আদিবাসী সংস্কৃতি, পরিবেশ ও পার্বত্য চুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নের দাবি জেএসএস প্রতিনিধির

0
345

হিল ভয়েস, ২৬ এপ্রিল ২০২৩, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি অগাস্টিনা চাকমা বলেছেন, আদিবাসী হিসেবে আমরা উন্নয়নের বিপক্ষে নই। আমাদের দাবি হল এমন উন্নয়ন যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সমুন্নত রাখবে।

জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি অগাস্টিনা চাকমা এই অভিমত ব্যক্ত করেন, যখন তিনি গত ২৫ এপ্রিল ২০২৩ জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের ২২তম অধিবেশনে বিকেলের সভায় এজেন্ডা ‘আইটেম ৪: জাতিসংঘের আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র এবং ২০৩০ সালের স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন এজেন্ডা বিষয়ে স্থায়ী ফোরামের ছয়টি এখতিয়ারাধীন ক্ষেত্র (অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকার) বিষয়ে আলোচনা’ এর উপর বক্তব্য প্রদান করছিলেন।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগমও গত ২৫ এপ্রিল এজেন্ডা আইটেম ৪-এর উপর বক্তব্য প্রদান করেন। তার বক্তৃতায়, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের (তার মতে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু) উন্নয়ন বিষয়টি ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছিলেন।

জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি অগাস্টিনা চাকমার বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ নিম্নরূপ:

আমরা যখন ছয়টি এখতিয়ারাধীন ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করতে একত্রিত হই, আমি আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমির মালিকানার গুরুত্বের ওপর অত্যাধিক জোর দিতে চাই। আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার ভূমি অধিকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং এটি ছাড়া টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অসম্ভব।

আমি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের পরিস্থিতির দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ভূমি, বন, পাহাড়, পুকুর, ছড়া, ছোট নদী তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। দুর্ভাগ্যবশত, এই এলাকার অধিকাংশ আদিবাসীদের ভূমি বহিরাগত বাঙালি বা সেটেলাররা বেদখল করে নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে। সরকার তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে এসে বসতি দিয়েছিল এবং এদের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ।

আদিবাসী জুম্ম জনগণের বেহাত হওয়া ভূমি সংক্রান্ত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির আলোকে ১৯৯৯ সালে ভূমি কমিশন গঠিত হয় কিন্তু সরকারের আন্তরিকতার অভাবের কারণে এযাবৎ বিভিন্ন সময়ে ছয়জন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হলেও এটি কার্যকর হতে পারেনি।

জনসংহতি সমিতি কর্তৃক আলোচনা এবং চাপের ১৫ বছর পর ২০১৬ সালে ২০০১ সালের আইনের কিছু বিরোধার্থক ধারা সংশোধন করা সত্ত্বেও, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ২০১৭ সালে খসড়া বিধিমালা জমা দিলেও, কমিশন এখনও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কার্যবিধিমালা প্রণয়ন করেনি।

২০০১ সালের ভূমি কমিশন আইনের ২০১৬ সালের সংশোধনী সত্ত্বেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে আদিবাসীরা ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ এবং ভয়ভীতির ঝুঁকিতে পড়েছে। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হল, লামা রাবার কোম্পানি ৪০০ একর ঐতিহ্যবাহী জুম চাষের ভূমি এবং গ্রামের বন পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার আদিবাসীদের ভূমি অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসেনি বরং রাবার কোম্পানির ভূমি দখলে সহায়তা করেছে। এই অবিচারের ফলে আদিবাসীদের ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম এবং তাদের ভূমি অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণের জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

উল্লেখ্য যে, যদিও বাংলাদেশের সম্মানিত প্রতিনিধি গত সপ্তাহে এই ফোরামে দাবি করেছেন যে, এই বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য ১৫৫৫টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে, কিন্তু আদিবাসীরা ক্রমাগত তাদের জমি হারাচ্ছে এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে। যতই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হোক না কেন, আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত না হলে এই উন্নয়ন কর্মসূচি তাদের কোনো উপকারে আসতে পারে না।

আদিবাসী হিসেবে আমরা উন্নয়নের বিপক্ষে নই। আমাদের দাবি হল, আমরা এমন উন্নয়ন চাই যে উন্নয়ন আমাদের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সমুন্নত রাখবে।

তাই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কর’ শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য আমাদের প্রাণের দাবি। আমাদের অবশ্যই ২০৩০ সালের মধ্যে আদিবাসী জুম্ম জনগণের জন্য একটি টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে হবে। আসুন আমরা এই লক্ষ্যের দিকে আমাদের প্রচেষ্টাকে সংহত করি এবং একসাথে, সবার জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যত তৈরি করি।

আরো পড়ুন

স্পেশ্যাল র‍্যাপোর্টিউরকে অপরাধীকরণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে জনসংহতি সমিতি

তথাকথিত উন্নয়ন আমাদের জীবিকা, বন, পরিবেশ ধ্বংস করছে: জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামে জেএসএস প্রতিনিধি

স্থায়ী ফোরামে আদিবাসী কর্মীদের উপর ডিজিএফআই-এর নজরদারি কি জাতিসংঘের মানবাধিকার নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?