। পানির জন্য মানুষের হাহাকার পড়বে। পানির অভাব খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত করাসহ সীমান্ত এলাকার জনগোষ্ঠীর সমাজ জীবনে নানা প্রভাব ফেলবে সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এদিকে সীমান্ত এলাকায় পর্যটনের নামে মানুষের যাতায়াত বাড়বে। আর বাংলাদেশের পর্যটন এখনো দায়িত্বশীল ও পরিবেশ বান্ধব পর্যটন হিসেবে গড়ে উঠেনি। শহুরে পর্যটকরা খাবার ও পানিসহ নানা উপকরণ সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। ব্যবহারের পর সেগুলো যেখানে সেখানে ফেলে দেবে। এক সময় দেখা যাবে, সীমান্ত এলাকার পর্যটন স্পট বা ভিউ টাওয়ার কিংবা বিশ্রাম করার স্পটগুলোতে পলিটিন, প্লাস্টিক বোতল ও নানা বর্জ্যে ভরে উঠবে সেটাও সহজেই অনুমান করা যায়। মৌসুমি পর্যটকরা পিকনিক বা আনন্দ ভ্রমণে সেদিকে যাবে। সাউন্ড সিস্টেম লাগবে। আনন্দ করার নামে নর্দন-কুর্দন তো থাকবে। উচ্চস্বরে মিউজিক বাজবে। সেসব শব্দে সীমান্ত এলাকার মানুষগুলোর স্বস্তিতে থাকতে পারার সম্ভাবনা কম। নানা মানুষের সমাগম হলে চৌর্যবৃত্তি বেড়ে যাবে। ফলজ বাগানে উৎপাত বাড়বে। ফলজ বাগানে ফল পাহারা দিয়ে রাখতে হবে, যেটা আগে করতে হতো না। এখন পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে।

সীমান্ত সড়ক নির্মাণের একটা বড় যুক্তি হলো সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সে নিরাপত্তা ধারণাটিও বিতর্কমুক্ত নয়। কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? নিরাপত্তার নামে সীমান্ত চৌকির সংখ্যা বাড়বে। নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা বাড়বে। তাদের আনাগোনাও বেশি হবে। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সাধারণ মানুষদের চলাফেরাও সীমিত হতে পারে। আগে নারীরা পাহাড় থেকে পাহাড়ে গিয়ে বনজ লতাপাতা আর বিভিন্ন ফলমূল সংগ্রহ করতো, তারাই এখন নিরাপত্তার সংকটে ভুগবে। এই ‘নিরাপত্তা’ কথাটিই পাহাড়ি আদিবাসীদের কাছে একটা আতংকমূলক শব্দ। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নানাভাবে লংঘিত হয় – পাহাড়ে যাবিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলতে পারি।

সীমান্ত সড়ক প্রকল্প প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত উপরে উল্লেখিত পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ও সামাজিক প্রভাবগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বিরূপ প্রভাব ঠেকানোর জন্য কোন বিকল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরী করা হয়েছে বলেও জানা যায়নি।

(খ) পার্বত্য চুক্তি ‘৯৭ ও তার পরবর্তীতে প্রণীত আইন ও নীতিমালা কী মানা হয়েছে?

১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। উক্ত চুক্তিতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্য প্রকাশ করে কিছু মৌলিক চেতনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। যেমন,

  • পার্বত্য অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত রাখার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি;
  • পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা;
  • পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
  • পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে চুক্তির আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। পাহাড়ি বাঙালি সব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পার্বত্য পরিষদসমূহে আনুপাতিকহারে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা অনন্য মডেল হতে পারে, যদি পার্বত্য চুক্তিকে যথাযথভাবে কার্যকর করা যায়।

তাত্ত্বিকভাবে পার্বত্য চুক্তির আওতায় খুব সুন্দরভাবে প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয় জাতীয় পর্যায়ে অন্যান্য সব মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় করবে।

এদিকে জাতীয় সংসদে পাসকৃত আইনের মাধ্যমে সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসহ সেখানকার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃংখলা ও উন্নয়নের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের উপর দেওয়া আছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ যার যার জেলা উক্ত কাজ সম্পাদন করবে। এ বিষয়ে আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে কোন অস্পষ্টতা নেই।

এখানে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, এই কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া – পার্বত্য চুক্তি’৯৭ সম্পাদনের পর যে প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে, সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা বা প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ নেই, অন্তত যদি আইন ও আইনের শাসন মানা হয়। এছাড়া চুক্তিতে সব বিষয় উল্লেখ থাকতে হবে তা নয়, যেটা সবচেয়ে জরুরী সেটা হলো সরকারের সদিচ্ছা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। সে কারণে, পার্বত্য চুক্তিতেও উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি ধারা এভাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে,

“[পার্বত্য জেলা] পরিষদ সরকার হইতে প্রাপ্য অর্থে হস্তান্তরিত বিষয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করিবে এবং জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম [পার্বত্য জেলা] পরিষদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করিবে (পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭, খ খন্ডে অনুচ্ছেদ ১৯)।

এখানে “জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম [পার্বত্য জেলা] পরিষদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করিবে”(এখানে জোর দেওয়া হলো)। এ ধারা থেকে এটা খুবই পরিষ্কার, জাতীয় পর্যায়ে কোন মন্ত্রণালয় যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করুক না কেন, এবং সেটা যদি পার্বত্য জেলায় বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে।

সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে ১০১.১২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। ৩১৭ কি.মি (১ম পর্যায়ে) সড়ক নির্মাণের সময় যে সমস্ত জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে, সেগুলোর প্রক্রিয়াটা কী? সেখানে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়েছে কী?

তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন- পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সময় পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য অঞ্চলের প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করা হয়েছে কী? তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে কী সম্পৃক্ত করা হয়েছে?

যদি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে সম্পৃক্ত করা না হয়, তাহলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো কী আঙুল চুষে চুষে বসে আছে? জনস্বার্থে তারা কী ভূমিকা নিতে পারে না? আর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও কী সীমান্ত সড়ক প্রকল্প সম্পর্কে অবহিত? তারাও কী মহাসড়ক ও জনপথ বিভাগ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কে কোন তথ্য জানতে চেয়েছিলেন?

আমজনতা সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিক, একাডেমিক ও উন্নয়ন গবেষকরাও তথ্য উদঘাটনে এগিয়ে আসবেন, সেই প্রত্যাশা রাখি।

পুনশ্চ: আমরা জানি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনী মতে, জগন্নাথ দেবের হাত ঠুঁটো হলেও তিনি মানুষের ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা রাখেন। ঠিক সেরকম চুক্তির আওতায় গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো পাহাড়ের মানুষের আশা আাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তারা ঠুঁটো হতে পারেন, কিন্তু মুখ তো বন্ধ হতে পারে না। জনগণের ইচ্ছে পূরণ হোক বা না হোক, অন্তত তারা জনগণের স্বার্থে মুখ খোলা রাখবেন, সেই প্রত্যাশা রইলো। (সমাপ্ত)

পাদটিকা:

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান ১৯৫৮-তে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি (Person interested) বলতে ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান মোতাবেক যে সমস্ত ব্যক্তিগণ ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণ পেতে দাবীদার তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।

২. তৎকালীন সময়ে জেলা প্রশাসক ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ভূমি বিষয়টি জেলা প্রশাসকের সম্পূর্ণ এখতিয়ারাধীন ছিলো। পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ সম্পাদিত হওয়ার পরে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে চলে গেছে। বর্তমানে জেলা পরিষদের আইন মোতাবেক সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ছাড়া রক্ষিত (Reserved forests) বনাঞ্চল, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানা বা সরকারের নামে রেকর্ডকৃত জমি ব্যতীত অন্য কোন ভূমি ইজারা, বেচা-বিক্রি বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ ভূমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে বা ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও আবশ্যিকভাবে সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন। সড়ক ও জনপথ বিভাগ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে এরকম কোন পূর্বানুমোদন নিয়েছিলো কি না তা জানা যায়নি।

৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি অধিগ্রহণ প্রবিধান ১৯৫৮- এর প্রথম ভার্সনে সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি বলে কোন শব্দ ছিলো না। সেই সময়ে শুধু জমির কথা বলা হয়েছে। তখন জেলা প্রশাসক ভূমির মূল্যের উপর ১৫% অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে পারতেন। ২০১৯ সালে সরকার কর্তৃক ঐ প্রবিধান সংশোধন করা হয়। উক্ত সংশোধনী মূলে উপ-প্রবিধান ৪ (২)-এ Public purpose ও Private purpose শব্দগুচ্ছ ঢুকানো হয়। বাধ্যতামূলকভাবে ভূমি অধিগ্রহণ করা হলে অধিগ্রহণকৃত ভূমির মূল্যের উপর সরকারি জমির ক্ষেত্রে ২০০% এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রে ৩০০% অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়। এই ক্ষতিপূরণ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।

লেখক পরিচিতি: উন্নয়নকর্মী। লেখাটি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।