সুশাসনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক: জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের সংলাপে জেএসএস

0
1251

হিল ভয়েস, ২১ জানুয়ারি ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম (পিএফআইআই) কর্তৃক আয়োজিত ভার্চুয়াল এশিয়া আঞ্চলিক সংলাপে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) প্রতিনিধি বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সুশাসন জোরদারকরণ এবং গণমুখী ও পরিবেশ-বান্ধব উন্নয়ন এবং আইনের শাসন নিশ্চিতকরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি আরও বলেছেন যে, বর্তমানে চুক্তি বাস্তবায়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যকর সামরিক শাসন ‘অপারেশনউত্তরণ’ এবং ৪০০ এর অধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের সামরিক কর্তৃত্ব, যা ২০১১ সালে পিএফআইআই এর গবেষণায়ও উল্লেখ করা হয়েছিল।

২০২১ সালের অধিবেশনের প্রস্তুতির প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরাম আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাথে ১৯-২০ জানুয়ারি ২০২১ (ব্যাংকক সময়) দুই দিনব্যাপী অনানুষ্ঠানিক এশিয়া আঞ্চলিক সংলাপ পরিচালনা করে। জাতিসংঘ এজেন্সি, তহবিল ও কর্মসূচিসমূহ, আঞ্চলিক ও জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহ, ইকোসক এর পরামর্শদায়ক মর্যাদাসম্পন্ন এনজিওসমূহ, এবং বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক-গবেষক, বিশেষজ্ঞদেরকেও অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।

গত ১৯ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরাম-এর বিশেষজ্ঞ সদস্য মি: ফুলমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে ‘এশিয়ায় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব’ এবং ‘ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদের অধিকার’ শীর্ষক দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এসব বিষয়ে যথাক্রমে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্ডিজেনাস ইয়ুথ নেটওয়ার্ক এবং ঝাড়খন্ড ইন্ডিজেনাস এন্ড ট্রাইবাল পিপল্স ফর এ্যাকশন এর মীনাক্ষী মুন্ডা এবং সাবাহ্ এর সংসদ সদস্য এবং এমরিপ (ঊগজওচ) ও সুহাকাম (ঝটঐঅকঅগ) এর সাবেক সদস্য জেনী লাসিমব্যাং আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

গত ২০ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরাম-এর বিশেষজ্ঞ সদস্য মিস শাও শিয়াও এর সভাপতিত্বে ‘সংঘাত/নিবারণ ও শান্তি (এসডিজি ১৬)’ এবং ‘সংস্কারসাধিত জাতিসংঘ উন্নয়ন ব্যবস্থার আওতায় জাতীয় পর্যায়ে জাতিসংঘ ব্যবস্থার সাথে কাজ করা – আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য সুযোগসমূহ’ শীর্ষক দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে যথাক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা ও জাতিসংঘ উন্নয়ন সমন্বয় কার্যালয় এর এশিয়া প্যাসিফিকের আঞ্চলিক পরিচালক নিল বুহ্নে বক্তব্য প্রদান করেন।

অন্যান্যের মধ্যে মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপল্স প্যাক্ট (এআইপিপি) এর সেক্রেটারি জেনারেল গ্যাম শিমরে, ফিলিপাইনের রবি হ্যাল্প, হিল ভয়েসের নির্বাহী সম্পাদক প্রীতিবিন্দু চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বিনোতাময় ধামাই, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের চঞ্চনা চাকমা, সোথি কিয়েন প্রমুখ।

পিসিজেএসএস প্রতিনিধি মঙ্গল কুমার চাকমা তাঁর বক্তব্যে বলেন, সংঘাত নিবারণ ও শান্তি, টেকসই উন্নয়ন, ন্যায়বিচার লাভ এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কার্যকর, জবাবদিহি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি ১৬) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি সংঘাত হ্রাস করতে পারে এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকারের উন্নতি বিধান করতে পারে। শান্তি, স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার, এবং আইনের শাসন ভিত্তিক কার্যকর শাসনব্যবস্থা ব্যতীত আমরা টেকসই উন্নয়ন আশা করতে পারি না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, এশিয়ার অধিকাংশ আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ সামরিকায়ন, সংঘাত ও সহিংসতার দুষ্টচক্রে পতিত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এই মহামারীর সময় এশিয়ায় কয়েকটি রাষ্ট্রকে অধিকতর দমনমূলক হতে দেখেছি। কোভিড-১৯ ভাইরাসকে ব্যবহার করা হয়েছে ভীতিপ্রদর্শন, গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা দায়ের ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করার জন্য এক ট্রোজান ঘোড়া হিসেবে। এটা ব্যবহার করা হচ্ছে এশিয়াব্যাপী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কিত রক্ষাকবচ ও অধিকারসমূহ দূর্বল করা অথবা স্থগিত রাখার জন্য। তাদের (আদিবাসীদের) ন্যায়সঙ্গত কার্যক্রমকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিতকরণ ও অপবাদরটনাসহ তাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপক লংঘন করে এমন উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিরোধকে দমন করার জন্য সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীসমূহকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, উত্তরপূর্ব ভারত, মিয়ানমার ও নেপালে এমন ধরনের ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়।

এশিয়াব্যাপী সমস্যার কৃত্রিম সমাধান প্রদান করা এবং ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করার জন্য নাগরিক অধিকারের জায়গাকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এশিয়া অঞ্চলে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসমূহ হচ্ছে ক্ষতিকর আইন ও নীতিমালার সবচেয়ে অরক্ষিত ও সবচেয়ে মারাত্মক শিকার। তিনি ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত ও বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরেন।

মি: চাকমা উল্লেখ করেন, শান্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি এশিয়ায় অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন এই অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের নিজেদের কর্তৃক স্বশাসন নিশ্চিতকরণ ও নিজেদের উন্নয়নের চাহিদা নির্ধারণের লক্ষে জেলা পর্যায়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৩ বছরেও এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে সাধারণ প্রশাসন, আইন ও শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন, পরিবেশ ইত্যাদিসহ ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর না করার ফলে, ঐ বিশেষ শাসনব্যবস্থা এখনও যথাযথভাবে চালু করা হয়নি এবং আত্মনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিকাশ লাভ করেনি।

তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সরকার এসব পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, যা তাদের ভোটাধিকারের মৌলিক অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার থেকে আদিবাসী জুম্ম জনগণকে বঞ্চিত করেছে। তাই উন্নয়ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে আদিবাসী জুম্ম জনগণের কার্যকর ও ফলপ্রসূ অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকাকে অস্বীকার করা হয়েছে, যা তাদের জাতীয় অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও জীবিকার উপর প্রতিকূল প্রভাবের দিকে পরিচালিত করে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ পরিচালিত হচ্ছে অগণতান্ত্রিকভাবে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সেই পার্টিও সদস্যদের পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে। মনোনীত অন্তবর্তীকালীন পরিষদসমূহ দ্বারা পার্বত্য প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিচালনার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে আছে।

তিনি আরও বলেন যে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে আদিবাসী জুম্ম জনগণ ও বাঙালি সেটেলারদের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ প্রতিনিয়ত সংঘটিত হয়ে আসছে। এমনকি প্রাণঘাতি কোভিড-১৯ মহামারীর সময় রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় মহল কর্তৃক আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীদের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ থেমে থাকেনি। অন্যতম জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে আদিবাসী ম্রো জনগণের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ করে সেনাবাহিনী কর্তৃক বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে একটি পাঁচ তারকা হোটেলসহ বিলাসবহুল পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ন্যায় সমতলভূমিতেও ভূমি বিরোধ সংশ্লিষ্ট সংঘাত ও সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে এবং সেখানকার আদিবাসী জনগণও ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের ভূমি হারাচ্ছে।

জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি বলেন, সরকার শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করেনি, উপরন্তু ইহা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার আদিবাসী অধিকারকর্মী ও সংগঠনসমূহকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’ ও ‘সশস্ত্র দুর্বৃত্ত’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্তকরণ কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সামরিক বাহিনী কর্তৃক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপর সংবাদ প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, যার কারণে অঞ্চলটি অবরুদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছে।

২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি ১৬ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য, তিনি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ন্যায় রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র (সরকার) ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান; এব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর স্থায়ীত্বশীল শান্তি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এবং দেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেয়া উচিত।

এছাড়া জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি সামরিকায়ণ, সামরিক অভিযান (যেমন ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক প্রকার সেনাশাসন), আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি বেদখল ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার লংঘন জোরদারকরণ বন্ধ করার দাবি জানান।