ভূমি ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় নীতি আদর্শের ভিত্তিতে যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে: সেমিনারে সন্তু লারমা

0
315

হিল ভয়েস, ৮ আগস্ট ২০২৩, ঢাকা: আদিবাসী তরুণদের নীতি আদর্শের ভিত্তিতে ভূমি ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। আজ ৮ আগস্ট, ২০২৩ রাজধানী ঢাকার সিরডাপে আয়োজিত ‘‘আদিবাসীদের ভূমি ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুব শক্তির ভূমিকা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব¡’’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন উপলক্ষে এএলআরডি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামসহ অধিকারভিত্তিক ২৩টি সংস্থা এ সেমিনারের আয়োজন করে।

শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, বাংলাদেশ একটি শ্রেণি বিভক্ত, বৈষম্য ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তাহলে প্রথমে বুঝতে হবে আদিবাসী যুবকদের বাস্তবতা কী, কার দ্বারা এই সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, শোষণ নিপীড়ন কোথা থেকে হচ্ছে। তিনি বলেন, আত্মপক্ষ ও প্রতিপক্ষ কে-তা আগে নির্ধারণ করতে হবে এবং নিজেদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আদিবাসীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বুঝে নীতি ও আদর্শিক দিক বিবেচনা করে আগাতে হবে। ১৪ টি জাতিগোষ্ঠী আন্দোলন করে সরকারের সাথে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমেই আদিবাসীদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা থাকলেও দুঃখজনক হলো ২৫ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি এ বিষয়ে তরুণদের নীতি আদর্শের ভিত্তিতে লড়্ইা সংগ্রামে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

এএলআরডি-র চেয়ারপারসন ও নিজেরা করি-র সমন্বয়কারী খুশী কবিরের সভাপতিত্বে সেমিনারে পৃথক দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উন্নয়ন কর্মী ফাল্গুনী ত্রিপুরা এবং লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ।

ফাল্গুনী ত্রিপুরা তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের সংবিধানে এখনো আদিবাসী জাতিসমূহের জাতিসত্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি নেই। আদিবাসী সংগঠনসমূহ বার বার বলার চেষ্টা করেছে, আদিবাসী জনগণের আত্ম-পরিচয়ের অধিকার রয়েছে। এটি আদিবাসীদের মানবাধিকার। আন্তর্জাতিকভাবেও আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয়ের অধিকার স্বীকৃত। তাই সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী জাতিসমূহের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবির ভিত্তিতে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পার্বত্য চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক সকল আইন সংশোধন করাসহ ৬টি সুপারিশ রাখেন।

পাভেল পার্থ তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, দেশে বিভিন্ন প্রান্তে আদিবাসী নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বিভিন্ন নথিতে আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার এখন দেখা গেলেও সরকার আদিবাসী শব্দ ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানায়। বিশ্বব্যাপি জাতিসংঘ ঘোষিত নানা আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়। জলাভূমি দিবস, নারী দিবস, পরিবেশ দিবস, যুব দিবস, মানবাধিকার দিবস, আদিবাসী দিবস, শিশু দিবস, প্রবীণ দিবস কিংবা খাদ্য দিবস। সবকটি দিবস পালন করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশ এখনো ‘আদিবাসী দিবস’ আয়োজন করেনি। অথচ সংবিধানে আদিবাসীদের ‘নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ ও ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সমতলের আদিবাসীরা আশঙ্কাজনকভাবে দ্রুতগতিতে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। ভূমির পাশাপাশি আদিবাসী অঞ্চলগুলো আজ পরিবেশগতভাবে গভীরতর অসুস্থ। নয়াউদারবাদী উন্নয়ন আর করপোরেট মুনাফার কারণে আদিবাসী অঞ্চলের নদী, টিলা, পাহাড়, অরণ্য প্রাণসম্পদ সবই আজ রক্তাক্ত। অথচ আদিবাসী আত্মপরিচয় কিন্তু এসব প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও বাস্তবতাকে ঘিরেই বিকশিত হয়েছে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, তরুণরা হতাশ হয়ে বসে থাকে তাদের কর্ম নেই, কাজ নেই। আমাদের দেশটা এরকম হওয়ার কথা ছিল না। একজন সাঁওতাল কেমন আছে তা দেখে বুঝা যাবে আমাদের দেশ কতটা সভ্য। উন্নয়ন মানদন্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, ৩০০ এমপি এবং শিল্পপতিদের দেখে বিচার করা যাবে না। তিনি আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা উল্লেখ করে বলেন, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোচনায় আমরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চেয়েছিলাম কিন্তু সংশোধনীতে আমাদের প্রস্তবনার প্রতিফলন ঘটেনি।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ১৯৬২ সালে ‘কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প’ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার আদিবাসী ভূমি হারিয়ে ভারতের অরুণাচলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ৭০ বছর পার হয়ে গেলেও তাদের অরুণাচলের নাগরিকত্ব মিলেনি। তাই তারা উন্নয়ন প্রকল্পের নাম শুনলেই এখনও ভীত ও শংকিত হয়ে পারেন। তিনি বলেন, একটা জাতি তাদেরকে কীভাবে পরিচয় প্রদান করবে এটা তাদের একান্তই নিজেদের ব্যাপার, এখানে সরকার তাদের নাম চাপিয়ে দিতে পারে না। একজনকে ভালোবেসে সেটেল করছে আর অন্যজনকে উচ্ছেদ করে দেশ থেকে বিতারিত করা এটা রাষ্টের কাছে কাম্য নয়।

অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সকল নাগরিককে ধারণ করা। এসডিজি কখনই অর্জন করা সম্ভব হবে না যদি সকল নাগরিককে সম মর্যাদায় উন্নীত করা না হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্থ স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতা নয়, এর অর্থ হচ্ছে সমনাগরিকত্বের বিষয়। পার্বত্য চুক্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এখন আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে, তরুণদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চিন্তা বিস্তৃত হচ্ছে। তিনি তরুণদের সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান।

এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, সকল তরুণদের আলোচনা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আদিবাসীদের জীবন নিরাপদ না হলে বাঙালিদের জীবনও নিরাপদ হবে না। রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনে আদিবাসী ও অ-আদিবাসী তরুণদের একসাথে কাজ করার আহবান জানান তিনি। তিনি আরও দাবি করেন যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

খুশি কবির বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও ধর্ম নিরেপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র অর্জিত হয়নি। সংবিধানে লেখা আছে সকল নাগরিকের সমান অধিকার কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। তিনি আরো বলেন, আমাদের সকলের দায়িত্ব হলো এই আদিবাসী মানুষের আত্মপরিচয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে বারবার সামনে নিয়ে আসা এবং আন্দোলনে রূপ দেয়া। তবেই আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি গুরুত্ব পাবে এবং তরুণদেরকেই এই আন্দোলনের দায়িত্ব নিতে হবে।

সেমিনারে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন সারা মারান্ডি, তরুন মুন্ডা ও টনি চিড়ান। এছাড়াও মুক্ত আলোচনা পর্বে আদিবাসী নেতা রাজকুমার সাও, স্বপন কুমার সাঁওতাল, গোলাম মোস্তফা, সুভা সরকার, যোগেন টপ্প, অর্পা কুজুর, আফজাল হোসেন, মেরিনা হাঁসদা প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।