সেনা-সমর্থিত গোষ্ঠী কর্তৃক রুমায় কার্বারীসহ তিনজনকে অপহরণ, জনমনে আতঙ্ক

0
1135

হিল ভয়েস, ৮ মে ২০২০, বান্দরবানসেনা-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় এক গ্রামের কার্বারী (গ্রাম প্রধান) সহ তিনজন গ্রামবাসীকে অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে । অপহরণকারীরা মুঠোফোনে অপহৃত আত্মীয়দের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে।

অপহৃত খোঁজ করতে গেলে অপহরণকারীরা গ্রামবাসীদের উপর গুলি বর্ষণ করে বলেও জানা যায়। এছাড়া রোয়াংছড়ি থেকে একজনসহ রুমায় আরো তিনজন ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। অপহরণ ও হামলার ঘটনায় ওই এলাকায় লোকজনের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

স্থানীয়দের তথ্য মতে, এএলপি থেকে দলচ্যুত তথাকথিত মগ পার্টি নামধারী সেনা-সমর্থিত ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ মদদপুষ্ঠ সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গ্রামের কার্বারীসহ তিন গ্রামবাসী অপহরণ ও অপর তিনজন নিখোঁজের ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গ্রামবাসী জানান যে, প্রুসানু কার্বারী ছাড়া অপহৃত সকলেই একসময় এএলপি সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি তারা এএলপি ত্যাগ করে তথাকথিত মগ লিবারেশন পার্টি নাম দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটিয়ে চলেছে। তাদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে গ্রামের কার্বারীসহ উল্লেখিত গ্রামবাসীদের অপহরণ বা নিখোঁজের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, কথিত মগ পার্টির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে গত ৩ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার রুমা উপজেলার পাইন্দু মৌজার হেডম্যান মংচউ মারমার ছেলে ও দলচ্যুত এএলপি সদস্য লুসাইমং মারমা বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন। ৫ এপ্রিল রোববার বিকেলে স্থানীয়রা পাহাড়ে জুমে আগুন দিতে গেলে পাইন্দু ইউনিয়নের বাগানপাড়া এলাকার দূরবর্তী পাহাড়ে রঝর্ণায় তার রক্তাক্ত গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে।

পাইন্দু হেডম্যানের ছেলেকে হত্যার পর থেকে কথিত মগ পার্টির মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল জোরালো হয়ে উঠে বলে স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।

স্থানীয় সূত্র আরো জানায় যে, গত ৩০ এপ্রিল ২০২০ বৃহস্পতিবার রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের তংমক পাড়ার মৃত লুবুসে মারমার ছেলে ক্যচানু মারমা ওরফে থুইনুমং (৩২) ও চিংসাজাই মারমার ছেলে অংথুইচিং মারমা (৩৫) রুমা বাজার থেকে ফেরার পথে গালেংগ্যা এলাকার কক্ষ্যংঝিরি এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়ে যান।

নিখোঁজ ব্যক্তিরা ফিরে না আসায় গত ৫ মে ২০২০ মঙ্গলবার পাঁচ গ্রামের লোকজন ঐ নিখোঁজ দুই ব্যক্তিকে খোঁজ করতে গেলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের জুতা উদ্ধার করে। কিন্তু অপহৃতদের কোন খোঁজ মেলেনি। গ্রামবাসীদের ধারণা, অপহরণের পর কথিত মগ পার্টির সন্ত্রাসীরা তাদেরকে হত্যা করে ফেলতে পারে।

অপরদিকে এ মাসের প্রথম থেকে রোয়াংছড়ির বাশৈমং মারমা, রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের আলেচু পাড়ার হ্লা শৈ অং মারমা এবং অপর একজন ত্রিপুরা ছেলে নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

অনেকে মনে করেন, উক্ত তিনজন ব্যক্তিকে কথিত মগ পার্টির সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছে। আবার অনেক গ্রামবাসী মনে করেন, তাদেরকে সেনা ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সেনাবাহিনী তাদেরকে দিয়ে এলাকায় অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করার হীনউদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী তাদেরকে ক্যাম্পে আটকে রাখতে পারে।

সর্বশেষ গত ৬ মে ২০২০ বুধবার বিকেলে রিজুক কার্বারী প্রুসানু মারমাকে (৩৮ ) অপহরণ করা হয়। সেদিন তিনি জুমে গেলে সেখান থেকে তাকে অপহরণ করা হয় বলে জানা যায়।

স্থানীয়রা জানান যে, সেদিন (৬ মে) দুপুরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ করতে গেলে রুমা উপজেলার সাংঙ্গু নদীর পান্তলা এলাকার নাইতং পাড়ার কাছে সন্ত্রাসীরা গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানান যে, সেসময় কয়েকটি নৌকায় ৪০ জন পাড়াবাসী নিখোঁজদের খোঁজে রিজুক ঝরনার উপরের দিকে যাচ্ছিলেন। বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে পান্তলা এলাকায় পৌঁছলে নাইতং পাহাড় থেকে তাদের লক্ষ্য করে ১০-১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পরে তারা আতঙ্কিত হয়ে ফিরে আসেন।

তারপর দিন ৭ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার সকালে অপহৃত কার্বারীর স্ত্রীকে ফোন করে অপহরণকারীরা মারমা ভাষায় জানায় যে, “তোমার স্বামীকে বাঁচাতে চাইলে মুক্তিপণ হিসেবে ছয় লাখ টাকা দিতে হবে।“ তার স্বামী তংমক পাড়া এলাকায় আছে বলে জানায় অপহরণকারীরা।

অপরদিকে একই দিন (৭ মে) বিকালে অপহরণকারীরা থুইনুমং মারমার বড়ভাই থুইহ্লাচিং মারমাকে ফোন করে জানায় যে, “তোর ভাইকে বাঁচাতে চাইলে দুই লাখ টাকা দিতে হবে।“ তবে কোথায় গিয়ে কখন দিতে হবে সেটা জানায়নি অপহরণকারীরা।

একের পর এক অপহরণ, হামলা ও মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় ওই এলাকায় লোকজনের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।