রুমায় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেনা ক্যাম্পে জুম্ম গ্রামবাসীদের দিয়ে জোরপূর্বক কাজ

0
875
ছবিতে জুম্ম গ্রামবাসীদের কর্তৃক সেনা ক্যাম্পে কাজ করার দৃশ্য এবং জনৈক সেনা কম্যান্ডারের চিঠি

হিল ভয়েস, ১৮ আগস্ট ২০২১, বান্দরবান: সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন রুমা উপজেলার রুমা সেনা জোনের ২৮ বীর এর অধীন বগালেক সেনা ক্যাম্পের সেনাবাহিনী আশেপাশের ১৮টি গ্রামের প্রায় ২০০ জন জুম্ম গ্রামবাসীকে জোরপূর্বক তাদের ক্যাম্পের চারপাশের ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার ও বেড়া নির্মাণ করতে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, ২০-২৫ টাকা বাজার মূল্যের বাঁশ জোর করে ১০ টাকায় ক্রয় করেছে বলেও জানা যায়।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, গত ১২ ও ১৩ আগস্ট ২০২১ দুই দিনব্যাপী বগালেক সেনা ক্যাম্পের সেনাবাহিনী ক্যাম্পের আশেপাশের ১৮টি গ্রামের প্রায় ২০০ মানুষকে ডেকে এনে তাদের ক্যাম্পের ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার ও বেড়া নির্মাণ করতে বাধ্য ধরে। উক্ত ১৮টি গ্রাম হল- বগালেক বম পাড়া, বগালেক মংথোয়াই সিং পাড়া, মেনরন পাড়া, লিংপুং পাড়া, ফাইনাং পাড়া, জনারাম পাড়া, কিস্ট পাড়া, হারমোন পাড়া, সাইকত পাড়া, বগামুখ পাড়া, সেরাতং পাড়া, কমলা বাজার পাড়া, রুংতং পাড়া, লিতংসে পাড়া, প্রংপুং মগ পাড়া, ম্রং খ্যং পাড়া, হংক্রি পাড়া, খুলেং পাড়া, ক্যথাই পাড়া।

জানা গেছে, সেনাবাহিনী দুই দিনের কাজ শেষে ২০০ গ্রামবাসীকে জনপ্রতি মোট মাত্র ১০০ টাকা করে নামেমাত্র পারিশ্রমিক হিসেবে প্রদান করে। অথচ রুমা এলাকায় একজন পুরুষের দৈনিক মজুরি ৪০০-৫০০ টাকা বলে জানা গেছে।

এছাড়া সেনাবাহিনী জোর করে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে এক হাজারের অধিক বাঁশ প্রতিটি মাত্র ১০ টাকা হারে ক্রয় করে গ্রামবাসীদের সূত্রে জানা গেছে। অথচ ওই বাঁশের প্রতিটির বাজার মূল্য অন্তত ২০-২৫ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, এর আগেও প্রতি বছর এই বর্ষা মৌসুমে, এমনকি তাদের প্রয়োজনে যেকোনো সময় সেনাবাহিনী গ্রামবাসীদের ডেকে এভাবেই কাজ করতে বাধ্য করে। তবে এই বছরই প্রথম সেনাবাহিনী নামেমাত্র পারিশ্রমিক হিসেবে ১০০ টাকা করে গ্রামবাসীদের দিয়েছে। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে তারা সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে জোরপূর্বকভাবে গ্রামবাসীদেরকে কাজে খাটিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই ২০২১ হিল ভয়েস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও রুমা ও আলীকদম উপজেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীদেরকে জোরপূর্বক বিনাপারিশ্রমিকে কাজে বাধ্য করাসহ মধ্যযুগীয় কায়দায় শোষণ-নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত ২৬ জুলাই ২০২১ সেনাবাহিনীর শাশ্বত ২৭ ইস্ট বেঙ্গল এর ২নং রুমা বাজার সেনা ক্যাম্পের জনৈক ক্যাম্প কম্যান্ডার রুমা উপজেলার লুংঝিড়ি পাড়ার কার্বারি শৈহ্লাউ মারমাকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যান। এসময় ক্যাম্প কম্যান্ডার বলেন, তাদের ক্যাম্পের আশেপাশে জঙ্গলে ভরে গেছে। এই জঙ্গল দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে। এরপর ক্যাম্প কম্যান্ডার কার্বারি শৈহ্লাউ মারমাকে হাতি মাথা পাড়া, পলিপাড়া গ্রামের লোকজনদের দিয়ে অবিলম্বে জঙ্গল পরিষ্কার কড়া নির্দেশ দেন।
ক্যাম্প কম্যান্ডার সেই সাথে আরও বলেন, যতদিন জঙ্গল সম্পূর্ণ পরিষ্কার হচ্ছে না ততদিন পর্যন্ত কাজ করতে হবে। তার জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। এটাই ক্যাম্প কম্যান্ডারের আদেশ বলে তিনি তার কক্ষে ঢুকে যান।

এরপর কার্বারি শৈহ্লাউ মারমা দুপুরে বাড়িতে ফিরে এসে হাতি মাথা পাড়া ও পলি পাড়ার দুই কার্বারিকে ডেকে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও পরের দিন সকালে গিয়ে ক্যাম্পের আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করাসহ পারিশ্রমিক না দেয়ার ব্যাপারে ক্যাম্প কমান্ডারের নির্দেশনা জানিয়ে দেন।

নির্দেশের চাপে গত ২৭ জুলাই ২০২১ সকালে দুই কার্বারি নিজ নিজ গ্রাম থেকে ২০ জন করে ৪০ জন মারমা গ্রামবাসীকে ক্যাম্প পরিষ্কার করার জন্য ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। সারাদিন কাজ করে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই সেনাবাহিনী বিকালে গ্রামবাসীদের পাঠিয়ে দেয়।

আরও জানা গেছে, গত কয়েক মাস আগে আলীকদম সেনা জোনের অধীনস্থ ২৩ বীর বুলাই পাড়া সেনা ক্যাম্পের জনৈক কমান্ডার তার স্বাক্ষর ও সীল সম্বলিত একটি চিঠি উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নের মাওরুম (মাংরুম) পাড়ার কার্বারিকে প্রেরণ করেন। কম্যান্ডার চিঠিতে লেখেন, “মাওরুম কার্বারি আমি ক্যাম্প কমান্ডার বলছি। আমাদের রান্না করে খাওয়ার কোন লাকড়ি নাই, যা আছে ভিজা। আগামীকাল আমাদের উৎসব, রান্না করা লাগবে। তুমি ১০ বোঝা লাকড়ি পাঠাবে আগামীকাল সকালে সমবং পাড়া ও মেনলিউ পাড়া থেকে। তাছাড়া আমাদের রান্না হবে না।” উক্ত চিঠি হিল ভয়েসের কাছে এসে পৌঁছেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, প্রতি বছর অথবা মাসে বলাই পাড়া সেনাক্যাম্পের সেনাবাহিনী কর্তৃক বুলাই পাড়া, ইয়ংচা পাড়া, সমবং পাড়া ও মেনলিউ পাড়া গ্রামবাসীদের বিনা পারিশ্রমিকে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়। এছাড়াও বিগত কোরবানির ঈদের আগে বলাই পাড়া সেনা ক্যাম্প থেকে উক্ত চার গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের গরু লাগবে, গ্রামবাসীরা যেন তাদের গরু কিনে দেয়। গরু পাওয়ার পর টাকা দেয়া হবে।

সেনাবাহিনীর এই নির্দেশের পর গ্রামবাসীরা অনেক কষ্টে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন করে বাজার থেকে গরু ক্রয় করে। ক্রয়কৃত গরু সেনা ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হলে ক্যাম্পের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের মাত্র ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়। শুধু গরু নয়, বলাই পাড়ার সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা যখন যা চাইবে গ্রামবাসীদের তাদের সে চাহিদা পূরণ করতে হয় বলে গ্রামবাসীরা জানান। তাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারলে অত্যাচার চালানো হত।

আরও জানা গেছে, বলাই পাড়া সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের অত্যাচার ও শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৬ সালের দিকে প্রায় ২০-৩০টি ম্রো পরিবার গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে পাড়ি জমান। এভাবেই ৭ বছর যাবত বলাই পাড়া সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের কর্তৃক আদিবাসী ম্রোদের উপর অত্যাচার ও শোষণ চলছে। সেনা সদস্য কর্তৃক নির্যাতনের ভয়ে যা এতদিন কাউকে প্রকাশ করেনি দুই এলাকার গ্রামবাসীরা।