পার্বত্য চুক্তি বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চুক্তি, এটা আমরা বাস্তবায়ন করে ছাড়বো- রাঙ্গামাটিতে আলোচনা সভায় ঊষাতন তালুকদার

0
277

হিল ভয়েস, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রাঙ্গামাটি: গতকাল ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ রাঙ্গামাটিতে জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত ও সাবেক সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৮৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেছেন, পার্বত্য চুক্তি বৈধ চুক্তি, এই চুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চুক্তি। এই চুক্তি একদিন না একদিন আমরা বাস্তবায়ন করে ছাড়বো। এটা আমরা ছেড়ে দেবো না।

গতকাল সকাল ১০ টায় রাঙ্গামাটির জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঊষাতন তালুকদার এসব কথা বলেন।

জনসংহতি সমিতি রাঙ্গামাটির জেলা কমিটির সভাপতি ডা: গঙ্গা মানিক চাকমার সভাপতিত্বে এবং সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য জুয়েল চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিশির চাকমা, সিএইসটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সভাপতি অ্যাডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক শ্যামা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক থোয়াইক্যজাই চাক, হিল উইমেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আশিকা চাকমা।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘মহাপুরুষেরা জন্ম নেন ইতিহাসের তাগিদে, প্রয়োজনীয়তার তাগিদে। ঠিক তেমনি করে ঘুমন্ত জাতিকে জাগানোর জন্য এম এন লারমাদের জন্ম হয়েছে। মাত্র ৪৩ বছরে ঊনাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। এম এন লারমা সেই ছাত্রজীবন থেকে, এবং আমরা সকলেই জানি, সেই সময়টাতে আরও অনেক প্রবীণ নেতৃত্ব ছিলো, আরও অন্যান্য যুব নেতৃত্ব ছিলো, কিন্তু কেউই তো বলেনি, কেউই তো প্রতিবাদ করেনি যে, কাপ্তাই বাঁধ মরণ ফাঁদ। এতে এক লক্ষ লোক উদ্বাস্তু হলো, ষাট হাজার লোক ভারতে পালিয়ে গেলো। এখনো যারা ভাসমান নাগরিক, নাগরিকত্ব পায়নি। অপরদিকে অর্থনীতির দিক দিয়ে বিশাল ক্ষতি হলো। আমাদের ৫৪ হাজার একর ধানি জমি পানির তলে তলিয়ে গেলো। এই প্রতিবাদ করার কারণে ওনাকে জেলে নিয়ে গেলো পাকিস্তান সরকার। আজকে এই বাঁধ থেকে এই মুহূর্তে ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। রাঙ্গামাটিতে লাগে ১২ থেকে ১৫ মেগাওয়াট। তখন বাঁধ দেয়ার সময় সরকার কী বলেছিলো? আপনাদের বিদ্যুৎ দেয়া হবে। কিন্তু কথা রাখা হয়নি। এখনো পর্যন্ত কোনো পাহাড়ি বা বাঙালিকে সেব্যাপারে কোনো কিছু বলতে শুনিনি। কেন আমরা প্রতিবাদী হই না? এই মহাগরমের দিনে বিদ্যুৎ এক ঘন্টা/দেড় ঘন্টা ছাড়া রাঙ্গামাটিতে থাকতে হয়। আমাদের কি প্রাণ নেই?’

তিনি বলেন, ‘লারমা মানে ইতিহাস, লারমা মানে লড়াই-সংগ্রাম। উনি সংসদে যেভাবে লড়াই করে গেছেন তাতে প্রসংশিত হয়েছেন সেটা সকলেই জানেন। উনি আন্দোলন করে গেছেন সেই অন্ধকার যুগে। গুটিকয়েক মানুষ উনারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পশ্চাদপদ সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন গ্রামে গিয়ে শিক্ষকতা করে। উনি যে চিন্তাবিদ, উনি যে দার্শনিক, উনি যে জ্ঞানী ও দেশপ্রেমিক সেটা প্রমাণ করেছেন মানুষকে ভালোবেসে। বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ যারা পেছনে পড়া, সর্বক্ষেত্রে অনুন্নত, এই জাতিসত্তাসমূহকে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ করা যায়-এই চিন্তা থেকে তিনি জুম্ম জাতিসত্তার কথাটি চিন্তা করতে পেরেছেন এবং এই জাতিসত্তাগুলোকে যা দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করা যায়, সেটা হল জুম্ম জাতীয়তাবাদ এবং আদর্শ থাকতে হবে মানবতাবাদ। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, এটা ছাড়া বিকল্প নাই বন্ধুরা। সংকীর্ণ স্বার্থকে যদি আমরা গুরুত্ব দিই, তাহলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো না। তাই আমাদের মহৎ হতে হবে, আমাদের উদার হতে হবে। সেইজন্য আমাদের ভুল চিন্তাধারা, সংকীর্ণ স্বার্থ, উচ্চাভিলাষ ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। কেবল নিজের নিজের স্বার্থ যদি দেখি তাহলে স্বার্থের সংঘাত হবে, আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো না।’

তিনি বলেন, এম এন লারমা তো শুধু জেএসএস নয়, এম এন লারমা শুধু পাহাড়ি বা জুম্মদের জন্য নয়, তিনি সারা বাংলাদেশের ও মানবজাতির জন্য এবং বাংলাদেশ সহ সারা বিশে^র নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। এম এন লারমাকে রক্ষা করতে পারি নাই সেটা আমাদের দূর্বলতা, সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য।

তিনি আরও বলেন, ‘যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং জ্ঞান আহরণ করতে হবে। আসুন, আমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই চুক্তি সরকার করেছে, এটা বৈধ চুক্তি, এই চুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চুক্তি। এই চুক্তি কোনো সরকার এক কলমের খোঁচায় মুছে দিতে পারবে না। এই চুক্তির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাই এই চুক্তি একদিন না একদিন আমরা বাস্তবায়ন করে ছাড়বো। এটা আমরা ছেড়ে দেবো না।’

বিশেষ অতিথি বিজয় কেতন চাকমা বলেন, ‘আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করতে হবে, এত রক্তের বিনিময়ে, এত জীবনের বিনিময়ে, আমাদের মা-বোনের ইজ্জত বলেন, আমাদের জুম্ম জনগণের ত্যাগ স্বীকার বলেন, সবকিছুর বিনিময়ে যা পেয়েছি, সেটা কেন ঠিকমত কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে, বিশ বিশটি বছর কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে, চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণের পর একটা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র স্বীকার করে নিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্থাৎ এই এলাকা জুম্ম আদিবাসী জনগণের, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, তাদের ভূমি, তাদের ভোটের অধিকার, তাদের জীবন-জীবিকার অধিকার, সেই অধিকারগুলো আমরা পেয়েছি। পাওয়ার পর আমরা কাজে লাগাতে পারছি না কেন?’

তিনি আরও বলেন, আমরা যদি এম এন লারমার জীবন-সংগ্রাম সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করতাম, তাহলে আমাদের জুম্ম আদিবাসী জনগণ এধরনের দুঃখ-দুর্দশায় থাকতো না। অনেক আগে আমরা আমাদের অধিকার অর্জন করে নিতে পারতাম। পারিনি, কারণ আমাদের কর্ম ঠিকমত হয়নি। তাই শুধু কথা নয়, শুধু বক্তৃতা নয়, লেখা নয়, নিজের জীবনে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে যদি কর্মমুখরিত করতে না পারি, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারি, নির্যাতনের, নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে ক্ষণিকের এই জীবন বৃথা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা যদি কাজ করতে না পারি, তাহলে আমাদের কোনো লক্ষ্যই সফল-সিদ্ধি হবে না।’

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সদর হিসেবে, প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর হিসেবে রাঙ্গামাটিতে একটি এম এন লারমার ভাস্কর্য রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন এবং এজন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো বললে তো হবে না। জ্ঞানের সাথে, সেই জ্ঞান হবে সত্যের, সেই জ্ঞান হবে ন্যায়ের, সেই জ্ঞান হবে মানবতার। আমরা যদি সত্যের জন্য লড়াই করি, ন্যায়ের জন্য লড়াই করি, নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করি, তাহলে আমরা জিতবো। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এমনি আসে নাই, জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে এসেছে। কাজেই জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে পাওয়া এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে আমরা বৃথা যেতে দিতে পারি না। এটাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেকের অঙ্গীকার, প্রত্যেকের সেক্রিফাইস দরকার।’

বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিশির চাকমা বলেন, একটি দেশ ও জাতি হিসেবে মাথা উচু করে বাঁচার জন্য তার দেশ, কাল, সমাজ, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, মূল্যবোধ এবং সামগ্রিকতার পরিবেশ-পরিস্থিতির জন্য সম্মানজনকভাবে, আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য বোধ হয় আবির্ভূত হয়েছিলেন এই এম এন লারমা। আমরা দেখেছি, সামন্ত শাসকদের সময়ে আমরা বঞ্চিত হয়েছি, নিপীড়িত হয়েছি, সমাজ গঠনে বাধাগ্রস্ত হয়েছি, শিক্ষা গঠনে বাধাগ্রস্ত হয়েছি, এসব থেকে আমাদের মুক্তির জন্য আমাদের সমাজকে মুক্ত করতে আবির্ভূত হয়েছেন এই নেতা। এজন্যই তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘তিনি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্টি গঠন করেছেন, প্রয়োজনে সংসদ সদস্য হয়েছেন, প্রয়োজনে সংসদ বর্জন করেছেন এবং প্রয়োজনে তিনি সশস্ত্র আন্দোলন করেছেন। তিনি শুধু আদিবাসী সমাজের কথা ভাবেননি বা বলেননি, তিনি সকল মেহনতি মানুষের অধিকারের, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কথা সংসদে উত্থাপন করেছেন, তারা দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকারের কথা উত্থাপন করেছেন। তিনি এই গুণের জন্য সবসমই সকল মানুষের কাছে মানবতার রূপ পেয়েছেন। তিনি সবসমই বলেছেন, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।’

অ্যাডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান বলেন, ‘এম এন লারমা পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত ১১টি জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি সারাবিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষদের এক মহানায়ক ও পথদ্রষ্টা। আজকে আমরা যদি এম এন লারমাকে ধরে রাখতে চাই তাহলে তার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। তাঁর শৈশব জীবন, কিশোর জীবন এবং রাজনৈতিক জীবন নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যদি এম এন লারমাকে সত্যিকারভাবে মনে রাখতে চাই, তাহলে তাঁর যে জন্মভূমি নানিয়াচর উপজেলার বুরিঘাট ইউনিয়নের মাওরুম এলাকায় তাঁর জন্মস্থান, সেখানে একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাই।’

শ্যামা চাকমা বলেন, ‘এম এন লারমার যে সংক্ষিপ্ত জীবন, এই সংক্ষিপ্ত জীবনে জাতির জন্য যে অবদান রেখে গেছেন তাঁর সেই ত্যাগকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আজ ৮৪তম জন্মদিন, আজ তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে জুম্ম জনগণ আজ অনেক কিছু পেতো। উনি ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে বিশ্বাসঘাতক চক্রদের দ্বারা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। তাঁর পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বিশ্বের সকল খেটে খাওয়া মানুষ ও অধিকারহীন মানুষদের নিয়ে যে চিন্তা-চেতনা ছিল তা দেখলে বুঝা যায় তিনি কত বড় মাপের চিন্তার মানুষ ছিলেন। ঘুঁণেধরা সমাজে নারীদের নিয়ে তাঁর যে চিন্তা তা অকল্পনীয়। তিনি নারী সমাজকে এগিয়ে নিতে অনেক অবদান রেখেছেন।’

সুমিত্র চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণ যুগ যুগ ধরে একদিকে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক বিজাতীয় শাসক-শোষক গোষ্ঠীর নির্যাতন-নিপীড়ন শিকার হয়ে আসছিল এবং তারই ধারাবাহিকতায় জুম্ম জনগণকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এম এন লারমা সেই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরোধীতা করায় তাকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার করা হয়। তৎকালীন সমাজের কেউ প্রতিবাদ না করলেও এম এন লারমা প্রতিবাদ করেছিলেন। এই কাপ্তাই বাঁধ যে জুম্ম জাতিকে বিলুপ্ত করার একটি প্রক্রিয়া সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘এম এন লারমার দেখানো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আজকের জুম্ম জনগণ এবং যুব-ছাত্র সমাজ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।’

থোয়াইক্যজাই চাক বলেন, ‘পার্বত্য জুম্ম ছাত্র/ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এম এন লারমা সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে, এম এন লারমার আদর্শ থেকে আমাদের শিখতে হবে। এম এন লারমা আজীবন বিপ্লবী চিন্তাধারা ও আদর্শ নিয়ে অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে গেছেন, সেই নীতি-আদর্শকে লালন করে তরুণ সমাজকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে অধিকতর আন্দোলনমুখী হতে হবে। তখনকার পশ্চাদপদ সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকেও আজকের জুম্ম জাতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসা এই মহান নেতার ত্যাগ, দূরদর্শী চিন্তার ফসল। তৎকালীন সামন্তীয় সমাজব্যস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজ পরিবর্তনের রূপকার এই মহান নেতা। এম এন লারমা ছিলেন অসীম সাহসী ব্যক্তি, বিচক্ষণ এবং আত্মবিশ্বাসী। তার অসীম সাহস, দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা আর লড়াই সংগ্রামের কারণে আমরা এই পার্বত্য চুক্তি পেয়েছি। এখন সেই চুক্তিটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব এই তরুণ সমাজকে নিতে হবে।’

শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘আমরা জানি কোনো বস্তুকে জানতে হলে সেই বস্তুর সংস্পর্শে আসতে হয়, ঠিক তেমনি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে যদি জানতে হয় তাঁর চেতনা, তাঁর আদর্শের সংস্পর্শে আমাদের আসতে হবে। আমরা যদি এম এন লারমা সম্পর্কে জানতে চাই, তাহলে তাঁর যে আদর্শ সেই আদর্শকে সুগভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে এবং সেই সাথে তাঁর আদর্শকে আমাদের ধারণ করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, এম এন লারমা শুধুমাত্র জুম্ম জনগণের জন্য নয়, তিনি সমগ্র বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য সংসদের বাইরে এবং ভেতরে তাদের অধিকারের কথা বলে গেছেন। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ভিন্ন ভাষাভাষির বসবাসের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের কথা সংসদে স্থান পাইনি। সংবিধান হচ্ছে এমন একটি ব্যাবস্থা যা অনগ্রসর জাতিসত্তাকে, নির্যাতিত জাতিসত্তাকে অগ্রসর জাতিসত্তার সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে পথ নির্দেশ করে। কিন্তু সেই সংবিধানে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকারের কথা স্থান পাইনি।’

আশিকা চাকমা তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা জানি ১৯৩৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর মহান নেতা এম এন লারমার জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ৮৪ বছর আগে। তাঁর জন্মস্থান বুরিঘাট মৌজার মাওরম গ্রামটি ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধটি নির্মাণের ফলে পানির তলে ডুবে যায়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে যে কথাটি না বললেই নয়, অধিকারহারা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করে গেছেন সেটি আমাদের ভুলে যাবার নয়। তিনি যে আদর্শের পথ দেখিয়ে গেছেন সেই আদর্শের পথে হেঁটে জুম্ম জনগণ এখনো পর্যন্ত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাঁর যে স্বপ্ন সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের খেটে খাওয়া জুম্ম জনগণ তথা তরুণ প্রজন্ম অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত হচ্ছে। আজকে এম এন লারমার জন্মবার্ষিকীতে শুধুমাত্র তাঁকে স্মরণ করলে হবে না বরং তাঁর জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘এম এন লারমার দেখিয়ে দেওয়া আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে হেঁটেই ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আজকে যদি আমরা এম এন লারমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চাই তাহলে আমাদের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ব্যতীত আমাদের কোনো পথ নেই।’

লংগদুতে আলোচনা সভা

একই দিন বিকাল ২ টায় রাঙ্গামাটি জেলাধীন লংগদু উপজেলার বগাচতর ইউনিয়নেও জনসংহতি সমিতির লংগদু থানা শাখার উদ্যোগে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জনসংহতি সমিতির লংগদু থানা কমিটির কৃষি ও ভূমি বিষয়ক সম্পাদক বিনয় প্রসাদ কার্বারির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতির লংগদু থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক মনি শংকর চাকমা, সমিতির লংগদু থানা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক যশু চাকমা, সমিতির চিবেরেগা গ্রাম কমিটির সভাপতি সুভাষ চাকমা, ১২নং গবছড়ি মৌজার হেডম্যান মুকুল কান্তি চাকমা, ৯নং মারিশ্যাচর মৌজার হেডম্যান সুনির্মল চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গীপাড়া গ্রাম শাখার সভাপতি সুমেজ চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির চিবেরেগা গ্রাম শাখার সভাপতি ধীমান চাকমা। সভায় সঞ্চালনা করেন তপন জ্যোতি চাকমা, সাবেক সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, লংগদু থানা শাখা।

সভায় নেতৃবৃন্দ এম এন লারমার শিখিয়ে যাওয়া আদর্শকে লালন করে জুম্ম জাতির অস্তিত্বকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে ছাত্র-যুব সমাজকে এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেন।