পার্বত্য চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ মহামারীর চেয়ে ভয়ানক সরকারের ষড়যন্ত্র ও দমন-পীড়ন: জেএসএস

0
1264

হিল ভয়েস, আগস্ট ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম:

যতই দিন যাচ্ছে ততই কোভিড-১৯ মহামারীর চেয়ে ভয়ানক ও বিপর্যয়কর হয়ে দেখা দিচ্ছে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জুম্মদের উপর চাপিয়ে দেয়া ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, দমন, পীড়ন, বৈষম্য, অবিচার, আগ্রাসন ও নৃশংসতা। আজ ৪ আগস্ট ২০২০ মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত “জুলাই ২০২০: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর মাসিক প্রতিবেদন”-এ এ অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে।

জনসংহতি সমিতির জুলাই ২০২০ মাসের প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে, দেশে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থা প্রায় চার মাস অতিক্রান্ত হতে চললেও ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় এখনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থার সুযোগে সরকারের অভ্যন্তরে ও সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর যে দৌরাত্ম্য, অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তা যেন আরও বেপরোয়া রূপ ধারণ করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক এবং আদিবাসী জুম্মদের সামগ্রিক অবস্থা আরও বিপর্যয়কর। বিশ্বের অন্যতম ও দেশের সবচেয়ে সেনা-অধ্যুষিত ও সেনাশাসিত এলাকা হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বরাবরই জুম্ম জনগণের অধিকার ভূলুন্ঠিত  গণতন্ত্র বিপন্ন। সাড়ে চার দশক ধরে সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে, কায়েমী স্বার্থবাদীদের লুটপাটে ও বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী সেটেলারদের আগ্রাসনে থেকে আদিবাসী জুম্মদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা সবসময় অনিশ্চয়তা ও বিপর্যয়ের মধ্যে চলেছে। একের পর এক শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার কারণে জুম্মদের নিরাপত্তা, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক শাসন  আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিনিয়ত ভূলুন্ঠিত ও হরণ করা হয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মরা বরাবরই প্রান্তিক এক জনগোষ্ঠী হয়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এই অঞ্চলে শান্তি ও অগ্রগতি এবং জুম্মদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষীণ আলো দেখা গেলেও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় তা আজ সুদূর পরাহত হয়েছে। বিগত ২৩ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং উপরন্তু সরকারের চুক্তি বিরোধী ভূমিকায় পাহাড়ের জুম্মদের অধিকার ও জীবনধারা আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই কোভিড-১৯ মহামারীর চেয়ে ভয়ানক ও বিপর্যয়কর হয়ে দেখা দিচ্ছে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জুম্মদের উপর চাপিয়ে দেয়া ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, দমন, পীড়ন, বৈষম্য, অবিচার, আগ্রাসন ও নৃশংসতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আজ জটিল হয়ে উঠেছে এবং জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব ক্রমাগত বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

[pdf-embedder url=”https://hillvoice.net/wp-content/uploads/2020/08/PCJSS-Monthly-Report-july-2020-2.pdf” title=”PCJSS Monthly Report-july 2020 (2)”]

সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী, বিজিবি, ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং সরকারের মধ্যেকার কায়েমি স্বার্থবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করে চলেছে। সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী পার্বত্য চুক্তির ধারা ও চুক্তির আলোকে সৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনকে প্রতিনিয়ত লংঘন করে চলেছে। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিপীড়ন ও নির্যাতন যেমন জোরদার হয়েছে, তেমনি সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অপহরণ বাণিজ্য ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির টাকার একটি অংশ সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তারাও নিয়মিতভাবে পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সাম্প্রতিককালে সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণের নামে এবং এসব বাহিনীর সহায়তায় সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক নতুন করে জুম্মদের ভূমি বেদখল ও বেদখলের প্রচেষ্টা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে বহিরাগত বিভিন্ন ব্যক্তি, কোম্পানি, এমনকি সরকারী প্রশাসনে দায়িত্বশীল ব্যক্তিও বেআইনীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ক্রয়, বেদখল এবং পাহাড় কর্তন ও বন ধ্বংসসহ পরিবেশ বিধ্বংসী বিভিন্ন কর্মকান্ড প্রশাসনের চোখের সামনেই অবাধে চলছে। সবাই যেন পাহাড় দখল, ধ্বংস ও পাহাড়ি জুম্মদের উচ্ছেদের উৎসবে মেতে উঠেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ও পাহাড়ের বিশেষ সামরিকায়িত বাস্তবতার কারণে কেউ প্রতিবাদ, মতপ্রকাশ বা সমাবেশ করতে পারছে না।

জুলাই ২০২০ মাসে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক ১ জুম্ম নারী নিহত ও ১ শিশু আহত হয়েছেন, গ্রেফতার ও আটক হয়েছেন ১৬ জন, অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১ জন, হয়রানির শিকার হয়েছেন ২ জন। এছাড়া বাড়ি তল্লাসী এবং সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-কে সন্ত্রাসী কাজে মদদদান অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে পার্বত্য চুক্তি ও আইনকে লংঘন করে নতুন ক্যাম্প স্থাপন ও ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে বিজিবি ও সেনাবাহিনী কর্তৃক জুম্মদের জায়গা দখল করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মাসে বিজিবি কর্তৃক অন্তত ২৩ জন জুম্ম মালিকানাধীন প্রায় ৩৩ একর এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক একটি মাছের পুকুরসহ ১০ জন পাহাড়ির ভূমি দখলে নেয়ার পাঁয়তারা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অপরদিকে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পূর্বের মতই অব্যাহত রয়েছে এবং আরও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। খোদ সেনাবাহিনীর এস্কর্ট নিয়ে এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে চলেছে। জুলাই ২০২০ মাসে এইসব সন্ত্রাসীদের দ্বারা অন্তত ২ জন আহত, ১০ জনকে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, ২১ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, ৮ জনকে হুমকি ও এলাকাছাড়া করা, ৬ বাড়িতে তল্লাসী, ১ জনকে মারধর, ২ বাড়িতে লুটপাট করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

বস্তুত ২৩ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ডের কারণেই এই বেপরোয়া ও অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই যে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায় বলে জনসংহতি সমিতির মাসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।