বাঘমারা ঘটনার অজুহাতে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর সেনাবাহিনীর অভিযান

0
1451
ছবি: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সংগৃহীত

হিল ভয়েস, ৯ জুলাই ২০২০, বান্দরবান:  গত ৭ জুলাই বাঘমারায় সংঘটিত ৬ খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনী বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ গ্রামবাসীর উপর হয়রানি ও ঘরবাড়ি তল্লাসীসহ অভিযান জোরদার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি গ্রামে সেনাবাহিনী চড়াও হয়েছে এবং অন্তত একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সোচ্চার ১০ জনের বিরুদ্ধে বান্দরবান থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, গত ৮ জুলাই ২০২০ মঙ্গলবার রাত আনুমানিক দেড়টার সময় ৩টি গাড়িতে করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বান্দরবান সদর উপজেলার কুয়ালং ইউনিয়নের উজি হেডম্যান পাড়ায় হানা দেয় এবং পুরো গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে।

এ সময় সেনারা ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের জোরপূর্বক জাগিয়ে তোলে এবং নারী-পুরুষ সবাইয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র চেক করে। সেখানে ঘর জামাই হিসেবে শ্বশুর বাড়িতে থাকা সুমন মারমা তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে না পারায় সেনারা তাকে আটক করে নিয়ে যায়।

আজ বৃহস্পতিবার পরিবারের লোকজন তার বিষয়ে স্থানীয় সেনাজোনে যোগাযোগ করলে আটকের বিষয়টি অস্বীকার হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে পরিবারের লোকজন উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। সুমন মারমা উজি হেডম্যান পাড়ায় শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করে ভাড়ায় মোটর সাইকেল ও মাহেন্দ্র গাড়ি চালিয়ে সংসার পরিচালনা করেন।

এদিকে ৯ জুলাই রাত ২:০০ টার দিকে সেনাবাহিনীর একদল সদস্য রাজভিলা ইউনিয়নের বাঘমারা হেডম্যান পাড়ায় তল্লাসী অভিযান চালায়। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বান্দরবান সদর উপজেলা শাখার সহ ছাত্র ও যুব সম্পাদক মংশৈসাই মারমা বাড়ি সেনা সদস্যরা ঘেরাও করে।

এ সময় সেনা সদস্যরা সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বাড়িটি তল্লাশী চালায়। তবে সেসময় মংশেসাই মারমা বাড়িতে ছিলেন না। তাকে না পেয়ে সেনা সদস্য পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি প্রদান করে।

অন্যদিকে বাঘমারা ঘটনায় গতকাল ৮ জুলাই ২০২০ সংস্কারপন্থীদের বান্দরবান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও সহযাগী সংগঠনের ১০ সদস্যদের বিরুদ্ধে বান্দরবান সদর থানায় বাঘমারা ৬ খুনের ঘটনায় এক মামলা দায়ের করেন। এছাড়া এ মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানা যায়।

মামলায় যে ১০ আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন ১. আপাই মারমা (৩৮), ২. অংপ্রু মারমা (৪৫), ৩. বিনয় লাল চাকমা (৪৫), ৪. নিরেক্ত চাকমা (৫০), ৫. মংপ্রু মারমা (৪৮), ৬. শান্তি বিকাশ চাকমা (৩৮), ৭. জরিপ কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৫০), ৮. মংশৈসা মারমা (৪০), ৯. উসাইনু মারমা (৩৮) ও ১০. সুমন চাকমা (৩৫)। তারা সবাই সদর উপজেলার রাজভিলা ও কুহালং ইউনিয়নে বিভিন্ন পাড়ার বাসিন্দা বলে জানা গেছে।

জনসংহতি সমিতির সূত্রে জানা যায় যে, আপাই মারমা, নিরেক্ত চাকমা, মংপ্রু মারমা, জরিপ কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও মংশৈসা মারমা প্রমুখ ৫ জন ব্যক্তি জনসংহতি সমিতির সদস্য। আর বাকি ৫ জন ব্যক্তি জনসংহতি সমিতির সমর্থক বলে জানা গেছে।

জনসংহতি সমিতির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানির উদ্দেশ্যে ও বান্দরবানে জনসংহতি সমিতির সংগঠনকে ধ্বংস করার হীনলক্ষ্যে সমিতির উল্লেখিত সদস্য ও সমর্থকদেরকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উক্ত মামলায় আসামী করা হয়েছে।

জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার নাম প্রকাশে অনিচ্ছ্যুক বান্দরবানের নাগরিক সমাজের এক ব্যক্তি জানান যে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চলমান লকডাউনকে উপেক্ষা করে বিশেষ বাহিনীর সহায়তায় গত ৩১ মে সংস্কারপন্থীদের বান্দরবানে আগমন বান্দরবানবাসী কখনোই ভালো চোখে দেখেনি।

বান্দরবানে আগমনের পর পরই প্রকাশ্য অস্ত্র দেখিয়ে একের পর এক ব্যক্তিকে তাদের আস্তানায় ডেকে মারধর, হয়রানি, চাঁদা দাবি ইত্যাদি অপকর্মের ফলে বান্দরবানবাসী সংস্কারপন্থীর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বলে তিনি জানান।

অন্যদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানান, সংস্কারপন্থীদের ’৭১-এর রাজাকার বাহিনীর মতো ভূমিকাকে অধিকাংশ মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। সেনাবাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সংস্কারপন্থী সশস্ত্র সদস্যদের প্রকাশ্য চলাফেলা অধিকাংশ মানুষ খারাপ চোখে দেখেছে বলে উক্ত জনপ্রতিনিধি জানান।

উক্ত জনপ্রতিনিধি আরো জানান যে, আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) দল থেকে বেরিয়ে এসে নবগঠিত উচ্ছৃঙ্খল মগ পার্টি বা মগ লিবারেশন পার্টির সাথে সংস্কারপন্থীদের দহরম মহরমও বান্দরবানবাসী বাঁকা চোখে দেখেছে। অন্যদিকে এতে করে  সংস্কারপন্থী ও মগ পার্টির উপর এএলপিও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

গত ৭ জুলাই বাঘমারায় ৬ খুনের ঘটনাকে বান্দরবানবাসী গ্রহণ করতে না পারলেও একই সাথে তারা যারপরনাই স্বস্তিবোধ করছেন বলে তিনি অভিমত ব্যক্তি করেন। কেননা এ ঘটনার ফলে সংস্কারপন্থীদের হয়রানি ও সন্ত্রাস হ্রাস পেতে পারে। বান্দরবানবাসী কিছুটা হলেও সেই অরাজকতা থেকে রেহাই পেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।