বান্দরবানে ৮ হত্যাকান্ডের পর জনশূন্য বম ও খিয়াং পাড়া

0
396

হিল ভয়েস, ১০ এপ্রিল ২০২৩, বান্দরবান: সম্প্রতি বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার সীমান্তবর্তী খামতাং পাড়ায় সেনামদদপুষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ৮ জনকে নৃশংসভাবে হত্যার পর এলাকার বাসিন্দারা ভয়ে-আতঙ্কে জীবন বাঁচাতে নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে ২০ পরিবারের ৬৪ জন রুমা সদরের বম সোশ্যাল কাউন্সিল হলরুমে এবং ৪৯ পরিবারের ১৯২ জন রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়ার খবর পাওয়া গেছে।

স্থানীয়রা জানান, ওই ঘটনার পর থেকেই খামতাং পাড়ার আশেপাশের এলকার বম, খিয়াং, মারমা পাড়াগুলোর বাসিন্দারা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

গত রোববার (৯ এপ্রিল ২০২৩) সকালে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড পাইংক্ষ্যং পাড়া থেকে শিশু ও বৃদ্ধসহ ৬২ পরিবারের ২১০ জন ওই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় ৯-১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছান তারা।

স্কুলে আশ্রয় নেওয়া লোকদের কাছ থেকে জানা যায়, পাইংক্ষ্যং পাড়া থেকে ৯২টি বম ও ১টি মারমা পরিবার সকাল ১১টায় রওনা দেয় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ চাঁদের গাড়িতে রোয়াংছড়িতে পৌঁছেছেন।

পাইংক্ষ্যং পাড়ার ৬২ পরিবারের ২১০ জনের একটি দল প্রথমে রোয়াংছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছায়। পাশের ক্যপ্লং পাড়া থেকেও আরও ৪০-৫০ পরিবার আসছে বলে জানা গেছে।

উদ্বাস্তুদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা:

এখন বম সম্প্রদায়ের কেউ বাজারে এসে দুই কেজির বেশি চাল কিনতে পারে না। এমনিতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়ে এ বছর ঠিকমত জুমচাষও করতে পারেনি। বম পাড়াগুলোতে নীরবে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি ভাল না হলে একটা মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

বাজারে জিনিসপত্রও ঠিকমত বিক্রি করতে পারে না। অনেকের হাতে নগদ টাকাও নেই। প্রতিদিন কেউ না কেউ টাকা চেয়ে ফোন করে। কয়েক দিন আগেও সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু পাড়ায় ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

বম সোস্যাল কাউন্সিলের এক কর্মকর্তা বলেন, “এক সময় দেখা যাবে, খাদ্য সংকটে কেউ কেউ না খেয়ে আছে। আমাদের ধারণা, টিকতে না পারলে অধিকাংশ বম জনগোষ্ঠীর লোকজন প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যাবে।”

তাদের পরিবার প্রতি পাঁচ কেজি করে চাল এবং অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ইউএনও বলেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

“রোয়াংছড়ির আশ্রয়প্রার্থীদের দুপুরের খাবার দেওয়া হয়েছে। রাতেও দেওয়া হবে। তাদের কম্বল সরবরাহ করা হবে। সেখানে অতিরিক্ত টয়লেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারা যতদিন এখানে থাকবে, ততদিন এই ব্যবস্থা চালু থাকবে,” বলেন ইউএনও।

রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লা মং মারমা জানান, রুমায় বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া লোকজনদের জন্য তার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে শনিবার সকালে ২০০ কেজি চাল ও অন্যান্য খাবার সামগ্রী পাঠানো হয়েছে।

লাশ হস্তান্তর ও স্বজনদের আহাজারি:

খামতাংপাড়া থে‌কে আট জনের গু‌লি‌বিদ্ধ লাশের ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের কেউ লাশ নিতে আসেননি। অবশেষে শনিবার দুপুরে বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতির কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়।

শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বম জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষদের অনেকে লাশগুলো দেখার জন্য এসেছেন। লাশ দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজার লম বম প্রথম আলোকে বলেন, জুরভারংপাড়ায় ছয়জনের লাশ একই স্থানে ও পাইংখিয়াংপাড়ায় একজনের লাশ আলাদাভাবে সমাধিস্থ করা হবে। রৌনিনপাড়ার নিহত ব্যক্তির লাশ তাঁর পাড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

মরদেহ হস্তান্তরের সময় হাসপাতাল মর্গের কাছে আরও কয়েকজন নারী-পুরুষকে দেখা গেছে। তবে মর্গ থেকে লাশ চাঁদের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজনকে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়।

মরদেহগুলো রৌনিন পাড়ায় সেখানে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মরদেহগুলো দেখার পর গ্রামবাসী ও স্বজনদের আহাজারিতে বাতাশ ভারি হয়ে উঠে।

এখনো কেউ মামলা করেনি:

৮ জন হত্যাকান্ডের ঘটনায় কেউ মামলা করতে আসেনি। রোয়াংছড়ি থানার ওসি আবদুল মান্নান বলেন, অপেক্ষা করা হচ্ছে কেউ মামলা করতে আসে কিনা। কেউ না এলে পুলিশ মামলা করার উদ্যোগ নেবে।

আতঙ্কিত গ্রামবাসী

বম স্যোশাল কাউন্সিলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, “বম জনগোষ্ঠীর লোকজন এমনিতে আগে থেকে আতঙ্কে রয়েছে। আটজন নিহতের ঘটনার পর ভয় ও আতঙ্ক আরও বেড়েছে।”

বম স্যোশাল কাউন্সিলের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, “পাহাড়ে একটা বিশেষ মহল রয়েছে। যারা এখানে শান্তি-স্থিতিশীলতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পাহাড়ে মানুষদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীন জীবনযাপনকে নষ্ট করার জন্য সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।

“পরিকল্পিতভাবে তাদেরকে দেশান্তরে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনা একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলতেও চান না। এসব ঘটনা আর পুলিশের তদন্ত দিয়ে হবে না। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে কিছুটা হলে সুবিচার পেতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

গত বছর অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) যা স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এবং নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া‘র বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরুর পরও জানুয়ারিতে মানুষ পাড়া ছেড়েছিল।

মার্চের শুরুর দিকে স্থানীয় কারবারি, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন জানায়, অভিযানের মধ্যে ‘আতঙ্কে’ বান্দরবানের রুমা থানা ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অন্তত ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সে সময় বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িছাড়া হওয়ায় অনেকে জুম চাষের ক্ষতির হয় যা পাহাড়ি মানুষদের সারা বছরের খাবারের সংস্থানের উপায়।

আরো পড়ুন

রোয়াংছড়িতে সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক ৮ জনকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা