সংবিধানের চার মূলনীতি বাস্তবায়িত হলে আদিবাসীদের নিয়ে কথা বলতে হতোনা: সংসদীয় ককাসে বাদশা

0
957

হিলভয়েস, ৮ আগস্ট ২০২০, ঢাকা:  সংবিধানের চার মূলনীতি বাস্তবায়িত হলে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে হতো না বলে জানান আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আলোচনায় বললেন ককাসের সভাপতি ও বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। তিনি আরো বলেন, করোনা সংকটে মানুষের মধ্যে কিছু উপলব্ধি এসেছে সেগুলোর রাজনৈতিক ভাষা দেয়া জরুরী এবং সংকটের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২০ উপলক্ষ্যে আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাস আয়োজিত ভার্চুয়াল আলোচনায় বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির সাধারন সম্পাদক এ মত দেন। গতকাল ৭ আগষ্ট ২০২০ শুক্রবার রাত ৮.০০ টায় ‘জুম’ -এর মাধ্যমে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

সংসদীয় ককাসের সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা’র সভাপতিত্বে এবং উক্ত ককাসের টেকনোক্র্যাট মেম্বার জান্নাতুল ফেরদৌসীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই ভার্সচুয়াল আলোচনায় করোনার সংকট নিয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক এবং সংসদীয় ককাসের সমন্বয়ক ড. মেসবাহ কামাল। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আদিবাসীরা পৃথিবী ও প্রকৃতির প্রধান সংরক্ষক। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে মুনাফা লোভীরা এবং প্রকৃতি-খেকো মানুষরা এই প্রকৃতিকে অতি ব্যবহার করে ফেলেছে। যার জন্য প্রকৃতি এখন তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, এই পৃথিবীতে কেবল মানুষ নয়, গাছপালা, বন ও অন্যান্য জীবজন্তুদের বসবাসের অধিকার আছে। কিন্তু আমরা সেটাকে অস্বীকার করেছি। যার জন্যই এই করোনার আক্রমণ বলে মন্তব্য করেন ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

এই মহামারীর সময়ে অনেক আদিবাসীর আয়ের পথ রুদ্ধ হওয়ায় তাঁরা নানা ভাবে জর্জরিত দাবি করে তিনি আরো বলেন, আমি এক ধরনের দুর্ভিক্ষের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আর এই দুর্ভিক্ষের শিকারে পরিণত হবে আদিবাসী, প্রান্তিক মানুষ ও গরিব বাঙালিরা। এইসব প্রান্তিক মানুষদের জন্য সরকারি বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন এই ইতিহাস শিক্ষক।

করোনা সময়ে আদিবাসী জীবনের উপরে অভিঘাত বিষয়ে আলোকপাত করে উক্ত ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, এই আদিবাসী দিবসের যাত্রা শুরু হয়েছিল জাতিসংঘ, আদিবাসী জনগণ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একসাথে কাজ করবে এই লক্ষ্য নিয়ে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলন অনেক এগিয়েই গিয়েছিল কিন্তু স্বীকৃতির প্রশ্নে পঞ্চদশসংশোধনীতে তা আবার পিছিয়ে যায় বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন এই আদিবাসী নেতা।

এই করোনার সময়েও আদিবাসীরা মানবাধিকার লংঘনের মত নির্মম ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে দাবি করে তিনি আরো বলেন, আমরা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এমন মহামারীর সময়েও ভূমি থেকে উচ্ছেদ সহ নানা ধরনের মানবাধিকার লংঘনের মত ঘটনার শিকারের খবর পাচ্ছি। অন্যদিকে পাহাড়ের আদিবাসী অধিকার কর্মীদের নানা ভাবে ‘অপরাধীকরণ’ করে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও জানান এই আদিবাসী নেতা।

সঞ্জীব দ্রং আরো বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহত্তের বিচার করতে হবে এই দেশে একজন সান্তাল, একজন মুন্ডা কিংবা একজন, মারমা ও অন্যান্য আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষ কেমন আছেন তার উপর। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা যে অধিকাংশই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতেপারছেন না তার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

এদিকে উক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে আদিবাসী মানুষের পরিচয়ের স্বীকৃতি দাবি করেন সংসদীয় ককাসের প্রতিষ্ঠাতা সাংসদ রাশেদ খান মেনন এমপি। তিনি বলেন, আমরা প্রথমেই স্বীকারই করিনি যে এদেশে আদিবাসী আছে। পরে স্বীকার করে নিলেও তা দিয়ে আমরা কাঙ্কিত জায়গায় পৌঁছতে পারিনি। করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনায় আদিবাসীদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিতেরও আহ্বান জানান এই সাবেক মন্ত্রী। এ প্রণোদনা আদিবাসীদের কাছে কতটুকু পৌঁছেছে তার খোঁজ নেওয়ার আহ্বান জনান সংশ্লিষ্টদের।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে আদিবাসীরা ভূমি থেকে উচ্ছেদসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন দাবি করে তিনি বলেন, একদিকে করোনার অভিঘাত অন্যদিকে নানা সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছেন আদিবাসীরা এবং এগুলো সুনির্দিষ্ট করে সরকারের নজরে নিয়ে আসার জন্য আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসকে আহ্বান জানান ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি।

উক্ত আলোচনার অন্যতম আলোচক জাসদ সভাপতি ও সাংসদ হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, বাংলাদেশে নানা ভাবে বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে। এই বৈষ্যমের বিরুদ্ধে লড়াইটা কেবল আদিবাসীদের একার নয়। এ লড়াই সার্বজনীন এবং করোনাকালে এ বৈষম্য ব্যাপকভাবে ফুটে উঠেছে বলেও দাবি করেন এই সাংসদ।

তিনি আদিবাসীদের প্রণোদনা প্রদান প্রসঙ্গে বলেন, কেবল এক মুঠো চাল দিয়ে বৈষম্য কমবে না। এই বৈষম্য কমানোর জন্য সেগুলোকে আইনগত বিধানের মধ্যে নিয়ে এসে তাদেরকে সুরক্ষা দিতে হবে বলেও মত দেন সাবেক এ মন্ত্রী। সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য সংবিধানপুনর্বিবচনার সময় এসেছে যা করোনাকালে আরো প্রাসঙ্গিক হয়েছে বলেও দাবী করেন তিনি। এছাড়া সমতলের জন্য ভূমি কমিশন এবং পার্বত্য চুক্তির পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সহ আদিবাসী অধিকার রক্ষায় জাতীয় কমিশন গঠনের দাবীও করেন তিনি। অন্যদিকে ইন্টারনেট সুবিধাকে মৌলিক অধিকারের মধ্যে নিয়ে আসার দাবি করেন সাবেক এ তথ্যমন্ত্রী।

এদিকে একই আলোচনায় অংশ নিয়েহিন্দু বৌদ্ধ খিষ্টান ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন, করোনাকে সুযোগ নিয়ে ভূমিদস্যুরা সংখ্যালঘুদের ভূমি দখলে মেতে উঠেছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসন এখন করোনা মোকাবেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় দুষ্কৃতিকারীরা এ সুযোগ নিচ্ছে বলেও দাবি তাঁর।

এছাড়া উক্ত আলোচনায় সাংসদ ফজলুল হক বলেন, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের আক্রমণের সাথে ভূমির সম্পর্ক জড়িত। সরকারি প্রশাসন করোনা নিয়ে ব্যস্ত তাই দুষ্টচক্র এর সুযোগ নিচ্ছে যার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আদিবাসী ও সংখ্যালঘু অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে দু’টি বিল সংসদে উত্থাপনের দ্বারপ্রান্তে বলেও জানান এই সাংসদ।

এই কারোনাকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসঙ্গ এনে তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রধানমন্ত্রী কিছুটা হলেও মেরামত করেছেন। কিন্তু আরো অনেক দূর এগোতেহবে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা গুলোর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের আহ্বান জানান তিনি।

একই আলোচনায় অংশ নিয়ে সংরক্ষিত সাংসদ এরোমা দত্ত বলেন, আমরা আদিবাসী ও সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে অনেক কথা বলি। কিন্তু বাস্তবায়নের জায়গায় কোথায় যায় বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি। আদিবাসীরা এই সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বলেও মত দেন এই মানবাধিকার কর্মী।

রাষ্ট্রের মধ্যে আমলাতন্ত্রের আধিপত্য দেখছি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্র যদি আমলাতান্ত্রিক মন নিয়ে পড়ে থাকে তবে রাজনৈতিক ‘কমিটমেন্ট’র বাস্তবতায়ন সহ আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার বাস্তবায়িত কীভাবেহবে। আমাদের ৩৫০ জন সাংসদকে এ বিষয়ে বলতে হবে এবং সরকারের নজরে নিয়ে আসতে হবে যাতে রাষ্ট্র এটিকে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়।

উক্ত ভার্চুয়াল আলোচনায় আরো অংশ নেন, হিন্দু বৌদ্ধ খিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান এসোশিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লবচাকমা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এটিএম আতিকুর রহমান, বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশনের সুনন্দ প্রিয় ভিক্ষু, আদিবাসী নারী নেত্রী ফ্লোরা বাবলি তালাং, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয় ফাল্গুণী ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিক ও অন্যান্য আদিবাসী ও সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দ।

আদিবাসী ও সংসদীয় ককাসের সভাপতি ও সভা প্রধান সাংসদ ফজলে হাসান বাদশা সমাপনি বক্তব্যে বলেন, সংবিধানের চার মূলনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এই চার মূলনীতির বাস্তবায়ন মানে আদিবাসী ও সংখ্যালঘু অধিকার প্রতিষ্ঠা। আগামীদিনে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে একসাথে  লড়তে হবে বলেও উল্লেখ করেন এই প্রবীণ সাংসদ।