পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের বক্তব্য সর্বৈব ভিত্তিহীন

0
711

মঙ্গল কুমার চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে। একটা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সিকি শতাব্দীর অধিক সময় পার হলেও এখনো চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকার তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পরষ্পর বিরোধী মতামত দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, এই চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণের জন্য চুক্তিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি’ নামে একটি কমিটি রয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিধি হিসেবে কমিটির আহ্বায়ক এবং জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও চুক্তি মোতাবেক গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছে। অর্থাৎ এই কমিটিতে সরকারি পক্ষের দুইজন ও জনসংহতি সমিতির পক্ষের একজন প্রতিনিধি রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের এই কমিটি থাকা সত্ত্বেও সেই কমিটির মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়ন মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ না করে, বরঞ্চ সেই কমিটিকে বাদ দিয়ে এবং চুক্তির অন্যতম পক্ষ জনসংহতি সমিতির সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি মূল্যায়ন, অগ্রগতি ও পরিবীক্ষণ সংক্রান্ত আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি’ নামে একটি ১০ সদস্যক কমিটি গঠন করেছে, যা পার্বত্য চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করা যায়।

সরকারের এই আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি কর্তৃক ২৫ নভেম্বর ২০২২ তারিখের সভায় একতরফাভাবে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মতে, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৭টি ধারা হয় আংশিক বাস্তবায়িত, না হয় সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত রয়েছে। বিশেষ করে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং এসব পরিষদের নির্বাচনের জন্য স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ৬টি সেনানিবাস ব্যতীত সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা, ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের তাদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক পুনর্বাসন, অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি লীজ বাতিল, ভূমিহীন জুম্মদের ভূমি বন্দোবস্তী প্রদান, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সকল আইন সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ, সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।

নিম্নে পার্বত্য চুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা উত্থাপন করা গেল, যেগুলো সরকার ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে দাবি করছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা বাস্তবায়িত হয়নি:

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১নং ধারায় “পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ”- এর বিধান করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩ক উপ-অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। বস্তুত এই বিষয়টি বাস্তবায়নের সাথে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি; পাহাড়িদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ; আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ যথাযথভাবে কার্যকর করে পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ শাসনকাঠামো স্থাপন; পরিষদসমূহে সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি হস্তান্তরকরণ; প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন; স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন প্রভৃতি বিষয়াদি বাস্তবায়ন সম্পর্কযুক্ত। অথচ এই বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই এ ধারাটি বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বলা যেতে পারে না।

চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ২নং ধারায় এই চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলী, রীতিসমূহ পরিবর্তন ও সংশোধনের বিধান করা হয়। পার্বত্য চুক্তির এই ধারা অনুসারে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ সংশোধন করার মাধ্যমে এই ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে মর্মে সরকার দাবি করে আসছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য এখনো অনেক আইন রয়েছে যেগুলো পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক সংশোধন করা অত্যাবশ্যক। যেমন- পার্বত্য চুক্তির এ বিধান কার্যকর করার জন্য ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন, ১৯২৭ সালের বন আইন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন করা অপরিহার্য। চুক্তি মোতাবেক আইন সংশোধনের জন্য ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর মাধ্যমে কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এখনো সেসব আইন সংশোধন করা হয়নি। কাজেই এ ধারাটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমত সঠিক নয়।

পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খন্ডে পার্বত্য জেলা পরিষদ সংক্রান্ত ৩৫টি ধারার মধ্যে ৩৩টি ধারা পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে সংযোজনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু আইনে সংযোজিত হলেও সেগুলো এখনো কার্যকর করা হয়নি। যেমন “অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা” সংজ্ঞা সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩নং ধারা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সত্য, কিন্তু কার্যকর করা হয়নি। উক্ত ধারা লঙ্ঘন করে ২১/১২/২০০০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক অফিসাদেশের মাধ্যমে সার্কেল চীফের পাশাপাশি ডেপুটি কমিশনারদেরও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা প্রত্যাহারের জন্য বার বার দাবি করা সত্ত্বেও প্রত্যাহার করা হয়নি।

‘ভোটার হওয়ার যোগ্যতা ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন’ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৯নং ধারাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে সংযোজিত করা হলেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ বিধান কার্যকর করার জন্য ভোটার তালিকা বিধিমালা ও নির্বাচন বিধিমালা আজ অবধি প্রণীত হয়নি। কাজেই এ বিধান ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমত সঠিক নয়। অপরদিকে “নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ” সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ১০নং ধারাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তভুর্ক্ত করা হলেও এখনো “নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ” করা হয়নি।

‘পার্বত্য জেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও তদনিম্ন স্তরের সদস্য নিয়োগ বদলি’ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ২৪নং ধারাটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। এ বিধানটি আইনে অন্তভুর্ক্ত হলেও আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে কার্যকরী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ ও ‘আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ বিষয় হস্তান্তর করা ও পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী গঠন করার বিধানসমূহ এখনো কার্যকর করা হয়নি।

পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতীত ভূমি বন্দোবস্তী, হস্তান্তর, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা প্রদান, অধিগ্রহণে বিধিনিষেধ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ২৬নং ধারাটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। বস্তুত বিধানটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও ইহা কার্যকর করা হচ্ছে না। চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩৪(ক) ধারা মোতাবেক ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’ বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন অন্যতম একটা বিষয়। কিন্তু আজ অবধি উক্ত বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি। হেডম্যান, চেইনম্যান, আমিন, সার্ভেয়ার, কানুনগো ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)-দের কার্যাদিও পার্বত্য জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সংক্রান্ত চুক্তির ‘গ’ খন্ডের ১৪টি ধারার সবক’টি আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এ সংযোজনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। অথচ আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয় সাধন করাসহ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন ও ইহাদের উপর অর্পিত বিষয়াদি সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করার বিধানাবলী আঞ্চলিক পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও আঞ্চলিক পরিষদের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করার ক্ষমতা কার্যকর করা হয়নি। এ যাবৎ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ যাবতীয় বিষয়াদি তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করা যাচ্ছে না।

অনুরূপভাবে তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃংখলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান করার বিধানটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও কার্যকর করা হয়নি। তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারগণ অপারেশন উত্তরণের পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ অনুযায়ী পূর্বেকার মতো জেলার সাধারণ প্রশাসন সম্পর্কিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন। তাই আঞ্চলিক পরিষদ সংক্রান্ত সবক’টি ধারা সম্পূর্ণ ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমত সঠিক নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে আঞ্চলিক পরিষদের প্রাধিকার সংক্রান্ত চুক্তির ‘গ’ খন্ডের ১৩নং ধারা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনে সংযোজনের মাধ্যমে ধারাটিকে বাস্তবায়িত বলে মনে করে সরকার। বস্তুত চুক্তির এই ধারা অনুসরণ করা হচ্ছে না। আইন প্রণয়নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদের মতামত নেয়া হয় না কিংবা নেয়া হলেও আঞ্চলিক পরিষদের মতামত কার্যকর করা হয় না।

‘ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত’ চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১নং ধারাটি বাস্তবায়িত হয়েছে মর্মে সরকার দাবি করছে। কিন্তু জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির মতে, ৯,৭৮০ পরিবার তাদের ভিটেমাটি ও জায়গা-জমি ফেরৎ পায়নি ও অন্যান্য দাবিসমূহ বাস্তবায়ন করা হয়নি। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ৪০টি গ্রাম, ভিটে-মাটি ও জায়গা-জমি এখনো সেটেলার বাঙালিদের পুরো দখলে রয়েছে। তাই এ বিধান ‘সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমত সঠিক নয়।

‘ঘ’ খন্ডের ১নং ধারায় বর্ণিত ‘তিন পার্বত্য জেলার আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের নির্দিষ্টকরণ করে টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা’ সংক্রান্ত বিষয়টিও ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যা সঠিক নয়। ২৭ জুন ১৯৯৮ তারিখ খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত টাস্ক ফোর্সের তৃতীয় সভায় পার্বত্য জেলার আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু বলতে যে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় তদনুসারে ২০০০ সালে আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু হিসেবে ৯৩ হাজার পাহাড়ি পরিবারকে পরিচিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাদেরকে স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সংক্রান্ত তিন ধারার মধ্যে সরকারের প্রতিবেদন অনুসারে ৪নং ধারাটি ‘আংশিক বাস্তবায়িত’, ৫নং ধারাটি ’বাস্তবায়িত’ এবং ৬নং ধারাটিও ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে। তাহলে সরকারের মতে ভূমি কমিশন সংক্রান্ত তিনটি ধারার মধ্যে মাত্র একটি ধারার বাস্তবায়ন ‘আংশিক’ বা অর্ধেক বাকি রয়েছে। অথচ বিগত ২৬ বছরেও একটি ভূমি বিরোধও নিষ্পত্তি হয়নি। বেহাত হওয়া একখন্ড ভূমিও জুম্মরা ফেরত পায়নি।

উল্লেখ্য যে, গত ৬ অক্টোবর ২০১৬ জাতীয় সংসদে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ পাশের মধ্য দিয়ে ১৫ বছর পর ২০০১ সালে প্রণীত ভূমি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের বিধিমালার খসড়া তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো সেই বিধিমালা চূড়ান্ত করেনি। এর ফলে ভূমি কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। এছাড়া ভূমি কমিশনের নেই পর্যাপ্ত তহবিল, জনবল ও পারিসম্পদ।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৭-১৯৯৯ সালে পাঁচ শতাধিক ক্যাম্পের মধ্যে দুই দফায় মাত্র ৬৬টি অস্থায়ী ক্যাম্প এবং ২০০৯-২০১৩ সালের মেয়াদকালে ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়েছে। তবে প্রত্যাহৃত অনেক অস্থায়ী ক্যাম্প পুনর্বহাল করা হয়েছে। তার মধ্যে কেবল কোভিড-১৯ মহামারী কালে কমপক্ষে ২০টি ক্যাম্প পুন:স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ৫৪৫টি অস্থায়ী ক্যাম্পে মধ্যে ১০১টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হলেও এখনো প্রায় চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্যাঞ্চলে বলবৎ রয়েছে। অধিকন্তু পূর্বের ‘অপারেশন দাবানল’ এর পরিবর্তে ১ সেপ্টেম্বর ২০০১ হতে সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি করা হয়। এই ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পর্যটন, উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনা কতৃর্পক্ষ সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির তারতম্যের ক্ষেত্রে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি’র মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের অবস্থা মূল্যায়ন করে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে এবং এই পরষ্পর বিরোধী মতামতের সমাধান হতে পারে।

বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের অমুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। পার্বত্য চুক্তির যথাযথ, পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার টেকসই তথা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে।