তাইন্দং সাম্প্রদায়িক হামলার ৭ বছর: অপরাধীদের দায়মুক্তির আরেক উদাহরণ

0
1296

হিল ভয়েস, ৩ আগস্ট ২০২০, খাগড়াছড়ি:  আজ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং সাম্প্রদায়িক হামলার ৭ বছর। দীর্ঘ ৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

এইদিনে ২০১৩ সালের গত ৩ আগস্ট মাটিরাঙ্গার তাইন্দং এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের ১১টি গ্রামে সংঘবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। উক্ত হামলায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক সর্বেশ্বর পাড়ায় বৌদ্ধ বিহারের ১টি ঘরসহ ১৯টি বাড়ি, বগা পাড়ায় ১২টি, তালুকদার পাড়ায় ২টি ও বান্দরসিং পাড়ায় (ভগবান টিলা) ৩টি বাড়ি মোট ৩৬টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং সর্বেশ্বর পাড়া জনশক্তি বৌদ্ধ বিহার ও মনুদাস পাড়া বৌদ্ধ বিহার নামে ২টি বৌদ্ধ মন্দিরসহ প্রায় ৪০০ ঘরবাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়।
প্রাণের তাগিদে ৪৫৪ পরিবারের প্রায় ২০০০ জুম্ম গ্রামবাসী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় ভূখন্ডের ‘নো ম্যান’স ল্যান্ডে’ আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া ৩৮০ পরিবারের প্রায় ১,৫০০ ত্রিপুরা গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী পানছড়ি উপজেলায় এবং ৩৫ পরিবার জঙ্গল আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

হামলায় কমপক্ষে ১২ জন জুম্ম আহত হয়েছে বলে জানা যায় যাদের মধ্যে কয়েকজনকে বিজিবি সদস্যদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মারধর ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। ঐদিন দিন-দুপুরে সেটেলার বাঙালিদের সংঘবদ্ধ হামলা চলাকালে স্থানীয় বিজিবি ও পুলিশ কোন যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

হামলায় আহত বান্দরসিং পাড়ার অধিবাসী সুকুমণি চাকমার ২ মাস বয়সী মেয়ে আশামণি চাকমা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১০ আগস্ট খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে মারা গেছে। সুকুমণি চাকমা সেটেলার বাঙালিদের দায়ের কোপে তার হাতে গুরুতর জখম হয়।

এ হামলায় পুড়ে যাওয়া ৩৬টি ঘরাবাড়ীর মধ্যে ১৫টি ঘরবাড়ীর ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ পাওয়া গেছে ২৬ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। অন্যদিকে লুটপাট ও ভাঙচুর হওয়া ৪০০ ঘরবাড়ীর মধ্যে ২৬২টি ঘরবাড়ীর ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ পাওয়া গেছে ১ কোটি ২৮ লক্ষ ৯৮ হাজার টাকা। সুতরাং পুড়ে যাওয়া অবশিষ্ট ২১টি বাড়ি এবং লুটপাট ও ভাঙচুর হওয়া অবশিষ্ট ১৩৮টি ঘরবাড়ীর ক্ষয়ক্ষতিসহ হিসেব করলে এ হামলায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২ কোটির টাকার অধিক বলে প্রতীয়মান হয়।

সেদিন দুপুরের দিকে সেটেলার বাঙালিরা মো: কামাল হোসেন নামে জনৈক মটর সাইকেল চালক সেটেলার বাঙালি অপহৃত হয়েছে বলে প্রচার করে এবং তারপর থেকে উত্তেজিত শ্লোগান দিয়ে সংগঠিত হতে থাকে। বিকেল ৩:০০ ঘটিকা থেকে প্রায় ৪-৫ ঘন্টা ধরে বিজিবি ক্যাম্পের নিকটবর্তী এলাকায় সেটেলার বাঙালিরা হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাঙচুর চালায়। বগাপাড়া, বান্দরসিং পাড়ার (ভগবান টিলা) লাগোয়া হচ্ছে বিজিবি’র বান্দরসিং পাড়া ক্যাম্প এবং তালুকদার পাড়ার লাগোয়া হচ্ছে তাইন্দং ক্যাম্প। এছাড়া তার অদূরে রয়েছে তানাক্কা পাড়া ক্যাম্প, আসলং ক্যাম্প ও ফেনীছড়া ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সেটেলার বাঙালিরা হামলা করতে যায়। এছাড়া এসব বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে গুমতি, খেদাছড়া, মাটিরাঙ্গা ও বটতলী (আলুটিলা) এলাকা থেকে এসে অনেক সেটেলার বাঙালি জুম্মদের গ্রামে হামলা করতে যায়। কিন্তু যখন সেটেলার বাঙালিরা জুম্ম গ্রামগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন বিজিবি সদস্যরা সেটেলারদের রোধ করতে কার্যকর কোন পদক্ষেপই নেয়নি।

ঐদিন ৩ আগস্ট দিন-দুপুরে সেটেলার বাঙালিদের সংঘবদ্ধ হামলা চলাকালে স্থানীয় বিজিবি ও পুলিশের পক্ষ থেকে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরঞ্চ নীরব ভ‚মিকা পালন করে প্রকারান্তরে জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙালিদের হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। পরে বিজিবি ও পুলিশ সীমান্তের ওপাড়ে আশ্রয় নেয়া জুম্মদের নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান পূর্বক স্ব স্ব গ্রামে ফিরে আসার আহ্বান জানালেও জুম্মরা ফিরে আসতে অস্বীকার করে। তারা অভিযোগ করে যে, এর আগেও বিজিবি-পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন এভাবে অনেকবার নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছে; কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি কোন বার রাখেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্তদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের আশ্বাসের ভিত্তিতে পালিয়ে যাওয়া জুম্মরা সেদিন বিকেল থেকে স্ব স্ব গ্রামে ফিরে আসেন।স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার ও কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা কর্তৃক পূর্ণ নিরাপত্তা, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মরা এখনো পর্যন্ত যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন না পায়নি।

বগাপাড়ার অধিবাসী অনিল বিকাশ চাকমা কর্তৃক ৫ আগস্ট ২০১৩ মাটিরাঙ্গা থানায় ৩০ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ১৭৫ জনের বিরুদ্ধে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মামলা করা হয়েছে। উক্ত হামলায় অনিল বিকাশ চাকমার বাড়ী সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয় সেটেলার বাঙালিরা। দায়ের করা মামলায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থক রয়েছে। এ মামলায় যাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে সেই মো: কামাল হোসেনসহ আবেদ আলী মেম্বার, আবু হানিফ মেম্বার ও কামরুজ্জানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ৮ আগস্ট ২০১৩ সন্ধ্যায় ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বায়েজীদ থানাধীন টেক্সটাইল এলাকা থেকে এজাহারভুক্ত ১নম্বর আসামী তাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সিরাজী ও অপর আসামী তানাক্কাপাড়ার আবু হানিফ প্রকাশ ইধন সর্দারকে বায়েজীদ থানা পুলিশ আটক করে।

তবে তাদের আটক করা হলেও পরে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের যোগসাজশে আটককৃতদের জামিনে মুক্তি লাভ করে। এভাবে সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতায় ধীরে ধীরে হামলার সাথে জড়িতদেরকে দায়মুক্তি দেয়া হয়।