১৭ আগস্ট: চাকমা জনগোষ্ঠীর কালো দিবস-৩

0
1115

নিরঞ্জন চাকমা

দেশ বিভাগ: চাকমাদের জীবনে প্রদোষকালের সূত্রপাত

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের রাত্রির মধ্যযামে দিল্লীর লালকেল্লা থেকে পন্ডিত জওরলাল নেহেরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আবেগ-মথিত কন্ঠে ভারতের পরম আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ঘোষণা করে ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি বা নিয়তির সঙ্গে অভিসার নামের ভাষণ প্রদান করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে প্রশংসামূলক বহুল আলোচনা হয়েছে। এই সুদীর্ঘ ভাষণের প্রসঙ্গে কোন এক কবি বলেছেন-

স্বাধীনতার প্রভাব এসেছে সিংহবাহনে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বেলায় বলতে হয় স্বাধীনতা প্রভাব এসেছে দুর্গতিবাহনে। কারণ স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে দেশভাগের সময় ভারতের জাতীয় নেতাদের চরম অবহেলার দরুন এই আদিবাসী ও অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য জেলাটি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তারা হারিয়েছে স্বশাসনের অধিকার, বিপন্ন হয়েছে অস্তিত্ব, হাতছাড়া হয়েছে জমিন-জিরত, ‘এথনিক ক্লিনসিং’ প্রক্রিয়ায় স্ব-ভূমি থেকে বিপুল সংখ্যায় উৎখাত হয়েছে, বার বার আক্রান্ত হয়ে চলেছে জাতিদাঙ্গায়, ভারতের শরণার্থী হতে হয়েছে একাধিকবার। বর্তমানে নিজ বাসভূমিতে পরবাসী হয়ে বিশ^ময় পরিচিতি লাভ করেছে ইহুদিদের মতো ‘ডায়াসপোরা’ নামে। স্বাধীনতা তাদের জীবনে এনে দিয়েছে ঘোর প্রদোষকাল।

দেশ বিভাগের বীজ অজান্তে বপন করা হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়কাল থেকেই।বঙ্গভঙ্গের আদেশ কার্যকরী হওয়ায় সাড়ে চৌদ্দমাস পরেই ১৯০৬ এর ৩০ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার নবাব মহম্মদ সলিউল্লাহ এর অগ্রণী ভূমিকায় মুসলিম এলিট শ্রেণীর লোকদের উপস্থিতিতে প্রথম মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম দিকে অবশ্য এই নবগঠিত সংগঠনের তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না। মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় কংগ্রেস দলেরই অধিক জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু কালক্রমে এই সংগঠনের সঙ্গে মহম্মদ ইকবাল সহ বহু মুসলিম বিদ্বজ্জনের অংশ গ্রহণের ফলে, এবং সর্বোপরি মহম্মদ আলী জিন্নার এই সংগঠনের নেতৃত্বে গ্রহণের পর থেকেই এর বাড়-বাড়ন্ত হতে থাকে।

অপরদিকে মুসলিম লীগের শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের পরোক্ষ ভূমিকা কার্যকর হয়েছিল। আসলে সমগ্র ঊনিশ শতক জুড়ে শিক্ষা দীক্ষা, পেশা, সরকারী চাকুরী-বাকুরি, অন্যান্য সুযোগ সুবিধালাভ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে উচ্চবর্গের হিন্দুরা একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করছিলেন। তখন এসব ক্ষেত্রে মুসলমানেরা ছিলেন পিছিয়ে। বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে এই চিত্রটি গেল পাল্টে। আর এদিকে সেই ১৯০৬ সালে রোপিত সাম্প্রদায়িকতা নামের বিষবৃক্ষের বীজটি অঙ্কুরোদগমের পরে চারাগাছ থেকে বড় হতে হতে তা বিশাল আকার ধারণ করেছে। চল্লিশের দশকের শেষদিকে দেখা গেল এই মহীরুহটি কোন মতোই উৎপাটিত করা যায় না। তখন উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতারা খেয়াল করলেন বিপদ সমুৎপন্ন অর্ধেক ভাগ করাই স্বার্থরক্ষার একমাত্র উপায়। তাই তাঁরা ১৯৪৭ এর প্রথম দিকের প্রস্তাব বঙ্গ ও পাঞ্জাব বিভাজনের মাধ্যমে দেশভাগের কথা স্বীকার করে নিলেন।

গান্ধীজী কিন্তু দেশবিভাজনের কথা মানলেন না। তিনি বললেন আমার মৃত্যুর পর আমার মৃতদেহের উপর দেশভাগ হবে। তখন বুড়োর কথা শুনে কে। নেহেরু, প্যাটেল ও আজাদ দেশ খন্ডিত হলেও স্বাধীন ভারতের ক্ষমতাভোগের জন্য পরম লালায়িত ছিলেন। জিন্নাহ দেশভাগ ব্যতীত কোন কথা শুনতে রাজী নন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল হিন্দু মহাসভা প্রথম দিকে দেশভাগের প্রস্তাবে অরাজি হলেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন। আর অন্যদিকে তখনকার সময়ের গণ সংগঠনের দিক থেকে তৃতীয় শক্তি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দেশভাগের ঘোর বিরোধী। তবু তড়িঘড়ি দেশভাগ হলো। স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হলো। জিন্নাহ কিন্তু প্রাপ্ত অংশ নিয়ে অসন্তুষ্ট। বললেন- কীটদস্ত পাকিস্তান (মথ ইটন পাকিস্তান)। তিনি চেয়েছিলেন লাহোর থেকে দিল্লি। তবু সান্ত¡না অন্তত লাহোর তো পাওয়া গেছে।

এদিকে পাঞ্জাবীরা লাহোরের জন্য বিষাদগ্রস্ত হলেন চিরতরে। কারণ লাহোর ছিল পাঞ্জাব কেশরী রণজীৎ সিং এর রাজধানী পাঞ্জাবীদের শোর্য বীর্যের প্রতীক। তবু দেশভাগ হলো আপামর ভারতবাসীর দেশভাগের চূড়ান্ত সীমারেখা না জানা অবস্থায়। তাই দেখা গেল দেশময় তিক্ততম পরিণতি। দেশভাগকালীন ভয়ঙ্কর জাতিদাঙ্গার, ফলে অন্তত দশ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ হলেন আহত। দিকে দিকে বহু লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণ ও বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের দূর্ঘটনা ঘটল। বহু মানুষ হলেন গৃহহারা, দিশাহারা। অন্তত এক কোটি আশি লক্ষ মানুষ প্রাণ রক্ষার্থে নিজ পরিচিত পরিবেশ ও পরিজন ছেড়ে হলেন দেশান্তরিত। দেশান্তরের সেই প্রবাহ ক্ষীণতর হলেও এখনো চলছে, থেমে যায়নি। দেশান্তরিত জনের সুস্থিতি, সুরক্ষা ও অভয়দানের জন্য নবগঠিত দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীদের একটি চুক্তি (নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি) সম্পাদিত হলো। কিন্তু চুক্তি হলেও তা দু’দিকেই যতাযথভাবে মান্য করা হলো না। ফলে দেশভাগজনিত প্রদাহ প্রশমিত হতে লেগে গেল আরও কয়েক বছর।

দেশভাগকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ:

১৯৪৭ সালের তেসরা জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক বেতারযোগে ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ঘোষিত হলো ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের তথা এই উভয় দেশের স্বাধীনতা লাভের নির্ঘন্ট বা নির্দিষ্ট সময়সূচি। তাতে বলা হলো আগস্ট মাসের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশরা চলে যাবে নিজ দেশে। তখনই পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা নেতাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম দু’দেশের মধ্যে কোনটির সঙ্গে যোগ দেবে এই বিষয়টির উপর। আপামর চাকমা জনসাধারণের অভিমত হলো তারা ভারতের সঙ্গেই যোগ দেবেন। কারণ সংস্কৃতিগত দিক থেকে হিন্দুদের সঙ্গেই চাকমাদের মিল অধিক। চাকমা রাজা, রাজপরিবার ও দেওয়ান পদাধিকারদের তাই অভিমত। কিন্তু তাদের আশংকা হলো ব্রিটিশ আমলে যেভাবে রাজন্যবৃন্দের মর্যাদা ও ক্ষমতা সুরক্ষিত ছিল, গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতে তা সুরক্ষিত থাকবে কিনা?

এই দোদুল্যমানতা নিয়েই ঠিক হলো যে, শীঘ্রই একটি প্রতিনিধিদল দিল্লী যাবেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার জন্য। এই দলের নেতৃত্ব দেবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের একমাত্র গণসংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির সভাপতি কামিনী মোহন দেওয়ান ও চাকমা ছাত্র সংগঠনের নেতা ¯েœহ কুমার চাকমা। এছাড়া চাকমা রাজপরিবারের পক্ষ থেকেও পৃথক একটি প্রতিনিধিদল দিল্লি যাবেন যাঁর নেতৃত্বে থাকবেন  স্বয়ং চাকমা রাজা ভূবন মোহন রায় এবং তার সহযোগী থাকবেন জন সমিতির সদস্য অবনী দেওয়ান। উভয় দল পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন কংগ্রেস সভাপতি আচার্য জে বি কৃপালনি, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এই প্রতিনিধিদলকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য এই জুন মাসের শেষদিকে একটি প্রতিনিধিদল পার্বত্য চট্টগ্রামে যাবেন। এই কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকবেন জাস্টিস এ ডি ঠক্কর। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে থাকবেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, প্রফুল্ল ঘোষ, জয়পাল সিং, রাজকৃষ্ণ বোস ও ফুলবন সাহা। স্নেহ কুমার চাকমা থাকবেন কমিটির কো-ওপ্টেট সদস্য।

কথামতো নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ জুন মাসের শেষদিকে উল্লিখিত কংগ্রেসের বিশেষ প্রতিনিধিদলটি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে পৌঁছলে চাকমা রাজা সহ জনসাধারণের তরফ থেকে তাঁদের যথোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। আলোচনা সভায় চাকমাদের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে প্রতিনিধিদলটি তা তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখান করেন। অবশেষে বিনাশর্তে ভারতে যোগদানের বিষয়টি চাকমাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদলকে জ্ঞাপন করা হয়। এদিকে বেঙ্গল বাউন্ডারী কমিশন, বিভিন্ন আবেদনকারী দল, অঞ্চলবাসী ও উৎসাহী ব্যক্তি বিশেষের উপস্থিতিতে হেয়ারিং-এর জন্য দিন তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করেন।

সেই অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে ১৬ থেকে ২৪ জুলাই তারিখে কলকাতার বেলভেদরে প্যালেস-এ হেয়ারিং সভা আয়োজিত হয়। প্রথম দিনেই ছিল কংগ্রেসের দাবি উত্থাপনের দিন, যাতে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের একটি অঞ্চলকে (আয়তন ৪০,১৩৭ বর্গমাইল) ভারত ভুক্তির জন্য দাবি জানানো হয়। কিন্তু ঐদিনে বা পরবর্তী দিনগুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম দাবির বিষয়টি কংগ্রেসের তরফ থেকে কদাপি উত্থাপিত হয়নি। অথচ মুসলীম লীগের তরফ থেকে ১৯ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি করার দাবি জানানো হয়। তাতে বলা হয়, যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে মানচিত্রের মধ্যে অ-মুসলমান অঞ্চল রূপে দেখানো হলেও, তা কিন্তু সংযুক্ত মুসলমান এলাকার একটি পকেট মাত্র। তাছাড়া এই অ-মুসলমান অঞ্চলটির সঙ্গে বাংলার কোন অ-মুসলমান অঞ্চলের সংযুক্তি নেই। তদুপরি পূর্ববঙ্গ এলাকার মধ্যে একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফূলি নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি পূর্ববঙ্গের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করাই যুক্তিযুক্ত।

কংগ্রেসের দ্বারা এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতভুক্তির বিষয়টি চরম অবহেলায় পড়ে থাকার পর, ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট তারিখে বেঙ্গল ও পাঞ্জাব বাউন্ডারী কমিশনের রিপোর্ট দুটি সংক্ষিপ্ত রূপ যখন কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের শীর্ষ নেতাদের দেখানো হয়, তখন নাকি সর্দার বল্লভবাই প্যাটেল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দেখে দারুণভাবে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ জানিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লেখেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় পরের দিনই পাকিস্তানের স্বাধীনতা উদযাপনের সময়। এই অসময়ে ক্ষোভ জানিয়ে কী বা হবে?

ঐ ১৩ আগস্টের দিনে বাউন্ডারী কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিপ বেঙ্গল ও পাঞ্জাব বাউন্ডারী কমিশনের রিপোর্ট দুটি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নিকট স্বয়ং উপস্থিত হয়ে সহস্তে প্রদান করেন। মাউন্টব্যাটেন তা গ্রহণ করে সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ জানান এবং খামে ভরা রিপোর্ট দুটি সবুজ রঙের একটি চামড়ার বাক্সে ঢুকিয়ে রাখেন। আগস্টের ১৪-১৫ তারিখে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা উৎসব দুটি নিজের উপস্থিতিতে সুসম্পন্ন করে ১৬ আগস্টের অপরাহ্নে ঐ দুটি বাউন্ডারি রিপোর্টের কপি কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের অফিসে পাঠিয়ে দেন। পরের দিন ১৭ আগস্ট র‌্যাডক্লিপের দ্বারা প্রস্তুতকৃত বহু আকাক্সিক্ষত বাউন্ডারি কমিশনের রিপোর্ট দুটি পত্রপত্রিকা, রেডিও ইত্যাদি গণমাধ্যমের মারফত ভারত ও পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ জানতে পারলেন। কিন্তু এদিকে গত তিন-চারদিন যাবৎ ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ, জেলায়, মহল্লায় ও গ্রামে গ্রামান্তরে দারুণ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও অপহরণ ইত্যাদি নারকীয় ঘটনা অবিরাম ঘটে চলেছে। অপরদিকে মানবিক-বিবেকরহিত, ‘ভারতঅজ্ঞ’ ও কসাই সুলভ কর্মপদ্ধতিতে বাউন্ডারী রিপোর্ট-প্রণেতা সিরিল র‌্যাডক্লিপ ১৪ আগস্টের দিনেই ইংল্যান্ড চলে যান।

এখন প্রশ্ন হলো, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের শীর্ষনেতারা সত্যিই কি সীমান্ত নির্ধারণের ব্যাপারে ১৩ আগস্টের পূর্বে কিছুই জানতেন না? মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট ফিরোজপুর, গুরুদাসপুর ও মালদহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতে তা কি মুসলিম লীগ জানতো না? আর অমুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের দিকে রাখা হয়েছিল তা কংগ্রেস জানেই না? সব দায়িত্ব লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং র‍্যাডক্লিপের উপর চাপিয়ে উভয় দল নিশ্চিত ছিলেন? তা কী বিশ^াসযোগ্য? এক্ষেত্রে হিন্দু সংখ্যাঘরিষ্ট জেলা শ্রীহট্টের কথা উল্লেখ না-ই করলাম। তা গণভোটের নামে ভোট জালিয়াতি করে পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়, সময় থাকতে কংগ্রেস কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করলো না কেন? ভারতভূমির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন সংযুক্তি নেই এই মিথ্যা যুক্তি দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তান লুফে নিল? এই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা তো কখনো চট্টগ্রাম জেলার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এটা ছিল শাসন-বহির্ভূত এলাকা অর্থাৎ এক্সক্লুডেড এরিয়া। সে কারণে বঙ্গীয় পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন প্রতিনিধি ছিল না।

তাই দুর্মুখেরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইচ্ছাকৃতভাবে বলি দেওয়া হয়েছে। একথাটি আপাতত সত্য বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের দিক থেকে দেশ বিভাগের সময় উত্তরপূর্ব ভারতের সীমান্ত ও সামরিক সুরক্ষা এবং সামদ্রিক বাণিজ্যের বিষয়টি মোটেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। যদি ভাবা হতো, তাহলে আজকের দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বারা সেই সুবিধাটি সহজেই অর্জন করা যেতো। কারণ তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে টেকনাফ ও কক্সবাজার স্থান দুটি অবস্থিত ছিল, সেখানে সহজেই ভারতের সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যেতো। তাতে বর্তমান ভারত সরকার দ্বারা খরচ-বহুল বার্মার পরিত্যক্ত মান্দালয় বন্দরটি এখন লীজ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় চালাতে হতো না। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতকে বাংলাদেশ সরকারের নিকট হাত পাততে হতো না।

এটা সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই দেশভাগের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা নেতারা নিশ্চিত ছিলেন এই ভেবে যে, দিল্লির কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের তদারকিতে এই অঞ্চলটি অবশ্যই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে। তাছাড়া দেশভাগের ঘোষিত বিধি অনুযায়ী অমুসলমান প্রধান অঞ্চল রূপে এটি ভারতের ভাগে পড়ারই কথা। তাই ১৫ আগস্টের দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসদর রাঙ্গামাটিতে চাকমারা ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা সগর্বে উড়িয়েছিলেন স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসক তথা ডেপুটি কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে। কিন্তু ১৭ আগস্ট জানা গেল সেই চরম দুর্ভাগ্যের কথা, এই অঞ্চলটি নাকি পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে। তখন থেকেই শুরু হলো চাকমা নেতাদের দৌড়ঝাঁপ- পাকিস্তানের বালুচ রেজিমেন্টের দ্বারা ২১ আগস্ট ভারতের জাতীয় পতাকাটি টেনে হিঁচড়ে নামানো- পাকিস্তান সরকার কর্তৃক চাকমা নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি- চাকমা নেতাদের দিল্লি গমন- সর্দার প্যাটেলের দ্বারা প্রতিরোধ সৃষ্টির ব্যাপারে আশ্বাস প্রদান- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা শুনে নেহেরুজীর হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনাবলী, যা অন্যত্র বহুবার আলোচিত হয়েছে। এখানে সবিস্তারে উল্লেখের প্রয়োজন নেই।

এখানে যা উল্লেখ্য তা হলো দেশ বিভাগে ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অভিমত বা প্রতিক্রিয়া। যেমন পাঞ্জাব বাউন্ডারী কমিশনের একজন মুসলমান সদস্য জাস্টিস মুহম্মদ মুনীর বলেছেন “আমি নিশ্চিতই ভেবেছিলাম যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত করা হবে”। ভারতের অন্যতম আদিবাসী নেতা তথা ভারতের গণপরিষদের সদস্য জয়পাল সিং বলেছিলেন “পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবশ্যই ভারতে ফিরিয়ে আনতে হবে”। খোদ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কলকাতার একজন সভায় বলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে। কিন্তু সে আলোচনা কখনো হয়নি। আর এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা আদিবাসীরা বিগত ৭০ বছর যাবৎ “প্রো-ইন্ডিয়ান” অপবাদ বহন করে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দুঃখময় জীবন যাপন করছে। তার শেষ সীমা কেউ জানে না।

তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন অবরুদ্ধ আদিবাসীদের পক্ষে কথা বলার জন্য বহির্বিশে^ ছড়িয়ে থাকা চাকমা ও অন্যান্য সহমর্মী আদিবাসীদের পক্ষে অহিংসনীতি মেনে কালোদিবস পালন ব্যতীত বিকল্প কিছু নেই। আমরা বিশ^াস করি, এই কর্মসূচির মাধ্যমে যদি বিশ্ববিবেকের দ্বারা সহানুভূতিমূলক আলোচনার ক্ষেত্র প্রসারিত হয় এবং বিশে^র তাবৎ মানবাধিকার কর্মীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তবেই অবরুদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।

নিরঞ্জন চাকমা: হিল ভয়েস (নিউজ পোর্টাল)-এর সম্পাদক এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।