চিম্বুক পাহাড়ে আগুনে পুড়ে ম্রোদের অর্ধশতাধিক বাগান ধ্বংস, নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ

0
1347

হিল ভয়েস, ২৪ মার্চ ২০২১, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ে পাথর ব্যবসায়ীদের দেওয়া আগুনে আদিবাসী ম্রোদের অর্ধশতাধিক ফলজ বাগান ও ব্যাপক জুমভূমি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ২২-২৩ মার্চ ২০২১ দুইদিনব্যাপী জ্বলতে থাকা আগুনে চিম্বুকের ম্রো সম্প্রদায়ের ৫টি গ্রামের ৫০-৬০টি বাগান ও বহু জুমভূমি পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। গ্রামবাসীরা অনেকেই এই ধ্বংসাত্মক অগ্নিসংযোগের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে পাথর ব্যবসায়ীদের দায়ী করছেন। তবে কেউ কেউ এটা চিম্বুকে পাঁচতারা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণকারী মহলের ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করছেন।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীরা ৩০৮নং উত্তর হাঙ্গর মৌজা খালের পাথর উত্তোলন শেষ করে পাহাড়ের বড় বড় পাথর খোঁজার জন্য এই আগুন লাগিয়ে দেয়।

সূত্রমতে, গত ২২ মার্চ ২০২১ রাতের দিকে পাথর ব্যবসায়ীরা পাহাড়ে এই অগ্নিসংযোগ করে। তারপর সেই আগুন প্রবাহিত হতে হতে পরের দিন ২৩ মার্চ ২০২১ মধ্যরাত পর্যন্ত চিম্বুক পাহাড় এলাকার রামরী পাড়া, বাইট্টা পাড়া, রাংলাই পাড়া, সিংচ্যং পাড়া ও দেওয়াই পাড়ার ২৫০ অধিক পরিবারের প্রায় ৫০-৬০টি আম, আপেল কুলসহ বিভিন্ন ফলজ বাগান আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়। সেই সাথে গ্রামবাসীর ৫,০০০ ফুট পানির পাইপও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩-৪ কোটি টাকা হবে জানা যায়। পাহাড়ে এখনো আগুন জ্বলছে এবং এ নিয়ে পাড়াবাসীর মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে বলে জানা গেছে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী মনে করছেন এই অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি একটি ষড়যন্ত্র। তারা মনে করছেন, পাঁচতারা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে ম্রোদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনকে দুর্বল ও ধ্বংস করতে কৌশলে এই আগুন লাগানো হয়েছে। তাদের মতে, ২০০৬-০৭ সাল থেকে পাহাড় পুড়ে পাথর উত্তোলন করা হলেও এবারের মতন নজীরবিহীন আগুন লাগানোর ঘটনা এই প্রথম। তারা মনে করেন, এ আগুন এমন সময়ে লাগলো যখন ২০ মার্চ ২০২১ চিম্বুকের পাহাড়ে পাঁচতারা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় তদন্ত দল পরিদর্শনে এসে ২১ মার্চ ২০২১ ম্রোদের সাথে মতবিনিময় করে। তাতেও ম্রোরা চিম্বুকে পাঁচতারা হোটেলসহ পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের দাবিতে তাদের অনড় অবস্থান ব্যক্ত করে।

ভুক্তভোগী রামরী পাড়ার অধিবাসী ও রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী চ্যংঙি ম্রো বলেন, গত ২২ মার্চ রাতের বেলায় তাঁদের পাড়া থেকে দূরে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। এই আগুন মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) সারাদিন ও রাত ১২ টা পর্যন্ত নেভাতে গ্রামবাসীদের বেগ পেতে হয়েছে।

চ্যংঙি ম্রো জানান, আমাদের উত্তর হাঙ্গর মৌজা খাল থেকে অনেক বছর ধরে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এখন এই খালের সমস্ত পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। এই পাথর শেষ করে এখন পাহাড়ের বিভিন্ন খাদে পড়ে থাকা পাথর উত্তোলনের জন্য হন্যে হয়ে নেমেছে স্থানীয় বাঙালি পাথর ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এই পাথরগুলো জঙ্গলাবৃত থাকায় এগুলো খুঁজে বের করাটা কষ্টসাধ্য। তাই বিভিন্ন সময় পাথর ব্যবসায়ীরা এই পাথর খুঁজতেই জঙ্গলে বেপরোয়াভাবে আগুন দেয় আর পাথর খোঁজে।

রামরী পাড়ার কার্বারি মেনরুম ম্রো বলেন, আমার নিজের বরই বাগান পুড়ে গেছে। গত ৩ বছর ধরে যে ৪০০ বরই গাছ ফল দিচ্ছে তার পুরোটাই ছাই হয়ে গেছে। তাছাড়া ২৫০টির মত চারা গত বছর নতুন লাগিয়েছি। সেগুলোও ছাই হয়ে গেছে। এছাড়া গ্রামের অনেকের আম বাগান, লিচু বাগান, ড্রাগন ফলের বাগান, পেঁপে বাগান পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই পরিবারগুলো এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

কার্বারি মেনরুম ম্রো জানান, আগুনে তার ৪০০টি বড়ই গাছ ও ৬০০টি আম গাছসহ ৪-৫ টি বাগানের সর্বমোট ১৫ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি ভুক্তভোগী সবাইকে নিয়ে বসে সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য দাবি জানাবেন বলে জানান।

আরেক ভুক্তভোগী চ্যংঙি ম্রো জানান, আগুনে পুড়ে পাড়াবাসী আতঙ্কের মধ্যে আছে। কেবল তার গ্রামে ৫০ লক্ষ টাকার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।