কোভিড-১৯ মহামারী কালে আদিবাসীদের ঝুঁকি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বৃদ্ধি পেয়েছে

0
741

হিল ভয়েস, আগস্ট ২০২০, ঢাকা: কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে, চাকরি হারানো, খাদ্য সংকট, পর্যাপ্ত সরকারী ত্রাণের অভাব, ঋণগ্রস্ত হওয়া, যথাযথ স্বাস্থ্য সুবিধা লাভের অভাব, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে আদিবাসী শিশুদের বঞ্চনা ছাড়াও, আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভূমি বেদখলের ঘটনা, জীবন-জীবিকার ঝুঁকি, আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই তথ্য পাওয়া গেছে ‘এ র‍্যাপিড এ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট: দি ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯ অন ইন্ডিজেনাস এন্ড ট্রাইবাল পিপলস্’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে। গত ৫ আগস্ট ২০২০ বুধবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে আদিবাসীদের মানবাধিকার বিষয়ক এক গবেষণা সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশন কর্তৃক এই পরিস্থিতি নিরূপণ গবেষণা সম্পাদন করা হয়।

কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সঞ্চালনায়, ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট কালেক্টিভ (আরডিসি)-র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্য নিরূপা দেওয়ান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি ও কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেন, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক পার্থ শংকর সাহা, ঢাকার আইএলও-র ইন্ডিজেনাস ও ট্রাইবাল পিপলস প্রোগ্রাম এর জাতীয় কর্মসূচি সমন্বয়ক এলেক্সিয়াস চিচাম, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক (বিআইডাব্লিউএন) এর যুগ্ম আহ্বায়ক ফ্লোরা বাবলি তালাং, এবং বাংলাদেশ আদিবাসী সাংস্কৃতিক ফোরামের চন্দ্রা ত্রিপুরা। প্রতিবেদনের গবেষক ও লেখক ত্রিমিতা চাকমা গবেষণার এই ফলাফল উপস্থাপন করেন।

তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় দেশের ১৪টি বিভিন্ন জেলায় বসবাসকারী ১৬টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী থেকে। এই প্রতিবেদনের একটি বিরাট অংশ ছিল আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর কোভিড-১৯ এর অভিঘাত বিষয়ে। এর মধ্যে একটি অংশে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, মার্চ থেকে জুন, এই চার মাসে অন্তত তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। দেশের সর্বত্র আদিবাসীদের ভূমি বেদখল এই কঠিন সময়েও থেমে থাকেনি। আদিবাসীদের মালিকানাধীন ৬,০০০ একরের অধিক ভূমি বেদখল করা হয়েছে। নির্বিচার গ্রেফতার ও বাড়ি তল্লাসীসহ, অন্তত ৬৫টি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে।

আদিবাসীদের জীবিকার উপর প্রভাব

দেশের স্বল্প আয়ের ও প্রান্তিক গোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য সরকার কর্তৃক দরিদ্র ও প্রান্তিক গোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ সত্ত্বেও, অধিকাংশ আদিবাসী এইসব কর্মসূচি থেকে হয় সামান্য সহায়তা পেয়েছেন বা কোন সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন।

উহাহরণস্বরূপ, কক্সবাজারে রাখাইন সম্প্রদায়ের মাত্র ২% লোক সরকারী রেশন কার্ড ব্যবস্থায় তালিকাভুক্ত হন এবং ত্রাণ গ্রহণ করেন। একইভাবে নাটোরে মাল পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মাত্র ১০ শতাংশ ত্রাণ পেয়েছেন। ময়মনসিংহ ও শেরপুরে বসবাসকারী হোদি ও বানাই জনগোষ্ঠী, দিনাজপুর চাকলার মুষহোর এবং সিলেটে বসবাসকারী পাত্র জনগোষ্ঠী হয় কোন ত্রাণ পায়নি অথবা খুব সামান্য পেয়েছে।

কোভিড-১৯ অচলাবস্থার কারণে অনেক সম্প্রদায়ের সদস্য তাদের চাকরি হারিয়েছেন। দিন মজুরির উপর তাদের জীবন নির্ভরশীল হওয়ায়, লকডাউনের সময় তারা তাদের বেঁচে থাকার উপায় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

প্রতিবেদন অনুসারে, চলাচলের উপর বাধা-নিষেধ জারি, সারের অভাব ও উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রয়ে স্থানীয় বাজার বন্ধ হওয়ার কারণে, কৃষিজ শস্য উৎপাদন কর্মকান্ডও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যেমন- বান্দরবানের বাত্যাপাড়ায় বসবাসকারী ¤্রাে সম্প্রদায় জুমভূমির অভাবের কারণে মিশ্র ফল বাগানের দিকে ঝুঁকেছে। এখন লকডাউনের কারণে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য অনেক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, অথচ তাদেরকে দ্বিগুণ দামে চাল কিনতে হচ্ছে।

হঠাৎ আয়ের অভাব, চলাচলের উপর বাধানিষেধ, এবং সাপ্তাহিক বাজার বন্ধ হওয়ার কারণে, অধিকাংশ দরিদ্র আদিবাসী পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, দিনাজপুরের চাকলা ও খোরাখাই এলাকায় মুষহোর গ্রামবাসীরা খাদ্য ফুরিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন এবং তারা অনাহারে থাকছেন। লকডাউনের কারণে তারা পার্শ্ববর্তী জলাভূমি ও জলাধারে মাছ ধরতে যেতেও পারছেন না।

কোভিড-১৯ সংকটের কারণে উদ্ভূত এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অনেক দরিদ্র আদিবাসী সম্প্রদায় স্থানীয় সুদখোরদের থেকে উচ্চ হারে লোন নিয়ে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে।

অধিকাংশ আদিবাসী সম্প্রদায় বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করে, এবং তাদের সন্নিকট এলাকায় যথাযথ স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকে না। সরকার যেখানে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা প্রস্তুতিতে বিভিন্ন জায়গায় ইতোমধ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আদিবাসী গ্রামসমূহের দুর্গমতা কেবল করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য নয়, অন্যান্য প্রকার স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনসমূহের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ, যেমন আদিবাসী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনসমূহ (উদাহরণস্বরূপ, গর্ভাবস্থা) এর জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা লাভের ক্ষেত্রে তাদেরকে বিশেষভাবে অরক্ষিত করে তোলে।

মহামারীর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ১৭ মার্চ ২০২০ সরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার পর, সুবিধা-বঞ্চিত সম্প্রদায়ের শিশু ও তরুণদের শিক্ষা কার্যক্রম তীব্রভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে বিদ্যমান ডিজিটাল বিভাজনের কারণে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী অনেক শিশু ও তরুণ সরকারের দূরবর্তী শিক্ষণ (অনলাইন শিক্ষা) উদ্যোগ থেকে বঞ্চিত হয়। প্রত্যন্ত এলাকার অনেক পরিবার যেখানে খাদ্য সংস্থানের জন্য সংগ্রাম করছে এবং তাই টিভি, স্মার্টফোট ও ইন্টারনেটের সুবিধা এসব সম্প্রদায়ের জন্য বিলাসসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হয়।

ভীতিপ্রদর্শন হয়রানি

চলমান মহামারী সংকটের মধ্যে, নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও নজরদারী বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিকার লংঘনের মধ্যে রয়েছে হয়রানি, ভীতিপ্রদর্শন, নির্বিচারে বাড়ি তল্লাসী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, যৌন সহিংসতা, অপহরণ ও হুমকির ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের রিপোর্ট অনুসারে, জানুয়ারি-মে ২০২০ এর মধ্যে নজরদারী বাহিনী অন্তত ২৯ জন লোককে অপহরণ করেছে। মার্চ-জুন ২০২০ এই চার মাসের মধ্যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬৩টি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে, যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১৫ জনকে নির্বিচারে গ্রেফতার, ৮ জনকে আটক, ২৯ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও হয়রানি, ৪৬টি বাড়িতে ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাসী। এছাড়া আরও অভিযোগ রয়েছে যে, সংকটের সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা স্থানীয়দের চিকিৎসা সুবিধা লাভে বাধাগ্রস্ত করছে এবং পরিস্থিতিকে অধিকতর শোচনীয় করে তুলছে।

কোভিড১৯ এর মধ্যে ভূমি বেদখল

মহামারীর চলমান সংকটের মাঝেই, ব্যক্তি ভূমি বেদখলকারীরা, প্রাইভেট কোম্পানিসমূহ ও নিরাপত্তা বাহিনী ভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের নামে দেশের সর্বত্র আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূখন্ড দখল অব্যাহত রেখেছে। কাপেং ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে, মার্চ ও জুন ২০২০ এর মধ্যে, আদিবাসীদের মালিকানাধীন অন্তত ৬,৫০৪ একর ভূমি হয় দখল করা হয়েছে অথবা দখলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। চলমান কোভিড-১৯ সংকট সত্ত্বেও, সমতল অঞ্চলে, যেমন- চাপাইনবাবগঞ্জের আদিবাসীরা দুস্কৃতকারী গোষ্ঠী কর্তৃক তাদের চাষযোগ্য ভূমি, বাড়ি, পুকুর, কবরস্থান, শ্মশানভূমি ও একটি মন্দিরের মালিকানাধীন ভূমি জোরপূর্বক বেদখলের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছে। শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় অনুরূপ ভূমি বেদখলের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল একটি নিয়মিত ঘটনা হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি, এজেন্সি ও এমনকি প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় ভূমি বেদখল করছে।

গবেষণাকালের মধ্যে (মার্চ-জুন ২০২০) ভূমি মালিকদের উপর হামলা ও আদিবাসীদের মালিকানাধীন কৃষিজ বাগান ধ্বংসের কয়েকটি ঘটনা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, নিরাপত্তা বাহিনী আদিবাসীদের স্বাধীন পূর্ব-অবহিত সম্মতি ব্যতিরেকে আদিবাসীদের ভূমির উপর তাদের স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে। চলমান ভূমি বেদখল প্রক্রিয়ার ফলে অনেক আদিবাসী পরিবার তাদের পূর্ব পুরুষের ভূমি থেকে উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে বসবাস করছে।

আদিবাসী নারী নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা

মহামারী প্রাদুর্ভাব ও লকডাউন সত্ত্বেও আদিবাসী নারী ও নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা অবাধে চলমান রয়েছে। জানুয়ারি-জুন ২০২০ এর মধ্যে ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা ও শারীরিক হামলাসহ মোট ১৪টি আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এরূপ ১৪টি ঘটনার মধ্যে সমতলে ১০টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪টি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।

উপসংহার সুপারিশ

বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অনুঘটকের কারণে কোভিড-১৯ এর কাছে যারা অধিকতরভাবে অরক্ষিত বা ঝুঁকির মুখে, তাদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী। সেই কারণে কোভিড-১৯ এর লকডাউন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারসাম্যহীনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যারা ইতোমধ্যে নিদারুণ দারিদ্রতায় ভুগছে এবং তারা তাদের জীবিকা হারাচ্ছে ও ঋণগ্রস্ত হওয়ায় দারিদ্রের হার অধিকতর অবনতির দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ ‘সমগ্র সমাজ’ এগিয়ে যাওয়াকে অনুসরণ করছে, যা প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিশেষায়িত প্রয়োজনসমূহের প্রতি নজর দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজন তীব্র খাদ্য সংকটের মুখে অরক্ষিত/ঝুঁকিপূর্ণ আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রয়োজনসমূহের নজর দিতে কোভিড-১৯ সংকটের অভিঘাত মোকাবেলার জন্য স্থানীয়ভাবে স্বতন্ত্র পদক্ষেপ গ্রহণ করা।