শোষণ-বঞ্চনা ও বিষাদের আরেকটি বছর ২০২০-এর বিদায়

0
1085

হিল ভয়েস, ১ জানুয়ারি ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির কারণে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন-রাত, মাস ঘুরে বছর ফুরিয়ে নতুন বছর আসে। আধুনিক গ্রেগরির ক্যালেন্ডারের সুবাদে নিউ ইয়ার শুরু হয়। বিশ্ব ২০২১ সালে প্রবেশ করেছে। সে সাথে দেশ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে পা দিয়েছে। কিন্তু ৫০ বছর পথ পরিক্রমায় আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি এবং নিশ্চিত করা হয়নি।

বিগত এক বছরে বাংলাদেশের সরকার রির্জাভ ব্যাংকে রির্জাভের পরিমাণ, চীন থেকে ঋণ নিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ উন্নয়ন কর্মকান্ড চলমান দেখালেও জনগণের প্রকৃত অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। মৌলবাদী শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে স্বাধীনতার চেতনার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। ধীর হয়ে পড়ছে দেশের অর্থনীতি, কমছে প্রবৃদ্ধি। ফলে সামাজিক সূচকগুলোও হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে।

সালতামামির ২০২০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম

নতুন বছরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে সবার মত ২০২০ সালের পুরো এক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, মানবাধিকার সূচক, শিক্ষা অধিকার, চুক্তি বাস্তবায়ন, ভূমি অধিকার নিয়ে সমীকরণ মেলাতে হচ্ছে। তাতেই যা বলতে হচ্ছে, সব সূচকে জুম্মদের অবস্থা বিগত বছরের চেয়ে খুবই শোচনীয় এবং অবনতি ঘটেছে। স্বাধীনতার পর থেকে জারি থাকা ইসলামিকীকরণ, সামরিকীকরণের মাধ্যমে দমন-পীড়ন, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সেটেলারদের আস্ফালন ও উৎপীড়ন, জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী ও চুক্তিবিরোধী প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শক্তি অব্যাহতভাবে বেড়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে সশস্ত্র প্রতিরোধের পর ১৯৯৭ সালে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হন। কিন্তু চুক্তির ২৩ বছর পরও মৌলিক বিষয়সমূহসহ চুক্তির দুই তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হয় নি। অপরিদকে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ সম্বলিত স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। জেলার পরিষদের আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ(স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন (রিজার্ভ ফরেষ্ট ব্যতীত), পরিবেশ, মাধ্যমিক শিক্ষা, জুম চাষ, পর্যটন (স্থানীয়) ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন বিষয়সমূহ হস্তান্তারিত করা হয় নি। সরকার একদিকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিশ্রুতিতে সরব হলেও বাস্তবে তার কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। বরং সরকারের কাজে-কর্মে চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম লক্ষণীয়। যেমন- আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বছরের ১৪, ১৫ ও ১৬ অক্টোবর বান্দরবানের থানচি সফর করে আঞ্চলিক পরিষদের মতামত না নিয়ে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন, ২৪ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে সফরকালে এ সভায় ‘শান্তিচুক্তি মোতাবেক যে স্থানগুলো থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে সেই পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে চাঁদাবাজি বন্ধ রাখতে পুলিশ, আনসার, বিজিবি, এমনকি র‌্যাব মোতায়েন করা হবে”(সুত্র: প্রথমআলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০) মর্মে চুক্তি বিরোধী বক্তব্য দিয়ে যান। সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়ে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলাপ আলেচনা না করে পার্বত্য চট্টগামকে অশান্ত করার জন্য চুক্তি বিরোধী বক্তব্য প্রমাণ করে চলমান বছর কী হতে যাচ্ছে? চুক্তি মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্ববধান ও সমন্বয় সাধন করার বিধান রয়েছে। যা চুক্তি লঙ্ঘনের সামিল।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ আওয়ামীলীগ সরকার টানা ১২ বছরের সরকারি ক্ষমতায় রয়েছে ২০১৬ সালে ভূমি কমিশন আইন সংশোধন ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের তৎপরতা চোখে পড়ে না। ভূমি কমিশন কার্যকরের ২০১৭ সালের জন্য প্রস্তাবিত বিধিমালাও হিমাগারে রাখা হয়েছে। এ বছর বান্দরবানে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ভূমি কমিশনের নিয়মিত বৈঠকটিও কমিশনের চেয়ারম্যানের একরোখা মনোভাবের কারণে কোরাম পুর্ণ করতে পারে নি। পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাড়ছে সেনা ও রাষ্ট্রযন্ত্র এর ছত্রছায়ায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা, চাঁদাবাজি, জুম্মদের উপর দমন-পীড়ন। বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন চুক্তির পূর্বেন অবস্থা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে।

জুম্মদের ভূমি বেদখল

পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছরেও ভূমি কমিশন আইন কার্যকর না হওয়া এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় বহিরাগত মুসলিম সেটেলার কর্তৃক জুম্মদের ভূমি বেদখলের অপচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর তিন পার্বত্য জেলায় সরকারি-বেসরকারি বহিরাগত বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তি কর্তৃক ভূমি বেদখলসহ নির্বিচারে পাহাড় কর্তন, জঙ্গল নিধন, প্রাকৃতিক বালু ও পাথর উত্তোলন ইত্যাদি পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড জোরদার হয়েছে। ১৯৯৮ সালে জুম্মদের দুই লক্ষাধিক একর ভোগদলীয় জুমভূমি ও মৌজাভূমিকে একতরফাভাবে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, বহিরাগতদের নিকট হাজার হাজার একর ভূমি ইজারা প্রদান, সেনা ছাউনি স্থাপন ও সম্প্রসারণের নামে হাজার হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ, সেনাবাহিনী পর্যটন শিল্পের জন্য শত শত একর পাহাড় বেদখল, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ ও বহিরাগতদের অব্যাহত বসতিপ্রদান, জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, জুম্ম নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতা ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে তাদের চিরায়ত ভূমি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ,জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি বিধ্বংসী তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম (ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং) গ্রহণের মাধ্যমে ভূমি বেদল অব্যাহত রয়েছে।
এ বছর প্রাণঘাতি কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে যখন সবাই ব্যস্ত ঠিক সে সুযোগটা লুফে নিয়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও বহিরাগত ভূমিদস্যু কর্তৃক ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ অবাধে চলেছে। ভূমি জবরদখল কিংবা বেদখলের চেষ্টায় প্রায় ১,০০০ জুম্ম পরিবার ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখী, তিন পার্বত্য জেলায় জুম্মদের প্রায় ৩, ২০০ একর জায়গা জবরদখল, ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে জুম্মদের বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের ও ২ জনকে গ্রেফতার এবং বান্দরবানে প্রায় ৫,০০০ একর রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি ও লংগদুতে নতুন করে ৫০০ পরিবার বাঙালি সেটেলার বসতিস্থাপনের ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। এলক্ষ্যে তালিকাভুক্ত প্রতি সেটেলার পরিবারকে ৩.০ একর পাহাড় ভূমি ও নগদ ১০,০০০ টাকা প্রদান করা হবে বলে জোন প্রতিনিধির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়ার খবর শুনা গেছে।

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ ম্রোদের ১ হাজার ৬ শ একর, মেরিডিয়ান কোম্পানি ৩ হাজার একর ও লামা কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের নামে ৩ হাজার ৫ শ একর জমি দখল করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম বদরুদ্দৌজা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অমান্য করে পাহাড়ি টিলা-ভূমি ক্রয়ের অভিযোগ ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কর্তৃক বান্দরবানের আলিকদমে ম্রোদের ১০ একর পরিমাণ জুম্মর ভূমি বেদখল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সেনা ও বিজিবি কর্তৃক জুম্মদের ভূমি বেদখল

নিরাপত্তার অজুহাত দাড় করিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি লঙ্ঘন করে জুম্মদের জায়গা দখল করে সেনাবাহিনী গত বছর সর্বমোট ৬ টি নতুন করে সেনাক্যাম্প স্থাপন করেছে। বান্দরবানের চিম্বুকে প্রায় ১০-১৫ টি গ্রাম উচ্ছেদ করে সিকদার গ্রুপ ও সেনা কল্যাণ সংস্থা কর্তৃক পাঁচ তারা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের জন্য ম্রো আদিবাসীদের ৮০০-১,০০০ একর ভূমি বেদখল করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এতে প্রায় ১০,০০০ হাজার ম্রো আদিবাসী উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে।

বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নে ১১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধীন পাইনছড়ি ভিওপি ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার আলমগীর কর্তৃক পাইনছড়ি বিজিবি ক্যাম্প স্থাপনের নামে বেআইনীভাবে বৌখান মারমার ৫ সন্তানের নামে বন্দোবস্ত করা ৮.০ একর ভূমি দখলের চেষ্টা করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলাধীন লংগদু উপজেলার বগাচতর ইউনিয়নে বিদ্যমান “রাঙ্গীপাড়া হেলিপ্যাড সিআইও বিজিবি ক্যাম্প”টি সাব-জোন বিজিবি ক্যাম্প হিসেবে পরিণত করার জন্য ৩৭ বিজিবির রাজনগর জোন কর্তৃক জুম্মদের প্রায় ৩৫ একর জায়গা জবরদখলের করে নেয়ার চেষ্টা চলছে। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের কিস্ত পাড়া নামক স্থানে লগনা ত্রিপুরার ছেলে লরেন্স ত্রিপুরার জায়গা দখল করে একটি নতুন ক্যাম্প তৈরী করা হয়েছে।

এছাড়াও ক্যাম্প স্থাপনের নামে বিজিবি কর্তৃক পানছড়ির ধুদুকছগড়ায় সীমান্তবর্তী দুর্গামনি পাড়ার এক জুম্মর জায়গা দখলের চেষ্টা, সাজেকে রূপায়ন চাকমার পুকুর ৫.০০ একর , বিলাইছড়ির সদরে সেনা ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে ৯ জুম্ম পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এলাকাবাসীর দাবিকে উপেক্ষা করে জোরপূবক কাউখালীর দোবাকোবা ও নভাঙা এলাকায় জুম্মদের বাগান-বাগিচার ৫.০০ একর জায়গা দখল করে সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা

পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাশাসন পাকাপোক্ত করার জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক শান্তিপ্রিয় পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি যুদ্ধাঞ্চল করে রাখা হয়েছে। প্রতি পাঁচ কিলোমিটার পর পর চৌকি বসানো হয়েছে, তবুও থেমে নেই জুম্মদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আন্দোলনরত জুম্ম রাজনৈতিক সংগঠন ও সাধারণ জুম্মদের উপর দমন পীড়ন চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্যানুসারে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিগত ছয় মাসে সেনাবাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দা বাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক ৭২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এই ৭২টি ঘটনায় ৬ জনকে বিচার বহির্ভূত হত্যা, ২৭ জনকে অবৈধ গ্রেফতার, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ২২ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও হয়রানি, ৫৩টি বাড়ি তল্লাশী, ৬টি নতুন ক্যাম্প স্থাপন, সেনাবাহিনীর উন্নয়নে ১৬৭ পরিবার ক্ষতির মুখে ও ২টি জায়গায় ফাঁকা গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। গড়পড়তা হিসাব করলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বিগত এক বছরে ১০০ অধিক হবে সেটা জোর গলায় বলা যায়।

সেটেলার কর্তৃক ৩০টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ৩০টি ঘটনায় জুম্মদের উপর ২টি সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখল কিংবা বেদখলের চেষ্টায় ৮১৮ পরিবার ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখী, জুম্মদের ৩,১৫০ একর জায়গা জবরদখল, ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে জুম্মদের বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের ও ২ জনকে গ্রেফতার এবং প্রায় ৫,০০০ একর রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। (তথ্যসূত্র- পিসিজেএসএস জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত মানবাধিকার রিপোর্ট)

গোয়েবলসীয় অপপ্রচার ও তথ্য সন্ত্রাস জোরদার

গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচার আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। হিটলারের সময় নাৎসিদের একজন প্রচারমন্ত্রী ছিলেন। তার নাম ড. পল জোসেফ গোয়াবলস। বিদ্বেষপূর্ণ বক্তৃতা এবং ইহুদি বিরোধী তৎরতার জন্য তিনি কুখ্যাত ছিলেন। তিনি মিথ্যাকে এমনভাবে প্রচার করতেন তা আপাতত দৃষ্টিতে একদম সত্য ঘটনা বলে মনে হত। তার এই গোয়েবলস মিথ্যাচার এখন রীতিমতো প্রবাদ হয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, জুম্ম জনগোষ্ঠী, জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলন ও আন্দোলনরত সংগঠনগুলো সম্পর্কে জনমানুষের কাছে বিতর্কিত করার জন্য (সেনা মদদপুষ্ট ব্যতীত) রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন কতর্ৃৃপক্ষ ও সংস্থা এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী একতরফা সাজানো ও কল্পিত অপপ্রচার জোরদার করেছে। অপরদিকে জুম্মদের উপর সংঘটিত নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংবাদ পত্রে প্রকাশে বাধা নিষেধ, ভাড়াটে সাংবাদিক এবং ভূঁইফোড় স্থানীয় প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের অজুহাত দাঁড় করিয়ে গোয়াবলেসীয় কায়দায় তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে “মিয়ানমারে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ভারত সীমান্তে, খুন হয় বাংলাদেশে” শিরোনামে ডিবিসি নিউজে; শান্তি চুক্তির ২৩ বছরেও পাহাড়ি জনপদে অস্থিরতা কমেনি শিরোনামে চ্যানেল আই; পাহাড়ে কমেনি অস্থিরতা, এখনও সক্রিয় সশস্ত্র অনেক সংগঠন একাত্তর টিভি; শান্তি চুক্তির ২৩বছর পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় জেএসএসের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির শিরোনামে এটিএন নিউজে একযোগে নিজেদের ভাড়া করা মুখ ঢাকা সন্ত্রাসীকে একই জায়গায় দাড় করিয়ে খবর করেছিল।

শুধু তাই নয়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলাধীন ন্যান্যাচরের সাবেক্ষং ইউনিয়নের নয়ন চাকমা নামে এক জুম্মকে সেনা সদস্য কর্তৃক গুলি করে হত্যা ঘটনায় ভূঁইফোড় স্থানীয় প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় সেনাবাহিনীর সাথে গোলাগুলিতে এক ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী। তারপর ১৩ ডিসেম্বর রাত ৭:৩০ টায় নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মিল্টন চাকমা নামে এক নিরীহ জুম্মকে গুলি করে মেরে ফেলার পর প্রকাশ করা হয় সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে জেএসএসের সন্ত্রাসী নিহত। পরের দিন তার মেয়ে নিজে স্বীকার করেন যে, তার বাবাকে রাত ৭:৩০ টায় সেনাবাহিনী ও তার মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। বাংলাদেশের ইংরেজি পত্রিকা দৈনিক ‘ডেইলী স্টার’ আসল ঘটনা নিয়ে নিউজ করতে চাইলে নানা বাধায় তা প্রকাশ করা যায় নি। সেনাবাহিনীর সাথে গোলাগুলি, চাঁদাবাজি, আটকের ঘটনা- সবই সেনাবাহিনীর সৃষ্টি এবং ভাড়াটে স্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন পত্রিকার বানানো কাহিনী ও ঘটনা বৈ কিছু নয়।

জুম্ম নারী-শিশু ধর্ষণ ও হত্যা

২০২০ সালে সেনাবাহিনী-সেটেলার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী-শিশুর উপর ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, হত্যার ঘটনা গত বছরের চেয়ে উদ্ধেগজনকহারে বেড়েছে। গত বছর জুম্ম নারীর উপর গণধর্ষণ, ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও গুলি করে হত্যাসহ প্রায় ৫০টির মত ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে আলীকদমে এক বিধবা নারীকে ৬ সেটেলার, মহালছড়িতে এক স্কুল ছাত্রীকে ৪ সেটেলার এবং সর্বশেষ খাগড়াছড়ি সদরে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে ৯ জন সেটেলার মিলে গণধর্ষণের ঘটনা বলে দেয় পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীদের উপর উৎপীড়ন যে কী মাত্রাই বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা কেবল সেটেলাররা ঘটাচ্ছে তা না, এর সাথে নিরাপত্তা বাহিনীরা জড়াচ্ছে। এ বছর পুলিশ সদস্য মো. নাজমুল হাসান কর্তৃক খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত তার অগ্রগতির ঘটনা চোখে পড়েনি। রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনী কর্তৃক গুলি করে শান্তিবালা তঞ্চঙ্গ্যা নামে এক তঞ্চঙ্গ্যা নারীকে হত্যা এবং গুলির আঘাতে তার কোলে থাকা শিশুটি আহত হয়েছে। এ ঘটনায় নিজের দায়ভার এড়াতে সেনাবাহিনী নিহত শান্তিবালা তঞ্চঙ্গ্যাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সন্ত্রাসীদের সাথে গোলাগুলির মনগড়া ঘটনা সাজানো হয়। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারী ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যার ঘটনায় সর্বোচ্চ আসামীদের গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করা গেলেও যথাযথ শাস্তির চেয়ে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়াটা একটা লিখিত ইতিহাসের পাতায় থেকেছে। খাগড়াছড়ি সদরে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক জুম্ম তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় তিন মাস তদন্ত করে পুলিশ ৯ জনকে আসামী করে আদালতে অভিযোগ দিয়েছে। ২০২০ সালের জুম্ম নারীর উপর যৌন সহিংসতার ঘটনায় এটিই একমাত্র অগ্রগতির ঘটনা।

নতুন সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান

দীর্ঘকাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে জুম্মদের সাথে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসা স্থায়ী বাঙালিরাও জুম্মদের ন্যায় চরমভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত। এ কারণে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সবসময় সোচ্চার । সে জন্যই তারা “পার্বত্য চট্টগ্রাম আদি ও স্থায়ী বাঙালি কল্যাণ পরিষদ” নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ১৪ জুন সংগঠনের ১৮ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে রাঙামাটির জোনে ডেকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক সংগঠন সম অধিকার আন্দোলনে যোগদান করতে চাপ দেয়। অনেকে জীবনের ভয়ে যোগ দিলেও বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাতেও ক্ষান্ত হতে না পেরে শাসকগোষ্ঠী নতুন উদ্যোগে ৫ ডিসেম্বর ২০১৯ মুসলিম সেটেলার, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সকল সংগঠনগুলো বিলুপ্ত করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’ নামে একক সংগঠন গঠন করে। ভূঁইফোড় এ সংগঠনটি শাসকগোষ্ঠীর মদদে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী তৎপরতা, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা, নারীর উপর সহিংসতা, বসতিস্থাপন, গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ ইত্যাদি তৎপরতায় জোরদার করে চলেছে। গঠন হওয়ার পরই পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের উদ্যোগে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ রাঙ্গামাটিতে এবং গত ৩ ফেব্রয়ারি ২০২০ বান্দরবানে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের সভা ঘেরাও করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির আত্নপ্রকাশ। এ বছরের ২৬ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলা ও ২৯ আগস্ট রাঙামাটি জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে। তিন পার্বত্য জেলায় কমিটি গঠন করার মধ্য দিয়ে জানান দিচ্ছে আগামীতে তারা আরও কী কী সাম্প্রদায়িক তথা জুম্ম বিধ্বংসী কার্যক্রম জোরদার করতে পারে। শাসকগোষ্ঠীর ইশারায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া সংগঠনটি জুম্মদের জন্য একটা বিশাল প্রতিবন্ধতকা সৃষ্টি করবে।

শিক্ষা ও অর্থনৈতিক পরিবেশ

চলমান মহামারি করোনাভাইরাস পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দুর্গম এলাকা, ইন্টারনেট পরিকাঠামো দুর্বলতা ও আর্থিক দুরবস্থার কারণে পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটের ডাটা প্যাক কিনে অনলাইনের ক্লাস করতে পারছে না। বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শতকার ৭৫ শতাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশনে প্রচারিত পাঠদান কর্মসূচীতে অংশ নিতে পারছে না। যেখানে সারাদেশ থেকে টেলিভিশন ক্লাসে অংশটিতে না পারা শিক্ষার্থী রয়েছে ৫৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য বিশেযজ্ঞরা বলছেন, করোনা ২০২১ সালের শেষের দিক নাগাদ থাকতে পারে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ক্ষমতার দন্দ্বের কারণে করোনার টিকা পেতে অনেক সময় লাগবে তা আন্দাজ করা যায়।

অন্যদিকে করোনাকালে সরকারের দেয়া প্রণোদনা সহায়তা থেকে ৭৫ শতাংশ পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরা বঞ্চিত হয়েছেন। আর তিন পার্বত্য জেলাসহ সমতল আদিবাসীদের মাত্র ২৫ শতাংশ পরিবার এই সহায়তা পেয়েছেন বলে জানিয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)।

দেশে দারিদ্র্যের বর্তমান জাতীয় গড় হার যে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এ হার আরও বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্মদের দারিদ্র্যের হার ৬৫ শতাংশ। করোনার কারণে উৎপাদিত পণ্য বেচা-বিক্রি করতে না পারায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অবস্থানে বসবাসরত জুম্মরা আর্থিক সংকটে ভুগছে।

ধর্মান্তরিত করার কার্যক্রম

জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসলামিক অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার জন্য শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই। আশির দশক থেকে জিয়াউর রহমান সরকার প্রায় তিন লক্ষ সেটেলার মুসলিম সেটেলারকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বসতিস্থাপন করে দেয়। তখন থেকে শুরু হয় সরকারের উদ্যোগে ইসলামাইজেশনের প্রক্রিয়া। এধরনের পরিকল্পনা বা কার্যক্রম গত বছর অনেক জোরদার হয়েছে। বিশেষত কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরপরই বান্দরবান পার্বত্য জেলার বান্দরবান পৌরসভা, আলিকদম, রোয়াংছড়ি, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসীদের এ ধরনের ধর্মান্তরিতকরণের ব্যাপক কার্যক্রমের খবর পাওয়া গেছে। এ কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ছাঃলাওয়া পাড়ায় (শীলবান্ধা পাড়া) ৫ মারমা পরিবারের ২৭ জনকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া গত এক বছরে প্রায় ৩ শতাধিক ত্রিপুরা-মারমা ম্রো পরিবারকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।

হাম হানা

বাংলাদেশ সরকার বছর জুড়ে টিকাদান কার্যক্রমের সফলতা ফলাও করে প্রচার করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার ছিটে ফোটাও চোখে পড়ে না। প্রান্তিকতার অজুহাতে দাঁড় করিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা সেবা দিতেও যান না। এ ফাঁকি ধরা পড়েছে এ বছর। করোনার সাথে সাথে সাজেক, পানছড়ি এবং লামায় বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫০০ জুম্ম শিশু হামে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১০ জন মারা গেছেন। ব্যাপকভাবে হামে আক্রান্তের ঘটনার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের দুর্গম এলাকার আদিবাসী জুম্মদের নাগরিক সুবিধা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ

বান্দরবান পার্বত্য জেলায় অবাধে ও অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে এসব অবৈধ রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয় প্রদানের সত্যতাও বেড়িয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন থেকে রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ ও স্থায়ী বাসিন্দার সনদ গ্রহণের অভিযোগ উঠে এলেও সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যম, টিভিতে এর সত্যতা তথ্য-প্রমাণসহ প্রকাশ পেয়েছে। এ নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুনধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ঘুনধুম ইউনিয়নে এখনো ৪০০ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গা ভোটার রয়েছে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সহিংস ঘটনার পর বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)-এর সর্বশেষ হিসাব মতে, ৩৪টি ক্যাম্পে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৫ হাজার ৮২২ জন। তাদের হিসাবের মতে, গত তিন বছরে ক্যাম্প রোহিঙ্গার জনসংখ্যা কমে গেছে দুই লাখেরও বেশি। তবে সরকারি-বেসরকারি সব মহলই প্রকাশ্য বা গোপনে স্বীকার করছে, এসব রোহিঙ্গা তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে তারা। এ রোহিঙ্গারাও আগামীতে জুম্মদের জায়গা দখল ও সাম্প্রদায়িক শক্তি হয়ে দাঁড়াবে।

সর্বোপরি বলা যায়, সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র, সেটেলার ও সাম্প্রদায়িক শক্তির একর পর এক চুক্তি বিরোধী, জুম্ম স্বার্থপরিপন্থী ও দমন পীড়ন কার্যকলাপ ২০২০ সাল জুম্মদের জীবন কেটেছে কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে। নতুন বছরের আগমন ঘটায় বিশ্বের সকল মানব জাতির মনে আনন্দ বিরাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। অতীতের সমস্ত ব্যর্থতাকে নতুন বছরে জয় করার মানসে জেগে উঠে নতুন প্রত্যাশা। তবে নতুন বছর এলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মনে নেই কোন আনন্দ। উপরন্তু আতংক ও ভয়ে বছরের পর বছরগুলো যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েই চলেছে। নতুন দিন আগমনের মাত্রই পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর দমন-পীড়নের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এটাই যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নতুন বছর জুম্মদের জন্য কঠিন একটা বছর হতে চলেছে।