মূলধারার নারী আন্দোলন আদিবাসী নারী আন্দোলনকে নৈকট্যে আনতে পারেনি: নারী দিবসের আলোচনায় ড. আইনুন নাহার

0
984

হিল ভয়েস, ১৫ মার্চ ২০২১, ঢাকা: আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার বলেন, মূলধারা নারী আন্দোলন এখনো আদিবাসী নারী আন্দোলনকে নৈকট্যে আনতে পারেনি।

গতকাল ১৪ মার্চ ২০২১, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, কাপেং ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২১ উপলক্ষে ঢাকার ওয়াইডব্লিউসিএ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে।

আলোচনা সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য হেলেনা তালাং-এর সঞ্চালনায় এবং নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমার সভাপতিত্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ্যাডভোকেসি বিভাগের পরিচালক জনা গোস্বামী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নীনা গোস্বামী, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী ও আদিবাসী যুব ফোরামের প্রতিনিধি চন্দ্রা ত্রিপুরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ফাল্গুনী ত্রিপুরা।

স্বাগত বক্তব্যে ফাল্গুনী ত্রিপুরা আদিবাসী নারী নেতৃত্বের গুরুত্ব, আদিবাসী নারীদের সহিংসতার শিকার হওয়ার কারণ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেড়ে চলেছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে আন্দোলন করার জন্য আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসীরা পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য, পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে তোলার জন্য পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই আদিবাসীদের মৌলিক অধিকারকেও খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে আদিবাসীদের বিভিন্ন অধিকারের কথা বলা থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে একটা মানবিক মর্যাদার রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা বলা হলেও তা আজও অনুপস্থিত। তিনি বলেন, আদিবাসী নারীরা ৫ট ধাপে বৈষম্যের শিকার হয়। তিনি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে ভবিষ্যত পৃথিবী বিনির্মাণের জন্য তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার আরও বলেন, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী হচ্ছে ফুটনোটের মত যেখানে আদিবাসী নারীরা ফুটনোটের ফুটনোট। বিশ্বব্যাপী নারীদের মধ্যে যেমন সাদৃশ্য রয়েছে তেমনি ভিন্নতাও রয়েছে। আমাদের সেই ভিন্নতাকে বুঝতে হবে। আর এই ভিন্নতার কারণেই নারীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। এছাড়া তিনি নেতৃত্বের প্রসঙ্গে রূপান্তরিত নারী নেতৃত্বের গুরুত্বের কথা বলেন। সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ, নিপীড়িত মানুষের জন্য কথা বলার জন্য, নারী-পুরুষের ব্যবধান কমানোর জন্য নারী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

শাহনাজ সুমী বলেন, আধিপত্যবাদ বজায় রাখার কৌশল থেকে নারীকে অবদমন করার চেষ্টা করা হয়। জাতিসংঘের মহাসচিবের মন্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু মহামারী নয়, নারীরা এর চেয়েও অনেককিছুই ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পুরুষের সাথে নারীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

নীনা গোস্বামী বলেন, ব্যবস্থাপনার কৌশল নারীর সহজাত বৈশিষ্ট্য। সমস্যা হল নারীর এই সক্ষমতা নিয়ে নেতৃত্বে আসতে না দেয়া, অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে অগ্রাধিকার না দেয়াই পুরুষতন্ত্রের সমস্যা।

গত বছর লাকিংমে চাকমার উপর ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার কথা উল্লেখ করে জনা গোস্বামী বলেন, আদিবাসী নারীদের উপর জোরপূর্বক অপহরণ, ধর্মান্তরকরণ করে বিয়ে করা ও আত্মহত্যায় প্ররোচনা করা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এত বছর পরেও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়নি।

চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, পুরুষতন্ত্র শুধু নারীকে নয়, পুরুষের জন্যেও ক্ষতিকর। তাই লিঙ্গীয় সমতা আনয়নের জন্যে নারী-পুরুষ উভয়কে সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। এই মহামারীতে পারিবারিক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনয়নে নারীর ভূমিকা সমাজে অবদান রাখছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র উক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে অনুষ্ঠানের সভাপতি চঞ্চনা চাকমা বলেন, তিনি অন্যান্য অধিকারের পাশাপাশি নারী অধিকারের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি সরকারের সমালোচনা করে বলেন, সিডও রিপোর্টে আদিবাসী নারীদের কথা উল্লেখ করা হয় না। এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণ না থাকার কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এছাড়াও জাতিসংঘে তরুণ নেতৃত্বের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।

এছাড়াও মুক্ত আলোচনায় হেবাংয়ের প্রতিনিধি সুচিন্তা চাকমা, নারী উদ্যোক্তা চেতনা চাকমা, বাংলাদেশ গারো বিউটি পার্লার ওনার্স ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট স্বপ্না আজিম ও হেলি চাকমা গত বছর করোনায় তাঁদের সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা সবার সাথে সহভাগিতা করেন।