আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সৌখিন চাকমা আর বেঁচে নেই

0
377

হিল ভয়েস, ১২ এপ্রিল ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি’র সদস্য সৌখিন চাকমা স্ট্রোকজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।

আজ ভোর রাত ১:৩০ টার দিকে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে জানা গেছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৫ বছর ৬ মাস।

তাঁর জন্ম ১৯৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, রাঙামাটি জেলার বুড়িঘাট মৌজার খুল্যাবিল নামক স্থানে। পরে ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের কারণে নিজেদের জন্মভূমি হ্রদের পানিতে তলিয়ে গেলে অন্য অনেকের মত পরিবারের সঙ্গে সন্তান-নস্তুতিদের নিয়ে তাঁর পিতা-মাতাও খাগড়াছড়ির পানছড়ির কুরাদিয়াছড়াতে বসতি করেন। তাঁর পিতার নাম প্রয়াত জ্ঞানেন্দ্র লাল চাকমা ও মাতার নাম বনতারা দেওয়ান। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও চার ছেলে এবং নাতি-নাতনি রেখে গেছেন। সৌখিন চাকমার ডাক নাম ছিল তন্টুমনি।

তিনি এসএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি খাগড়াছড়ি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। সত্তর দশকে ছাত্র ও যুব বয়সে তিনি পাহাড়ি ছাত্র সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে একসময় তিনি জেলও খাটেন। পরবর্তীতে তিনি খাগড়াছড়ি সদরের খবংপয্যায় স্থায়ী বসতি গড়েন।

১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৪৮ ঘটনার আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি জনসংহতি সমিতির সমর্থিত তথা জাসদের প্রার্থী উপেন্দ্র লাল চাকমার পক্ষে খাগড়াছড়ি বাজারে জনসংযোগকালে সৌখিন চাকমা একবার গ্রেফতারের শিকার হন। সেসময় তার সাথে আরো প্রায় ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সেসময় সৌখিন চাকমাকে উলঙ্গ করে ফ্যানের হুকে টাঙানো অবস্থায় নৃশংসভাবে মারধর করা হয়। ‘শান্তিবাহিনীর ক্যাম্প কোথায়’, ‘তারা অন্ত্র কোথা থেকে পায়’, ‘খাগড়াছড়ি কলেজের কে কে শান্তিবাহিনীর কাজ করে’ ইত্যাদি জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে সাবানের পানি ভর্তি বালতিতে মাথা চুবিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় তাকে। এভাবে নির্মম নির্যাতনের ৮ দিন পর সেসময় তিনি মুক্তি পান।

পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে গঠিত পাহাড়ি গণ পরিষদের প্রথম কমিটিকে সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাশাপাশি খাগড়াছড়ি কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও বিশিষ্ট একজন সমাজকর্মী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর তিনি জনসংহতি সমিতির চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের সাথেও তিনি সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হন। এক পর্যায়ে তিনি জনসংহতি সমিতির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি ২০২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।

তাঁর এ অকাল মৃত্যুতে জনসংহতি সমিতিসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন জানিয়েছে গভীর শোক ও পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা। তিনি ছিলেন একজন নিখাঁদ দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী ব্যক্তি। তিনি সারা জীবন জুম্ম জনগণের স্বাধিকারের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর মৃত্যুতে জুম্ম জাতি হারিয়েছে একজন সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে।

আজ বুধবার সৌখিন চাকমার মরদেহ চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়িতে নেয়া হবে এবং খাগড়াছড়ির উত্তর খবংপয্যা শ্মশানে দাহ করা হবে।