লংগদুতে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মর ভূমি বেদখলের চেষ্টা, বৌদ্ধ বিহারে হামলা

0
485

হিল ভয়েস, ১২ অক্টোবর ২০২৩, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি জেলাধীন লংগদু উপজেলার ৭নং লংগদু ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাইবোনছড়া এলাকায় পার্শ্ববর্তী সেটেলার বাঙালি কর্তৃক দীর্ঘদিন ধরে এক আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীর ভূমি বেদখলের চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভূমি বেদখলের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে সেটেলার বাঙালি ও স্থানীয় জুম্মদের মধ্যে বিরোধের এক পর্যায়ে সেটেলার বাঙালিরা আজ ১২ অক্টোবর ২০২৩ ভোররাত ২টার দিকে স্থানীয় এক বৌদ্ধ বিহারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিহারের ভিক্ষু প্রাণের ভয়ে পার্শ্ববর্তী এক জুম্ম গ্রামবাসী বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এনিয়ে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লংগদু উপজেলার ৩নং লংগদু মৌজার ভাইবোনছড়া এলাকায় সুনীল কুমার চাকমা, পীং-তরুণী সেন চাকমা এর ৫.০০ একর পরিমাণ ভূমি বন্দোবস্তী রয়েছে। ওই ভূমির হোল্ডিং নং-এইচ ২৬, বন্দোবস্তী মামলা নং-১০৪৭(ডি)/৭৫-৭৬ইং। কয়েক বছর আগে, ভূমির মালিক সুনীল কুমার চাকমা উক্ত ভূমি থেকে ২.০০ একর ভূমি ‘বিবেক সাধনা বন বিহার’ এর নামে দান করেন। ফলে অবশিষ্ট থাকে ৩.০০ একর ভূমি। সুনীল কুমার চাকমা ওই ভূমিতে সেগুনসহ বিভিন্ন বনজ গাছ গড়ে তোলেন।

কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে পার্শ্ববর্তী সেটেলার বাঙালিরা সুনীল কুমার চাকমার ১.০০ একর পরিমাণ রেকর্ডভুক্ত ভূমি জোরপূর্বক বেদখলের চেষ্টা শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে গত ১৭ অক্টোবর ২০১৫ রাতে বেলায় মোঃ আব্দুল গফুর মিয়া (৫৫), পিতা-মৃত আব্দুল মান্নান ও মোঃ রাশেদ মিয়া (৪৫), পিতা-মোঃ আব্দুল গফুর মিয়া এর নেতৃত্বে ভাইবোনছড়া এলাকার একদল সেটেলার বাঙালি ওই জুম্মর ভূমিতে ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী স্তুপীকৃত করে। ভূমির মালিক সুনীল কুমার চাকমাসহ গ্রামবাসীরা ওই ভূমিতে বাড়ি নির্মাণে বাধা দিলে এসময় সেটেলার বাঙালিরা সেখান থেকে চলে যায়। পরবর্তীতেও ২০১৫ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দুই দফা সেটেলার বাঙালিরা ওই ভূমি বেদখল করে ঘর নির্মাণ করার চেষ্টা করে। উভয় ঘটনায় জুম্ম গ্রামবাসীরা বাধা দিলে প্রতিবারই সেটলাররা জুম্মদের ক্ষতি করার হুমকি দেয়।

উক্ত বেদখল প্রচেষ্টার প্রতিকার এবং সেটেলার বাঙালিরা যাতে ওই ভূমি বেদখল করতে না পারে তার ব্যবস্থা চেয়ে, গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখ ভুক্তভোগী সুনীল কুমার চাকমা রাঙ্গামাটি জেলা যুগ্ম জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি এখনো বিচারাধীন রয়েছে।

কিন্তু গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ রাতে ভূমি বেদখলের চেষ্টাকারী সেটেলার আব্দুল গফুর মিয়া ও রাশেদ মিয়া বিচার প্রক্রিয়াকে লঙ্ঘন করে ওই ভূমিতে দু’টি ঘর নির্মাণ করে বসতি স্থাপন শুরু করে এবং বাড়ির চারপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করতে থাকে। বিষয়টি ভূমির মালিক সুনীল কুমার চাকমা জানতে পেরে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করতে নিষেধ করে এবং ঘরগুলো ভেঙ্গে ফেলার অনুরোধ জানায়। কিন্তু সেটেলার বাঙালিরা উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে সুনীল কুমার চাকমাকে বিভিন্ন হুমকিমূলক কথা বলে।

এর পরপরই সুনীল কুমার চাকমা বিষয়টি স্থানীয় ৭নং লংগদু ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন এবং চেয়ারম্যান বিষয়টি থানায় অবগত করার জন্য পরামর্শ দেন। সুনীল কুমার চাকমা থানায় গিয়ে আরো একটি অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু ৪/৫ দিন পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমাধানের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এমতাবস্তায়, গতকাল ১১ অক্টোবর ২০২৩ রাত ১০টার দিকে কে বা কারা সেটেলারদের কর্তৃক অবৈধভাবে নির্মিত দুটি ঘরে ভাঙচুর চালায়। এসময় সেটেলাররা জড়ো হয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে।

সর্বশেষ আজ ১২ অক্টোবর ২০২৩ ভোর রাত ২ টার দিকে মোঃ জাকির হোসেন (৪৫), পীং-জয়নাল খাঁ মিস্ত্রী এর নেতৃত্বে একদল সেটেলার বাঙালি লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ‘বিবেক সাধনা বন বিহার’-এ হামলা চালায়। এসময় সেটেলাররা বিহারের রান্নাঘর, ভোজনশালা, মূল বিহার ঘরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে ফেলে এবং বিভিন্ন জিসিনপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এসময় সেটেলাররা বিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ ক্লেশ বিজয় ভিক্ষুকে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এতে শ্রীমৎ ক্লেশ বিজয় ভিক্ষু পালিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী পদ্ম লোচন কার্বারির বাড়িতে আশ্রয় নেন। যাওয়ার সময় সেটেলার বাঙালিরা বিহারের পার্শ্ববর্তী অবস্থিত দীর্ঘচান চাকমার মুদির দোকানেও ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং জিনিসপত্র নিয়ে যায়।

উক্ত ঘটনার পর এলাকায় উত্তেজনা ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ঘটনার পর সকাল ৭টার দিকে বামে লংগদু সেনা সাব-জোন থেকে সেনাবাহিনীর ২০/২২ জনের একটি দল এবং লংগদু থানার ৭/৮জন পুলিশ ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয় বলে জানা যায়।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, সেটেলার বাঙালিরাই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ওই বাড়িতে ভাঙচুর চালায়।

অপর একটি সূত্র জানায়, ওই এলাকায় চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ সশস্ত্র সদস্যদের আনাগোনা রয়েছে। তারাই সস্তা ইস্যু সৃষ্টি ও জনপ্রিয়তা লাভের উদ্দেশ্যে ওই বাড়িগুলিতে ভাঙচুর চালায়। উক্ত ইস্যুকে কেন্দ্র করে জেএসএসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার হীন উদ্দেশ্যে রাঙ্গামাটি শহরে বিক্ষোভ অনুষ্ঠানের অপচেষ্টা চালায়।