জুম্মদের জাতীয় উৎসবের মুখেও বিলাইছড়িতে সেনাবাহিনীর অভিযান ও নিপীড়ন অব্যাহত

0
456
ছবি : প্রতিকী

হিল ভয়েস, ১২ এপ্রিল ২০২৩, রাঙামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় উৎসবের প্রাক্কালেও রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়িতে বিভিন্ন জুম্ম গ্রামে সেনাবাহিনী কর্তৃক অব্যাহতভাবে টহল অভিযান পরিচালনা করা এবং এসব অভিযানে জুম্ম গ্রামবাসীদের মারধর, তল্লাসি, হয়রানি করা ও এক গ্রামবাসীকে জেলে পাঠানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অপরদিকে, বিলাইছড়ির বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় জুম্মদের জাতীয় সামাজিক উৎসব বিজু, বিষু উদযাপনের ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনী কর্তৃক নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত এক সপ্তাহে (৬ এপ্রিল-১২ এপ্রিল) সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্তত চার বার টহল অভিযান পরিচালনা করেছে এবং এইসব অভিযানে অন্তত ৪ নিরীহ গ্রামবাসীকে মারধর, জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি ও ১ ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয় বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ এপ্রিল ২০২৩ বিলাইছড়ি উপজেলার ৪নং ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বার সুমন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫), পীং-লাতুসেন তঞ্চঙ্গ্যা ফারুয়া বাজারে যান। এক পর্যায়ে ফারুয়া সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা সুমন তঞ্চঙ্গ্যাকে বাজার থেকে সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। এসময় সেনা সদস্যরা সুমন তঞ্চঙ্গ্যাকে বলে যে, তোমার এলাকায় শান্তিবাহিনীর ব্যারাক আছে এবং ব্যারাকে কতজন থাকে, কম্যান্ডারের নাম কী ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদ করে। সুমন তঞ্চঙ্গ্যা এসব জানে না বলে জবাব দিলে, সেনা সদস্যরা সুমন তঞ্চঙ্গ্যাকে বেদম মারধর করে। এভাবে প্রায় ৩ ঘন্টা ক্যাম্পে আটক রাখার পর সুমন তঞ্চঙ্গ্যাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে, সেনাবাহিনী সুমন তঞ্চঙ্গ্যাকে বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে যেতে পারবে না বলে নির্দেশ দিলে সুমন তঞ্চঙ্গ্যা বাড়িতে চলে যায়।

আরও জানা যায়, গত ৮ এপ্রিল ২০২৩ ফারুয়া সেনা ক্যাম্পের একদল সেনা সদস্য নতুন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮) নামে ফারুয়া বাজারের এক ঔষধ দোকানদারকে সেনা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে বেদম মারধর করে। ক্যাম্পে একদিন আটক রাখার পর সেনা সদস্যরা বিলাইছড়ি থানা থেকে পুলিশ ডেকে এনে নতুন কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে পুলিশের নিকট সোপর্দ করে। নতুন কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে বর্তমানে রাঙামাটি জেলে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে কী কারণে নতুন কুমারকে সেনাবাহিনী কর্তৃক মারধর করা হল এবং পুলিশের নিকট সোপর্দ করা হল তা জানা যায়নি।

গত ১০ এপ্রিল ২০২৩ ৩নং ফারুয়া ইউনিয়নের তক্তানালা সেনা ক্যাম্পের একদল সেনা সদস্য উলুছড়ি এলাকায় টহল অভিযানে যায়। সেখান থেকে ফেরার পথে সেনাদলটি তক্তানলা গ্রাম থেকে অপু তঞ্চঙ্গ্যা (৬০), পীং-মনসিপ্যা তঞ্চঙ্গ্যা ও শান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), পীং-তাবমুনি তঞ্চঙ্গ্যা নামে দুই গ্রামবাসীকে জোর করে একই গ্রামের অনিল তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮), পীং-তাবমুনি তঞ্চঙ্গ্যা এর বাড়িতে নিয়ে যায়। এমসয় সেনা সদস্যরা অপু তঞ্চঙ্গ্যা ও শান্ত তঞ্চঙ্গ্যাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তারা বাড়ির কর্তা অনিল তঞ্চঙ্গ্যাকে চিনে কিনা। উভয়ে চিনে বলে জবাব দিলে, সেনা সদস্যরা আরও প্রশ্ন করে, সে (অনিল তঞ্চঙ্গ্যা) কোথায়? সে নাকি জেএসএস এর চাঁদা সংগ্রহ করে? অপু তঞ্চঙ্গ্যা ও শান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তারা এ ব্যাপারে জানে না বলে জবাব দিলে, সেনা সদস্যরা প্রথমে দুইজনকে চর মারে এবং পরে বাঁশের লাঠি দিয়ে ব্যাপক মারধর করে।

এভাবে মারধর করার পর সেনা সদস্যরা অপু তঞ্চঙ্গ্যা ও শান্ত তঞ্চঙ্গ্যাকে বলে যে, তারা যেন পরের দিন অনিল তঞ্চঙ্গ্যাকে সেনা ক্যাম্পে উপস্থিত থাকতে বলে।

জানা গেছে, ঐদিন অনিল তঞ্চঙ্গ্যা ও তার স্ত্রী পারিবারিক কাজে বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন। এদিকে উক্ত ঘটনার কথা জেনে অনিল তঞ্চঙ্গ্যা সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সর্বশেষ আজকেও (১২ এপ্রিল) বিলাইছড়ি সদর সেনা জোন থেকে জনৈক সুবেদারের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি সেনাদল ২নং কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের পরিখোলা মৌনে (পাহাড়ে) টহল অভিযানে যায়। অপরদিকে একইদিনে ধুপশীল সেনা ক্যাম্প থেকে জনৈক সুবেদারের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি সেনাদল শালবাগান হয়ে লতা পাহাড়ের পাংখোয়া পাড়া ও মারমা পাড়ায় টহল অভিযানে যায়।

জাতীয় উৎসব উদযাপনে বাধা সৃষ্টির অভিযোগঃ

জুম্মদের জাতীয় সামাজিক উৎসব বিজু, বিষু উদযানের ক্ষেত্রে বিলাইছড়ির বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিলাইছড়ি সেনা জোন থেকে আর পি কম্যান্ডারের মাধ্যমে স্থানীয় জুম্মদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, অনুষ্ঠানে কেউ কোথাও সাউন্ড বক্স ব্যবহার করতে পারবে না। বিলাইছড়ি ইউনিয়নের কুতুবদিয়া গ্রামের স্থানীয় জুম্মরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিজু উদযাপনের অনুমতি চাইলে সেনা জোন কর্তৃপক্ষ কোনো অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেয়নি বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একই ইউনিয়নের ধুপ্যাচর এলাকার জুম্মদেরও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তারা যেন উৎসব উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান না করে।