দেশভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্যের ইতিহাস

0
2620

             প্রধীর তালুকদার (রেগা)             

ভূমিকা:
অতি সম্প্রতি রাঙ্গামাটি থেকে জনৈক নিখিল চাকমা এক উদ্যোগ নিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়মবহির্ভূতভাবে পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিকে পুনর্জাগরিত করে ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা বিবেচনায় রেখে যেন বৃটিশ সরকার আন্তর্জাতিক পরিসরে নীতিগতভাবে হস্তক্ষেপ (ইন্টারভেনশন) করে সেই আবেদন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া।

বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে লিখিত আবেদনে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট উপমহাদেশ বৃটিশ উপনিবেশ মুক্ত হলে ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ার নীতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংগত কারণে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬০ সালে বৃটিশ উপনিবেশের প্রারম্ভ পর্যন্ত স্বাধীন অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামকে অগণতান্ত্রিকভাবে, অযৌক্তিকভাবে এবং অন্যায়ভাবে বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার সিরিল রেডক্লিফ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্ভুক্ত করেন। ফলে ২০ শে আগস্ট, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান পার্বত্য চট্টগ্রামকে নির্বিঘ্নে গ্রাস করে নেয়। কাজেই তখনই আজকের বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উত্তরাধিকারে পাওয়া উপনিবেশে পরিণত হওয়ার বীজ রোপিত হয়ে যায়। পরবর্তী ইতিহাস, লক্ষ লক্ষ সমতলের মুসলিম জনগণকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর, ক্রমান্বয়ে জুম্ম জনগণের উপর গণহত্যা, ভূমি বেদখল, ধর্ষণ আর চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অব্যাহত ঘটনাপ্রবাহ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অভ্যুদয়, বৃটিশ উপনিবেশের পরিসমাপ্তি হলেও আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বৃটিশ উপনিবেশের রেখে যাওয়া ভুলের মর্মান্তিক পরিণতি ভোগ করে চলেছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা এখানকার অধিবাসীদের সীমিত মাত্রায় স্বশাসন অনুমোদন করলেও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার তাও বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বরং সামরিক শাসন জারি রাখা, অব্যাহতভাবে জনসংখ্যাগত আগ্রাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সংখ্যালঘুদের জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংসের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি এই ঐতিহাসিক বিষয়টা নিয়ে অনেকেই সরগরম হচ্ছে। চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (সি এন সি আই) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে মিজোরাম, ত্রিপুরা আর অরুণাচলের কতিপয় সংগ্রামী নেতৃত্ব সমগ্র ভারতীয় চাকমাদের মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশের চাকমাদের স্বার্থ সম্পর্কিত অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠা ও সেই যুগের রাজনৈতিক ভুলের কারণে চাকমাদের ভোগান্তি নিয়ে জোরালো আন্দোলন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে। ১৭ই আগস্টকে চাকমাদের কালো দিবস হিসেবে পালনের ডাক দিয়েছে এই চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামেও এই অতীত নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি ঔপনিবেশিক বিরোধের নাম। অত্র অঞ্চলের আদিবাসী জনগণের নিজেদের হারানো স্বশাসন পুনার্জন এর অধিকার পাওয়া এখন সময়ের দাবি। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান করা ঐতিহাসিকভাবে যুক্তিযুক্ত, আইনগতভাবে প্রযোজ্য আর রাজনৈতিকভাবে জরুরি। তার আবেদনের প্রতিক্রিয়ায় অনেকে ব্যক্ত করছেন, বাংলাদেশ আজ আর আমাদের জন্য কোনভাবেই নিরাপদ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু বৌদ্ধ, হিন্দু এবং খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের পরিচয় ও সম্মান নিয়ে সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগণের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচতে চাইলেও আজকের চলমান রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের নিষ্পেষণ ও জাতিগতভাবে  অত্যাচার-নিপীড়নের পরিস্থিতির কারণে তা আদৌ দীর্ঘকাল এতদ অঞ্চলে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা তাদের আর সম্ভব নয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে এখন আমাদের হয়তো ভারতে নয়তো বার্মায় চলে যাবার চাপ সৃষ্টির পায়তারা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে আমরা নিজেদের স্বদেশ হিসেবে দেখতে চাইলেও এ দেশ আর আমাদের নাগরিক হিসেবে দেখছে না, এমনই পরিস্থিতি এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান।

পটভূমি:
সুদীর্ঘকাল ধরে ১৪০০০ বর্গ কিলোমিটারের পার্বত্য চট্টগ্রাম অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের মধ্যে ১১টি ভিন্ন ভাষাভাষীর আবাসভূমি হয়ে স্বাধীনভাবে শাসিত হয়ে আসছিল। এখানের অধিবাসীদের সম্মিলিতভাবে ‘জুম্ম’ নামেই অভিহিত করা হয়। তবে বর্তমানে এই পার্বত্যাঞ্চলে ঐতিহাসিক আধিপত্যের বিচারে এখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু জুম্মজনগণ এখন আদিবাসী বা ইন্ডিজেনাস পিপলস নামেও নিজেদের জাতীয় পরিচয়কে আখ্যায়িত করতে চায়।

বৃটিশ ১৭৫৭ সালে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পলাশীর (যা বর্তমান ভারতের পশ্চিম বঙ্গে অবস্থিত) যুদ্ধে পরাজয়ের পর এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা তাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব হারায় ১৮৬০ সালে। বৃটিশ আধিপত্যের ক্রান্তিলগ্নে ভারত উপমহাদেশটি ধর্মীয় ভিন্নতা অনুসারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান ও অমুসলিম গরিষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ ইন্ডিয়া বা ভারত-এই দুই দেশে বিভক্ত হয় ১৯৪৭ সালে। ৯৮% অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি করে এসময় স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে এক আন্দোলন সংগঠন করা হয়। তথাপি ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির নীতিকে অবহেলা করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার সিরিল রেডক্লিফ পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই পার্বত্য অঞ্চলটিকে দখল করে নেয়।

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে সেই পূর্ব পাকিস্তান আবার বাংলাদেশ নামে নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপলাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম তাই আজ পর্যন্ত সেই বাংলাদেশেরই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আধিপত্যবাদের করতলে নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে। এভাবেই ১৯৪৭ সালের পর থেকে প্রথমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পরে নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন উত্তরাধিকার হিসেবে আরেক নয়া উপনিবেশে পরিণত হয়ে রয়েছে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আবির্ভাবের পরবর্তী সময়ে বৃটিশের সকল উপনিবেশগুলি পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। সেই বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে স্বতন্ত্র একটি শাসন বহির্ভূত অঞ্চল বিধায় নতুন বাংলাদেশের মধ্যে আরেক উপনিবেশে শাসিত হওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। আজ তাই পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির শাসন কাঠামোয় নিপীড়নের উপনিবেশ বা আধিপত্যের করালগ্রাস মুক্ত করে জুম্ম জনগণের যথার্থ স্বাধিকার ফিরিয়ে দেয়া ঐতিহাসিকভাবে যুক্তিযুক্ত, আইনগতভাবে প্রযোজ্য এবং রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজন।

১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট পাকিস্তান ও ভারতকে বিভক্তির সীমারেখা নির্ধারণে রেডক্লিফ লাইন প্রকাশিত হয়। রেডক্লিফ লাইন নামে এই বিভক্তি সীমার লাইন পরিগণিত হয় তার রূপকার স্যার সিরিল রেডক্লিফের নামানুসারে যিনি বেঙ্গল বাউন্ডারী কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। যিনি ৮৮ মিলিয়ন জনগণ অধ্যুষিত ১৭৫,০০০ বর্গমাইলের এলাকাকে বিভক্ত করার দায়িত্বে ছিলেন ।

রেডক্লিফ এওয়ার্ড অনুসারে ভারত বিভক্তির চিত্র বামদিকে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির সময় শরণার্থীদের স্থানান্তরের চিত্র ডানদিকে দেখানো হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই জুলাই, বৃটিশ সংসদে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স এ্যাক্ট ১৯৪৭ (ভারত স্বাধীন আইন) চুড়ান্ত করা হয় যে, এক মাস পরেই ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ এ ভারতে বৃটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটবে। এই আইনের অধীনে এটিও নির্ধারিত হয় যে, ভারত উপমহাদেশকে ভাগ করে ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া এবং ডোমিনিয়ন অব পাকিস্তান নামক দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হবে। ভারত বিভক্তির পূর্বে সমগ্র উপমহাদেশের প্রায় ৪০% অঞ্চল ছিল প্রিন্সলী স্টেটস বা রাজা শাসিত এলাকা। এগুলি ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সাবসিডিয়ারী এলাইয়েন্স-এর মতো। এ রাজ্যগুলি কোন বৃটিশের শাসিত নয় বা বৃটিশের অংশও নয়, তারা আভ্যন্তরীণভাবে স্বাধীন। সুতরাং বৃটিশ তাদের যেমন স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়নি তেমনি ভাগও করে দিয়েছে দেশভাগের সময়। ভারত স্বাধীন আইন সেই সকল রাজা শাসিত রাজ্যগুলিকে বৃটিশ করায়ত্বের বহির্ভূত বিষয় হিসেবে রেখে দিয়েছিল এবং সেভাবেই বৃটিশের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটায়।

কাজেই ত্রিপুরার মতো এমন রাজ্যগুলি নব গঠিত দুই দেশে অন্তর্ভুক্ত হবে নাকি নিজেরাই স্বাধীনভাবে থাকবে তা নিজেরাই ঠিক করার স্বাধীনতা পায়। এসময় দু’ একটি বাদে অনেকেই ভারত বা পাকিস্তানে নিজেদের অস্তিত্ব বিলিয়ে দেয়। পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে আর নতুন ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বৃটিশ সাম্রাজ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরের প্রদেশগুলি পাকিস্তানের মূল ভূখন্ডের কাঠামো হিসেবে গঠিত হয়। ৯১.৮ % বেলুচিস্থান এবং ৭২.৭ % মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সিন্ধু প্রদেশ সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানেই অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে উত্তর-পূর্বের ৫৪.৪ % (মুসলিম) বেঙ্গল এবং উত্তর-পশ্চিমের ৫৫.৭ % (মুসলিম) পাঞ্জাব সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে মুসলিম অধ্যুষিত না হওয়ার কারণে দু’টি প্রদেশ পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পূর্বাংশ ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্যে ঢুকে যায়, যা পরে ছোট পাঞ্জাব রাজ্য ও অন্য দু’টি রাজ্যে গঠিত হয়। এদিকে বেঙ্গলের পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তানে ও পশ্চিম বাংলা ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে বিভক্ত হয়ে যায়। ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আফগানিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা ডুরান্ড লাইন দ্বারা নির্ধারিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল প্রদেশ গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানে চলে যায়। এই গণভোটের অন্তর্ভুক্তি বহুজনসমর্থিত পুকথুন আন্দোলনের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত হয়, যদিও সেই প্রদেশ এখন পাকিস্তানের খাইবার পাকথুকোয়া হয়ে রয়েছে।

পাঞ্জাবের জনবসতি এমনভাবে বিস্তৃত যে সেখানে হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ জনসংখ্যা বিচারে বিভক্ত করা চলে না । ফলে মহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বের মুসলিমলীগ, জওহরলাল নেহেরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস, এমনকি বৃটিশের দ্বারাও এ বিষয়ে কোন সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি। অধিকন্তু, ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক বিভক্তি করতে হলে সরাসরি সড়ক বা রেল যোগাযোগ, চাষাবাদের প্রকল্প, বৈদ্যুতিক পাওয়ার লাইন এমনকি ব্যক্তি বিশেষের জমির উপরই বিভক্তি লাইন টানতে হয়। কাজেই সুচিন্তিত একটি লাইন কৃষকদের নিজস্ব ভূমি থেকে পৃথক হওয়া বা অনিচ্ছাকৃত বা জোরপূর্বক জনস্থানান্তরের সমস্যাকে অনেকাংশে প্রশমিত করতে পারে।

জানা মতে, সমগ্র উপমহাদেশের প্রায় ১৪ মিলিয়ন মানুষ তাদের ঘরবাড়ি বা জীবিকার সমস্ত কিছু ফেলে বিমান, ট্রেন বা সড়ক দিয়ে যে যেভাবে পারে দুই দেশে স্বইচ্ছায় স্থানান্তরিত হয়েছে। অনেকে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে বা সর্বশান্ত হয়েছে। কলেরা, ডায়রিয়া জাতীয় নানা সংক্রামক রোগেও কম করে হলেও ২ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে।

দেশ ভাগের পদ্ধতি ও মুখ্য কর্তারা:
ইতিমধ্যেই ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পূর্বে ভারতে নিযুক্ত বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি (ভিসরয় অব ইন্ডিয়া) লর্ড ওয়াবেল দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে একটি খসড়া তৈরি করে ফেলেছিলেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে কোন অঞ্চল কোন অংশে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে তা ঠিক করার জন্য বৃটিশ সরকার স্যার সিরিল রেডক্লিফকে বেঙ্গল ও পাঞ্জাবের দুইটি বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্তি দেয়। পাঞ্জাবের দুই মুসলিম এবং অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের সন্নিহিত অংশের ভিত্তিতে সীমান্তরেখা নির্ধারণে কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়। এই সীমান্ত নির্ধারণ করতে গিয়ে অবশ্য অন্য কিছু বিষয়ও (ফ্যাক্টর) বিবেচনায় রাখা হয়, যে বিষয়গুলি কোন সুনির্দিষ্ট ছিল না যা কিনা রেডক্লিফকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। তবে প্রাকৃতিক সীমা, যোগাযোগ, নদীপথ, চাষাবাদের সেচ প্রণালী এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলিও বিবেচনার বিষয় ছিল। প্রতি কমিশনে ৪ জন প্রতিনিধি ছিল। ২ জন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে ও ২ জন মুসলিমলীগ থেকে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে রেডক্লিফই সর্বেসর্বা একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৪৭ সালের ৮ই জুলাই ভারতে আগমনের পর দেশভাগ সম্পন্ন করা বা সকল প্রকার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার জন্য রেডক্লিফকে দেয়া হয় মাত্র ৫ সপ্তাহ সময়। তাই তিনি তাড়াহুড়ো করে মাউন্টব্যাটেনসহ কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের সাথে দেখা করতে লাহোর ও কোলকাতা চলে যান। দেখা করেন কংগ্রেসের নেহেরু ও মুসলিমলীগের জিন্নার সাথেও। রেডক্লিফ সময় সংকীর্ণতার কথা বলে আপত্তি করলেও দুই পক্ষ জোরালোভাবে চাপ দিচ্ছিল যাতে ১৫ আগস্টের মধ্যে সীমান্ত লাইন চূড়ান্ত হয় এবং বৃটিশ ভারত ছেড়ে চলে যায়। ভাইসরয় হিসেবে মাউন্টব্যাটেন নিযুক্তি গ্রহণ করেছিলেন এক শর্তে যে, সময় থাকতে তাকে নিযুক্ত করতে হবে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, তার নিযুক্তি চুড়ান্ত হয় মাত্র কিছু দিনের মধ্যে যা কিনা রাজনৈতিক কারণে ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের দুই দিন পর অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট অবধি অপ্রকাশিত ছিল।

কমিশনের সদস্য, সীমান্তের সীমারেখা নির্ধারণ পদ্ধতির সমস্যা ও রেড ক্লিফ লাইনের পাঞ্জাব অধ্যায়:
প্রতিটি বাউন্ডারি কমিশন চেয়ারম্যান রেডক্লিফ সহ ৫ সদস্যের ছিল। বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনে ছিলেন জাস্টিজ সি সি বিশ্বাস, বি কে মুখার্জী, আবু সালেহ মোহম্মদ আকরাম এবং এস এ রহমান। পাঞ্জাব কমিশনে ছিলেন জাস্টিজ এম চান্দ মহাজন, তেজা সিং, দীন মোহাম্মদ এবং মোহম্মদ মুনীর। কমিশন সদস্যদের সবাই আইনজ্ঞ হলেও কিন্তু সীমান্ত নির্ধারণের বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা কারোর ছিল না বললেই চলে। এমনকি তাদের সীমান্ত লাইন টানার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য বা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি নিয়ে বা তথ্য নিয়ে তাদের পরামর্শ যোগানোর জন্যও কোন এক্সপার্ট ছিলেন না। কোন আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক তথ্য উপাত্ত বা জরিপ নেয়ার সময় পর্য্যন্ত ছিল না। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (ইউনাইটেড নেশনস) ন্যায় অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা এবং বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি খুবই জরুরি ছিল এই ক্রুশিয়াল দিন গুলোতে। তদুপরি বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ও ঋণী বৃটেনের নব গঠিত লেবার সরকার তার সাম্রাজ্যের ক্রমাগত অস্থিতিশীলতার কারণে এসব নিয়োগ করার বা গভীরভাবে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে অসমর্থ ছিল বলা যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-জাতিসংঘের মতো বাইরের বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতি বরং তাড়াহুড়োতে দেশভাগের কর্ম সম্পাদন করে ফেলায় উপনিবেশকারী বৃটিশ সরকারের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল। অনেক অঞ্চলে সীমান্ত নির্ধারণজনিত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য বৃটিশ সরকারের তাড়াহুড়ো করারও প্রয়োজন ছিল।

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব:
বাউন্ডারি কমিশনে ইন্ডিয়ান জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিমলীগের তরফে সমান প্রতিনিধিত্ব সম্ভবত সমতা বজায় রাখার জন্য হলেও মূলত তা সংকট সৃষ্টি করেছিল। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক এতটাই খারাপ ছিল যে, কমিশনের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাই বলেননি। এমনিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বাদে অন্যান্য সীমান্ত সমস্যা বা দাবিদাওয়াগুলি মনোযোগ দিয়ে আলোচনা করার অবকাশই ছিল না। এমনকি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে পাঞ্জাব বর্ডার কমিশনের শিখ সদস্যের (জাজ) পত্নী ও দুই শিশুকে রাওয়ালপিন্ডিতে মুসলিম উগ্রবাদীরা খুন করেছিল। তবে বিভক্তি লাইনে হিন্দু এবং মুসলিমদের যথাযথ এলাকায় সরিয়ে সাম্প্রদায়িক অসমতা দূর করে সামঞ্জস্য রক্ষা করাই কেবল মূখ্য বিষয় ছিল না। পাঞ্জাব বর্ডার কমিশনের ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেছে, শিখ সম্প্রদায়ের বাড়িঘরের মধ্যদিয়ে বিভক্তি সীমারেখা টানতে হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ ইন্ডিয়ান আর্মিতে বৃটিশের হয়ে অবদান রেখেছে বিশেষত তাদের বিষয়ে বিবেচনা করতে সুযোগ না থাকায় লর্ড ইজলে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। শিখদের মধ্যে যাদের মুসলিম শাসিত পাকিস্তান রাজ্যে পরার সম্ভাবনা ছিল তারা বিদ্রোহ করেছিলেন অনেকে। কিছু কিছু আবার তাদের নিজস্ব স্বাধীন ভূমির দাবি করেছিলেন। অবশেষে প্রতিনিধিত্বহীন সম্প্রদায়গুলির চাওয়া পাওয়া নিয়ে হয়ে যায় মনোযোগহীনতার মতো দায়সারা গোছের সিদ্ধান্তহীনতা। কোলকাতা কার ভাগে যাবে তা নিয়েও বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিল বড় সংশয়। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্প্রদায়গুলি সরকারিভাবে প্রতিনিধিত্বহীনতার বা শাসন বহির্ভূত বা এক্সক্লুডেড অঞ্চল হিসেবে ধরে নেয়ার কারণে দেশ ভাগের দুই দিন পরও নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে থেকে যায় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত (আনকনসাল্টটেড)। আর এতে করে কংগ্রেস বা বাউন্ডারি কমিশন রয়ে যায় একেবারেই দায়িত্বহীন। মতামতহীন সিদ্ধান্ত ও দ্রুত নিষ্পত্তির অজুহাতে রেডক্লিফ একাই সব কিছুর ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে বা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি বা অভিযোগ শোনার অবকাশ ছিল না বলেও রেডক্লিফ নিজে সন্দেহাতীতভাবে তার দায়িত্ব দ্রুত সম্পাদন করেন।

স্থানীয় বিষয়ে অজ্ঞতা:
রেডক্লিফ বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্তির পূর্বে কখনো ভারতে আসেননি এবং এখানকার কাউকে চিনতেনও না। তাই তিনি যে নিজের দেশ বৃটেন ছাড়া এখানকার কোন পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না সেটাই ছিল আসল কথা। কেবলই তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি ক্রীস্টোফার বিয়েমন্ট পাঞ্জাবের প্রশাসন ও জীবন সর্ম্পকে জানত। নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে রেডক্লিফ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের সংস্পর্শ থেকেও নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। সুতরাং স্থানীয় সমস্যা বা ভৌগলিক কিংবা রাজনৈতিক অবস্থা সর্ম্পকে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকার কারণে সম্পূর্ণভাবে বিরোধহীন বিভক্তি সীমা লাইন এঁকে ফেলা রেডক্লিফের মোটেই সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে পাঞ্জাব এবং বেঙ্গলে চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা, ঝঞ্জাহীনভাবে বৃটিশের এদেশ থেকে দ্রুত ও সম্মানজনকভাবে বিদায় নেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় এমনিতে উপনিবেশ উত্তর অস্থিতিশীলতার বীজ আগেই রোপিত হয়ে গিয়েছে।

দ্রুত এবং নিরপেক্ষতা
কমিশন যদি সীমান্ত সীমারেখা নির্ধারণে মনোযোগী হতো তাহলে নিশ্চয়ই অনেক বেদনাদায়ক ভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব ছিলো। এমন অনেক গ্রামকে ভাগ করা হয় তার কিছু অংশ ভারতে কিছু অংশ পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল । একথা ঠিক, মাত্র এক মাস সময় থাকার কারণে রেডক্লিফের অনেক সূক্ষ্ম বিষয়ে নজর দেয়া সম্ভব হয়নি। তার বিভক্তি সীমা এমনভাবে আঁকা হয়েছিল অনেক ক্ষেত্রে ঘনবসতির এলাকাগুলিও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনও নজির রয়েছে একটি বাড়ির কিছু কামরা ভারতে ও কিছু পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবেই রেডক্লিফ ভারত বিভক্তির সীমারেখা টেনে নিজের বিবেচনাকে চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তার এই বিভক্তি সীমারেখা কতো মানুষের জীবনে যে ভয়ঙ্কর পরিণতির কারণ হতে পারে তা তিনি ঘুর্ণাক্ষরেও হয়তো ভাবেননি। এই সব ঐতিহাসিক বিবেচনার চিন্তাসমূহ আর কখনো জানা যাবে না যেহেতু রেডক্লিফ ভারত ছাড়ার সময়ে তার অনেক মূল্যবান দলিল বা কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলেন। তিনি ঠিক স্বাধীনতা দিবসের দিনেই ভারত ত্যাগ করেন যখন বাউন্ডারি কমিশনে রিপোর্টটি পর্যন্ত বিলি করা হয়নি। তার নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী জানা যায়, ভারতের আবহাওয়ার সাথে তার অযোগ্যতা এবং দ্রুত ভারত ত্যাগের অভিসন্ধির প্রভাবে রেডক্লিফ প্রভাবিত ছিলেন। এটা ঠিক, দেশভাগের বিভক্তি সীমারেখা নিরূপণে যতোটা সময় লেগেছে তার চেয়ে খুব কম সময় লেগেছে তা বাস্তবায়নে। ১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট প্রকাশিত হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট বিকেল ৫ টায় ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মাত্র দুই ঘন্টা সময় দেয়া হয় বাউন্ডারি কমিশনের ভারত বিভক্তি সীমা সনদ (এওয়ার্ড) খানি পড়তে।

গোপনীয়তা:
একথা আজ দিবলোকের মতো সত্য যে, বিরোধ এবং দীর্ঘসূত্রিতা এড়ানোর জন্য ভারত বিভক্তি করা হয় গোপনে। আগস্টের ৯ এবং ১২ তারিখেই ভারত বিভক্তি সীমা সনদ (এওয়ার্ড) চূড়ান্ত হয়ে যায় বটে কিন্তু অপ্রকাশিত রাখা হয় তার দুই দিন আগে পর্যন্ত। তবে গোপন সূত্রে জানা যায়, আগস্টের ৯ ও ১০ তারিখে মাউন্টব্যাটেন বা রেডক্লিফের ভারতীয় সেক্রেটারির মাধ্যমে পাঞ্জাবের বিভক্তি সীমা সনদ নেহেরু ও প্যাটেলকে অবগত করা হয়েছিল।
রেডক্লিফের সীমারেখা সনদ যেভাবেই প্রকাশিত হোক না কেন সুটলেজ খালের পূর্বাংশকে পাকিস্তানের পরিবর্তে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তবে উক্ত (তহসিল) অঞ্চলটিতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষের মতো ছিল। আপাত দৃষ্টিতে দু’টি কারণে উক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়- (১) এলাকাটিতে সেনাবাহিনীর একটি অস্ত্রাগার ছিল এবং (২) বিকানের রাজ্যের কৃষিজমিতে সেচের জন্য খালটিই একমাত্র জলের উৎস।
একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়ার বেলায় রেডক্লিফের কী ভাবনা ছিল বা যুক্তি ছিল কিনা জানা যায় না। ৯৮ % অমুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলটি ভারতের অভ্যন্তরে চলে যাওয়ার কথা সত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্গত করার রেডক্লিফের সিদ্ধান্তে জওহর লাল নেহেরু ও সর্দার প্যাটেল দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। একইভাবে বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দু’টি জেলা মুর্শিদাবাদ ও মালদাকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টাও ১৭ই আগস্ট অবধি গোপন রাখা হয় যার ফলে সেখানে তিন দিন পর্যন্ত পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়েছিল। এসকল সিদ্ধান্তগুলির পেছনের কারণগুলি হয়তো আর কখনো জানা যাবে না যেহেতু রেডক্লিফ সমস্ত রেকর্ড ধ্বংস করেছিলেন এবং মাউন্টব্যাটেনও কোন বিশেষ ইস্যুর পক্ষপাতিত্ব বা এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞাত থাকার কথা অস্বীকার করেন।

বাস্তবায়ন:
অবশেষে দেশ ভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানের দুই সদ্যজাত সরকারের উপরই বাউন্ডারি কমিশনের তৈরী সীমা সনদ (এওয়ার্ড) বাস্তবায়নের যাবতীয় দায় দায়িত্ব বর্তাবে এবং বৃটিশ প্রশাসন তাড়াতাড়ি সসম্মানে উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাক সেটাই বড় কামনা ছিল। ভিসরয় মাউন্টব্যাটেন আগস্টে লাহোর গমনের পরই লাহোর ও সন্নিকটবর্তী এলাকা শান্ত রাখার জন্য পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স গঠন করেন। তবে ৫০,০০০ জওয়ান ৭৭ % গ্রাম্য এলাকার জনসাধারণের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু রোধ করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। সাম্প্রদায়িক সংর্ঘষ কবলিত বিশাল এলাকায় উক্ত ফোর্স প্রতি বর্গ মাইলে কেবল একজন সেনা সদস্যের পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কোন মতেই সম্ভব ছিল না।

এই ফোর্স শহরগুলিতে বা হাজার হাজার পাকিস্তানের দিকে সরে যাওয়া শরণার্থীদের নিরাপত্তা দেয়া অসম্ভব। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই সীমান্তের ভূল অংশে পতিত বিক্ষুব্ধ গ্রামগুলির আন্দোলনকে সমর্থন করে এওয়ার্ড বা চুক্তির বরখেলাপ করতে চাননি। কারণ এভাবে নতুন করে বিরোধপূর্ণ অংশগুলি নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে গেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের সম্মান ক্ষুণœ হতে পারে। এমনকি জাতিসংঘ বা বৃটেনের পুনরায় হস্তক্ষেপ আসতে পারে বিধায় তারা সীমান্তে চলমান বিভিন্ন ইস্যুগুলির ব্যাপারে ছিলেন নীরব। তবে তা সত্ত্বেও রেডক্লিফ এওয়ার্ডের আওতা বহির্ভূত কাশ্মীর প্রিন্সলি স্টেট নিয়ে তারা সহসা সংর্ঘষে জড়িয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পায়নি। সেই সীমান্ত বিরোধ পরবর্তী ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ এর তিনটি যুদ্ধ ছাড়াও ১৯৯৮-এর মে মাসে উভয় দেশের নিউক্লিয়ার যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষা আর ১৯৯৯ সালের কারগিলের মতো যুদ্ধ বাঁধিয়েছে।

রেডক্লিফ লাইনের বিরোধসমূহ:
রেডক্লিফ লাইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও গুরদাসপুর জেলা নিয়ে দু’টি বড় ধরনের বিরোধ থেকে যায়। ছোটখাটো অন্যান্য বিরোধগুলির মধ্যে বেঙ্গলে মালদা, খুলনা এবং মুর্শিদাবাদ ও আসামের করিমগঞ্জ সাব ডিভিশন রয়ে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম:
অতি দুর্ভাগ্যজনক হলেও সেদিন ৯৮% অমুসলিম (অধিকাংশই বুড্ডিস্ট) অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঢুকিয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানের ভেতরে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অমুসলিম মেজরিটি অঞ্চল হওয়ার যুক্তিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি’ ভারতে অন্তর্ভুক্তির জন্য বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনকে আবেদন জানায়। যেহেতু তাদের কোন আনুষ্ঠানিক (অফিসিয়াল) প্রতিনিধিত্ব ছিল না সেই বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে আলোচনাই হয়নি বা গুরত্ব পায়নি। তবে ভারতভাগ নীতির বিচারে স্বাভাবিক কারণেই ভারতের অনেকেই আশা করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু সে প্রত্যাশা কখনোই আর পুরণ হয়নি।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সাধারণ নিরীহ মানুষই জানতেন না তারা কার ভাগে পরে গিয়েছেন। যাদের ভাগ্যের পরিণতি ঠিক কিভাবে স্থির হয়ে যাবে এই অতি গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের কোন মতামতের তোয়াক্কা না করে (পুরো বিষয়টিকে অজ্ঞাত রেখে) একটি বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৭ই আগস্ট রেডক্লিফের এওয়ার্ড প্রকাশিত হলেই জানা যায়, ইতিমধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার যুক্তি হলো যে, এ অঞ্চলটি ভারতের দিক থেকে দুর্গম, চট্টগ্রামের এলাকাকে প্রশস্ত (সাব্সটেনশিয়াল রুরাল বাফার অঞ্চল) করা, সর্বোপরি চট্টগ্রামের মতো বন্দর শহর সন্নিকটবর্তী হওয়ার যুক্তিতে পাকিস্তান বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের কাছে অনেকটা জোরপূর্বক দাবি আদায়ে সমর্থ হয়।

দুইদিন পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির বিদ্রোহী অংশ এ্যাকশন কমিটি নাম দিয়ে বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের এওয়ার্ডকে প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় জাতীয় পতাকা রাঙ্গামাটির বুকে উড়ায়। তখনকার দিনের যুব নেতা ¯েœহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে প্রয়োজনে বিচ্ছিন্নতার জোরালো আন্দোলন সংগঠনের প্রচেষ্টাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কঠোরভাবে দমন করে।

প্রয়াত স্নেহ কুমার চাকমা তার ‘দি পার্টিশন এন্ড দি চাকমা’ গ্রন্থে লেখেন- ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যরাতে এ্যাকশন কমিটি হাজার খানেক সমর্থক নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ডেপুটি কমিশনার বাঙলোয় হাজির হন। ডিসি কর্ণেল জি. এল. হাইড বেড়িয়ে এসে তাদের স্বাগত জানান। এস. কে. চাকমা ডেপুটি কমিশনারকে জিজ্ঞাসা করেন, “স্যার, ইজ নট ইন্ডিয়া ইনডেপেনডেন্স নাও?” প্রতি উত্তরে ডিসি বলেন, হ্যাঁ তোমরা এখন থেকে স্বাধীন।” এস. কে. চাকমা আরো বলেন, “ভারত স্বাধীন আইনে কি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ নয় স্যার?” কমিশনার কর্ণেল জি. এল. হাইড উত্তর দেন, “ভারত স্বাধীন আইন ১৯৪৭ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত শাসনের অধীন।” এস. কে. চাকমা, “স্যার, আমাদের কি জাতীয় পতাকা উড়ানো উচিত নয়?”

ডেপুটি কমিশনার, “হ্যাঁ, কিন্তু আমরা বৃটিশ নাগরিকরা জাতীয় পতাকা উড়াই সূর্য উঠার সময়। অনুগ্রহ করে ভোরে আসুন। ফুটবল খেলার মাঠে জনসমক্ষে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দিন আর তখন আমি নিজেই স্যালুট করবো। এরপর আমি আমার অফিস ও বাঙলোয় ভারতীয় জাতীয় পতাকা উড়াবো যেখানে আপনাদের সবাইকে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ করি। কাজেই অনুগ্রহ করে আপনারা আমার এই পতাকা উত্তলনের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।”

গুরদাসপুর জেলা:
বৃটিশ শাসনের সময় গুরদাসপুর জেলাটি ছিল বৃটিশ ইন্ডিয়ার পাঞ্জাব প্রদেশের সর্ব উত্তরের জেলা। জেলাটি চারটি তহসিলে বিভক্ত ছিল যেমন- শাকার গড়, গুরদাসপুর, বাটালা ও পাঠান কোট। চারটি তহসিলের মধ্যে শাকার গড় তহসিলটিই কেবল রবি নদী দ্বারা আলাদা ছিল এবং পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাবের শিয়াল কোট জেলায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বাকী তহসিলগুলি একত্রে গুরদাসপুর নাম ধারণ করে পূর্ব পাঞ্জাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশ ভাগের ফলে গোটা জেলার মধ্যে মুসলিম জনগণ পাকিস্তানের অংশে আর অমুসলিম (হিন্দু ও শিখ) জনগণ ভারতের অংশে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। আহমদীয়া সম্প্রদায়কে মুসলিম হিসেবে ধরলে গোটা গুরদাসপুর জেলাটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিম প্রশাসনের বিচারে এই আহমদীয় সম্প্রদায়কে অমুসলিম হিসেবে ধরা হলেও সামগ্রিকভাবে তাদের মুসলিম হিসেবে গণনা করা হয়। জেলাটিতে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের জনসংখ্যা অনেক ছিল। ছিল তাদের ধর্মীয় পবিত্র কেন্দ্র কোডিয়ান। ১৯০১ সালের জনগণনায় দেখা যায়, গুরদাসপুর জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা ৪৯ %, হিন্দু ৪০ % এবং শিখ ১০ %। নিম্ন লিখিত কারণে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও কমিশনের সদস্যরা গুরদাসপুর জেলার অধিকাংশ অংশ ভারতে অন্তর্ভুক্ত করে দেন।

১। অঞ্চলটি অন্তর্ভুক্ত করলে কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে উপকৃত করা হবে। কাজেই উক্ত অঞ্চলের শাসকদের ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়াই সমীচিন হবে।
২। পাঠানকোট তহসিলটি পূর্ব পাঞ্জাব জেলার সন্নিহিত হোসিয়াপুর ও কাঙ্গড়ার সাথে সরাসরি রেল লাইন দ্বারা সংযুক্ত।
৩। চারদিক সীমান্তের মধ্যে তিন দিক পাকিস্তান ঘেরা শিখদের পবিত্র শহর অমৃতস্বরের জন্য বাটালা এবং গুরুদাসপুর তহসিল দুটি বাফার অঞ্চল হিসেবে কাজে দেবে।
৪। রবি নদীর পূর্বাংশকে একটি বল্ক ধরলে এটি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের এলাকা হয়ে যায়। এই বল্কটি অমৃতস্বরকে একীভূত করবে ও গুরদাসপুরের বেশ কিছু শাকারঘর তহসিল বাদে পুরো অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
৪। এভাবেই ৫৮% সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখ জনসংখ্যা পূর্ব পাঞ্জাবে একীভূত হবে। উল্টোটা করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখ সম্প্রদায় পাকিস্তানের ভেতরে চলে যাবে এবং অধিকতর সংখ্যক শিখ শরণার্থী তখন আবার ভারতের দিকে চলে আসতে বাধ্য হবে।
৫। পশ্চিম পাঞ্জাবে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ বিশাল এলাকা ছাড়তে বাধ্য হবে সেই বিক্ষুব্ধ অংশটিকেও সন্তুষ্ট রাখা যাবে।

ফিরোজপুর জেলা:
কাউন্টার ব্যালান্স করার জন্য গুরদাসপুরের ক্ষুদ্র কিছু অংশ পাকিস্তানের ভেতরে দেয়া হয়। রেডক্লিফও প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন ফিরোজপুর এবং জিরা তহসিলকে পাকিস্তানের ফিরোজপুর জেলার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে। এই সিদ্ধান্তকে বিকানের মহারাজা কর্তৃক বিরোধীতা করা হয় যেহেতু সাতলুজ এবং বীজ নদীর মোহনার মুখে হওয়ার কারণে তা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ফিরোজপুরে মহারাজার যে মরুময় জমি রয়েছে তার একমাত্র জল উৎসের নালাটির উৎপত্তি এখানেই। শেষ মুহূর্তে মহারাজা মাউন্টব্যাটেনকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন, যদি ফিরোজপুর জেলাটি পশ্চিম পাঞ্জাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলেই একমাত্র তার রাজ্যটিকে পাকিস্তানে দিয়ে দেয়া তিনি মেনে নেবেন। এই পরিস্থিতিতে একেবারেই শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুরো ফিরোজপুর জেলাকে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।

মালদা জেলা:
রেডক্লিফের সিদ্ধান্তে অন্য আরো একটি বিরোধ থেকে যায়, তা হলো বেঙ্গলের মালদা জেলাকে বিভক্তির মাধ্যমে। মালদা জেলাটি সামান্য সংখ্যায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও গোটা শহরটিসহ জেলার বেশীরভাগ অংশই ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পর ৩/৪ দিন পর্যন্ত উক্ত পুরো মালদা জেলাটি পাকিস্তানের প্রশাসনের আওতায় ছিল। ১৭ই আগস্ট যখন এওয়ার্ড প্রকাশিত হয় তখনই মালদায় পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ভারতীয় পতাকা উত্তলন করা হয়।

খুলনা, মুর্শিদাবাদ এবং করিমগঞ্জ:
খুলনা জেলা স্বল্প সংখ্যায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫১ %) হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে চলে যায়। পরিবর্তে ৭০% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের মুর্শিদাবাদ জেলাটিকে ভারতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। গণভোটের মাধ্যমে আসামের সিলেট জেলা পাকিস্তানে চলে যায়। কিন্তু করিমগঞ্জ সাব ডিভিশন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হয়েও ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে যায়। ২০০১ সালের ভারতীয় আদমশুমারী অনুসারে করিমগঞ্জে মুসলিম জনসংখ্যা ৫২.৩ %।

আইনগত বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক বিস্মৃতি:
দেশভাগ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক বিবেচনায় সামগ্রিকভাবে একটি মূখ্য ঘটনা। বৃটিশ নাট্যকার হাওয়ার্ড ব্রেনটন বলেছিলেন, তিনি প্রথম রেডক্লিফ লাইনের বিষয়ে আগ্রহান্বিত হন যখন ভারত ভ্রমণে এসে সেই সমস্ত পরিবারগুলির বেদনাদায়ক কাহিনী শুনেছিলেন যারা দেশভাগের সময় এপার থেকে ওপারে স্থানান্তরিত হয়েছিল। দেশভাগের ৬৮ বছর পর আজ অবধি রেডক্লিফের লাইন সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে যে কতো মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বয়ে এনেছিল সেই মর্মান্তিক কাহিনী জানতে পারলে অনেক ইংরেজ (বৃটিশ) নাগরিক মানবিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্ববোধের অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ঐতিহাসিক সাহিত্যে শৈল্পিক চিত্রায়ণ:
দীর্ঘকাল ধরে রেডক্লিফ লাইনে দেশভাগের ভয়াবহ পীড়াদায়ক পরিণতির কথা অনেক লেখক তাদের বই বা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরলেও সেই এওয়ার্ড-এর ইতিহাস এবং তার প্রক্রিয়ায় জড়িতদের ভূমিকার পূর্ণমূল্যায়ণ আজ পর্যন্ত কোথাও হয়নি। ‘ড্র্য়িং দ্য লাইন’ নামে রচিত হাওয়ার্ড ব্রেনটনের নাটকে রেডক্লিফের চরিত্রকে এমনভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তিনি একজন সৎ ও নীতিবান মানুষ ছিলেন। উপনিবেশিক বৃটিশের হয়ে দেশভাগের দায়িত্ব পালন করতে এসে রেডক্লিফের ঘটনাবহুল জীবনের অনেক অপ্রকাশিত সত্য আমাদের অজানা রয়ে গেছে। যে বাঙলোয় বসে রেডক্লিফ দেশভাগের লাইন টানছিলেন সেখানে নিশ্চয়ই অজানা আঁধারে ঢাকা ছিল, যেমনি করে তার মনের কোণায়ও অনেকটা কষ্টের অন্ধকার ঘনিয়েছিল সেই মুহূর্তগুলিতে। তিনি পরবর্তীতে তার কৃতকর্মের ত্রুটি ও বেদনাদায়ক পরিণতির কথা ভেবে চরমভাবে অনুতপ্ত হয়েছিলেন বলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত সরকারের দেয়া পারিশ্রমিকও গ্রহণ করেননি, সকল ম্যাপ ও খসড়া ডকুমেন্টসগুলিও ইংলন্ডে নিয়ে এসেছিলেন এবং একান্তে জ্বালিয়ে নষ্ট করেছিলেন। রেডক্লিফ ভারতে এসে কী দায়িত্ব পালন করে গেছেন সে কাহিনীর একটি শব্দও নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত শোনাননি কোনদিন। একজন দায়িত্ববান বৃটিশ নাগরিক হয়ে রেডক্লিফের ঐতিহাসিক ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে যে লক্ষ পার্বত্যবাসী মানুষের জীবনে আজ অবধি রক্তাক্ত নিপীড়ন, নির্যাতনের ভিন্ন কাহিনী রচিত হয়ে চলেছে তা অবগত হয়ে নাট্যকার ব্রেনটন অত্যধিক বিচলিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তার রচিত নাটক ‘ড্রয়িং দ্যা লাইন’-এ ।

শেষের কথা, বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কী? স্বাধীন ভবিষ্যতের কথাই বা ভাবলে আশ্চর্য্য হওয়ার কী আছে?
আগামী ৫০টি বছর কি টিকবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মজাতির স্বতন্ত্র জাতীয় অস্থিত্ব? আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়, অবশ্যই না। উগ্র মুসলিম জাতীয়তাবাদী আগ্রাসনে স্বতন্ত্র জাতীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকা মোটেই সম্ভব নয়। ধর্মীয় ও সামাজিক আগ্রাসন ছাড়াও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঘটে চলেছে দ্রুততর। এ আগ্রসনের কবল থেকে চাকমা বা অন্য কোন জাতিসত্তাকে রক্ষা করা আর যে সম্ভব নয় সে কথা দিবালোকের মতোই সুস্পষ্ট তাই হাঁ হুতাশ করে কোন লাভ আর নেই মনে হয়। তবে আজো অনেকে স্বপ্ন দেখে স্বাধিকারের কিংবা স্বাধীনতারও। স্বাধীন চাকমা রাজ্যের ম্যাপও এঁকে ফেলেছেন অনেকে। আঁকা হয়েছে চাকমা জাতীয় পতাকাও। আয়ু কমে মানুষের, আশা বাড়তেই থাকে। বেঁচে থাকার আশা। স্বাধীনভাবে দীর্ঘকাল বাঁচার প্রত্যাশা। [নিখিল চাকমার সংগৃহীত তথ্যপঞ্জির জন্য কৃতজ্ঞতা]