করোনার কারণে দেশের আদিবাসীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়: আদিবাসী ফোরাম

0
921

হিল ভয়েস, আগস্ট ২০২০, ঢাকাকরোনা মহামারীর কারণে দেশের আদিবাসীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়েছে। এই পরিস্থিতি যদি আরো দীর্ঘায়িত হয়, তবে আদিবাসী প্রান্তিক মানুষের অবস্থা হবে আরো শোচনীয়। করোনাকালেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারী ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখন থমকে আছে আর পাহাড়ের মানুষ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।

“আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২০” উপলক্ষে আজ ৬ আগস্ট ২০২০ বৃহস্পতিবার সকাল ১১.৩০টায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিমত তুলে ধরেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সভাপতি অজয় এ মৃর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষে মূল বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। এছাড়াও অতিথি হিসেবে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ও অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

ভার্চুয়ালসংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মূল বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী জনগণ দরিদ্রদের মধ্যেও সবচেয়ে প্রান্তিক। তারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। এখন করোনার কারণে আদিবাসীদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে। আদিবাসী সংগঠনসমূহের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এরই মধ্যে আমাদের দেশে সমতলের আদিবাসীরা শতকরা ৭০ ভাগ দারিদ্র সীমার নীচে চলে গেছে। অনেক আদিবাসী চাকুরি হারিয়েছেন।

শহরে আদিবাসী গার্মেন্টস কর্মী, হোটেল কর্মী, বিউটি পার্লারের নারী কর্মী, গাড়ি চালক, গৃহকর্মী, সিকিরিটি গার্ড ও অন্যান্য ইনফরমাল সেক্টরের আদিবাসীরা তাদের চাকুরি হারিয়ে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। এই ধরনের চাকুরি হারানো আদিবাসী মানুষের সংখ্যা অন্তত কয়েক হাজার হবে। কৃষি ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত আদিবাসীদের অবস্থাও অনিশ্চিত। যে সকল আদিবাসী দিনমজুর ও দৈনিক পারিশ্রমিকের কাজ করেন, তাদের জীবনেও নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতি যদি আরো দীর্ঘায়িত হয়, তবে আদিবাসী প্রান্তিক মানুষেরা অবস্থা হবে আরো শোচনীয়।

করোনা মহামারীর এমনি সংকটে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা সহায়তা প্রদানের দাবি জানায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। এই ধরনের প্রণোদনা প্রদানের সময় স্থানীয় আদিবাসী সংগঠনসমূহকে যুক্ত করতে হবে যাতে কোনো আদিবাসী বঞ্চিত না হন। এবারে বিশাল আকারের বাজেট প্রণীত হলেও করোনা-সহায়তা হিসাবে আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি বলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ক্ষোভ প্রকাশ করে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয় যে, সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী  ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক সময় যেসব অঞ্চলে আদিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেখানে ‘পপুলেশন ট্রান্সফারের’ ফলে আদিবাসী জনগণ নিজ ভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।

আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই করোনাকালেও আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হুমকি, ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারী ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখন থমকে আছে আর পাহাড়ের মানুষ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনকর্মীদের দমানোর জন্য তাদের ঘরে ঘরে তল্লাশি, হয়রানি, অমানুষিক নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর-পাকড়, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িতকরণ, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অপরাধীকরণ, জেলে প্রেরণ ও এলাকাছাড়া করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অবস্থাও ভালো নয়। সরকার বার বার সমতলের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন করেনি। এই বিষয়ে ন্যূনতম পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো লক্ষণ নেই।

সংবাদ সম্মেলনে আলোচনা অংশগ্রহণ করে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি আদিবাসী ফোরামের উত্থপিত সকল দাবির সাথে সংহতি জানিয়ে বলেন, করোনাকালে আদিবাসী জীবনজীবিকা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে তার জন্য আলাদা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা অত্যাবশ্যক। তিনিও অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রদানের দাবি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, আদিবাসীকে প্রান্তিকের দিকে ঠেলে দেয়া মানে গোটা বিশ্বকে প্রান্তিকে ঠেলে দেয়া। পৃথিবীকে রক্ষা করতে গেলে আদিবাসীদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে। এজন্য আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারের অধিকারকে রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানান।

গ্রেটা থুনবার্গ নামে একজন সুইডিশ মানবাধিকার কর্মী‍র মতামত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার বিভাগের শিক্ষক রৌবায়েত ফেরদৌস বলেন, তথাকথিত স্বাভাবিক সময়েও আদিবাসীরা ভালো ছিল না। তাই তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না গিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার আবশ্যকতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গোটা বিশ্বকে সুন্দর ও সুষ্ঠু করে তোলার জন্য, সবার জন্য বাসযোগ্য করে তোলার জন্য আদিবাসী ও শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপের কোন বিকল্প নেই।

জাতিসংঘ ঘোষিত এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২০-এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় “COVID-19 and Indigenous Peoples’ Resilience”। জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবনযাত্রার প্রেক্ষাপটে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে “কোভিড-১৯ মহামারীতে আদিবাসীদের জীবনজীবিকার সংগ্রাম” ঘোষণা করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামসহ দেশের আদিবাসী ও মানবাধিকার সংগঠনসূহের সপ্তাইব্যাপী কমূসূচি ঘোষণা করা হয়। করোনা মহামারীর কারণে সকল কর্মসূচী ভার্চুয়ালে হবে বলে জানানো হয়। তার মধ্যে থাকবে ৯ আগস্ট থাকবে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি, যথাক্রমে ফোরামের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের ভিডিও শুভেচ্ছা বার্তা, আদিবাসী শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনা, বিকালে ওয়েবিনার আলোচনা, রাত ৮টায় কোভিড মহামারিতে মৃত্যুবরণকারীদের স্মরণে ও ধরিত্রীর মাতার উদ্দেশ্যে স্ব স্ব বাড়ি থেকে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও এক মিনিট মৌনব্রত পালন।

ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আদিবাসী ফোরামের ১৩ দফা দাবিনামা তুলে ধরা হয়। দাবিনামার মধ্যে আদিবাসীসহ সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা; করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় এককালীন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান করা; কমপক্ষে ১০,০০০ হাজার আদিবাসী পরিবারকে করোনাকালে খন্ডকালীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা যাতে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে না পড়ে, তার জন্য আর্থিক সহায়তাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও অপপ্রচার বন্ধ করা; আদিবাসী নারীসহ সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি অন্যতম।