বমপার্টির গুলিতে ১ সেনা নিহত ও ২ আহত, বমপার্টি আজ সেনাবাহিনীর বুমেরাং ইস্যু

0
344

হিল ভয়েস, ১৪ মার্চ ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: বান্দরবানে পর পর দুই দিনের পৃথক হামলার ঘটনায় বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল পার্টির (কেএনএফ) সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সদস্য নিহত এবং দুইজন সেনা সদস্য ও এক শ্রমিক আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর সড়ক নির্মাণে নিয়োজিত ৪ বাঙালি শ্রমিককেও অপহরণ করে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া চাঁদার দাবিতে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর নির্মাণাধীন থানচি-রেমাক্রি-লেইক্রি সড়কে সেকাদুঝিরি সেতুটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য যে, ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির ভিত্তিতে জুম্মদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করা, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের চলমান আন্দোলনকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হিসেবে সেনাবাহিনী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামক বমপার্টিকে গঠনের গোড়া থেকেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছিল এবং একপর্যায়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে সশস্ত্র তৎপরতায় মদদ দিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর সেই ষড়যন্ত্র আজ নিজেদের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এমনকি ২০২০ সাল থেকে অর্থের বিনিময়ে সেনা-মদদপুষ্ট বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা যখন রুমার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের আস্তানায় ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামক আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী সংগঠনকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে, তখন সেনাবাহিনী কার্যত জেনেও না জানার ভান করে প্রকারান্তরে বমপার্টিকে মদদ দিয়েছিল। অন্যথায় তিন পার্বত্য জেলায় সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ও নিবিড় গোয়েন্দা নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে কখনোই বমপার্টি কর্তৃক দীর্ঘ প্রায় তিন বছর ধরে কয়েক ডজন ইসলামী জঙ্গীকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো এত বড় কাজ গোপনে চালিয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব ছিল না।

একপর্যায়ে বমপার্টি কর্তৃক ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণের খবর প্রকাশ পেলে এবং তৎপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক চাপে পড়লে বাংলাদেশ সরকার নড়েচড়ে বসে। তৎপ্রেক্ষিতে ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গী আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে বান্দরবানে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে যৌথবাহিনী কম্বিং অপারেশন শুরু করে। সেই সময়ও সেনাবাহিনী কৌশলে বমপার্টি ও ইসলামী জঙ্গীদেরকে রোয়াংছড়ির সিপ্পি পাহাড়ের আস্তানা থেকে পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দিয়েছিল। এমনকি রুমার সিলৌপি পাড়া সংলগ্ন এলাকায় বমপার্টির অবস্থান জেনেও সেনাবাহিনী রহস্যজনকভাবে তাদের উপর হামলা থেকে বিরত থাকে।

আরো জানা গেছে যে, ঢাকার পলিসির বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের প্রতি এহেন কায়েমী নীতির কারণে তখন কম্বিং অপারেশনের একপর্যায়ে ঢাকা থেকে এসএসএফ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) ও র‍্যাবকে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী, এসএসএফ ও র‍্যাবের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে উক্ত অভিযান সফল হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এমনকি ২১ অক্টোবর ২০২২ র‌্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে বমপার্টির আস্তানা থেকে ৭ জন ইসলামী জঙ্গী ও ৩ জন বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছিল মর্মে যে দাবি করা হয়েছিল তা ছিল ভূয়া। বস্তুত তাদেরকে অন্য জায়গা থেকে গ্রেফতার করে বমপার্টি আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে মর্মে দেখানো হয়েছিল। মূলত আন্তর্জাতিক জনমতকে বিভ্রান্ত করার হীনলক্ষ্যে বমপার্টির ক্যাম্পে আশ্রিত ইসলামী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের সফলতা দেখাতে এধরনের ভুয়া আটকের ঘটনা প্রচার করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

বস্তুত সেনাবাহিনীর লালিত-পালিত সেই বমপার্টি আজ সেনাবাহিনীর জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারই প্রমাণ হলো গত ১২ মার্চ ২০২৩ রবিবার বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইনক্ষ্যং পাড়ায় বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সেনা সদস্য নিহত হওয়া এবং দুইজন সেনা সদস্য আহত হওয়ার ঘটনা। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত সেনা জওয়ানের নাম মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন এবং আহত সদস্যের নাম সৈনিক রাকিব (২৩) এবং সৈনিক শিশির (২৩) বলে জানা গেছে।

এর একদিন আগে ১১ মার্চ ২০২৩ শনিবার থানচি উপজেলার লিক্রিতে বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলি করে সেনাবাহিনীর সীমান্ত সড়ক নির্মাণে নিয়োজিত মো: জালাল (২৭) নামে এক বাঙালি শ্রমিককে আহত করে এবং অপর ৪ শ্রমিককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহৃতদের মধ্যে চালক রুবেল (৩০) ও সূর্য দাশ (৩০) নামে দুইজনের নাম জানা যায়। পরে অন্যান্য শ্রমিকরা আহত মো: জালালকে উদ্ধার করে থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় বলে জানা যায়।

গতকাল সোমবার (১৩ মার্চ) চাঁদার দাবিতে সেনাবাহিনী কর্তৃক বান্দরবানে নির্মাণাধীন থানচি-রেমাক্রি-লেইক্রি সড়কে সেকাদুঝিরি সেতুটি বমপার্টি সন্ত্রাসীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে জানা গেছে। তবে সেতুর পাশের দেয়ালে সামান্য ক্ষতি হলেও মূল সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে জানা গেছে। এর আগে গত ৮ মার্চ ২০২৩ বমপার্টি সন্ত্রাসীরা ব্যাঙছড়ি সড়ক বাবদ থেকে ১১ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এর আগে কম্বিং অপারেশন চলাকালে ১২ অক্টোবর ২০২২ বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও ইসলামী জঙ্গীরা বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় সেনাবাহিনীর উপর সশস্ত্র হামলা করলে সেনাবাহিনীর তিনজন সদস্য নিহত ও ৭ জন আহত হয়। এছাড়া সেনাবাহিনীর একটি এলএমজি ও একটি সিআরসহ তিনটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।

কেএনএফ শুধু ইসলামী জঙ্গীদের প্রশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত নয়, বম জনগোষ্ঠীসহ নিরীহ আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর খুন-খারাবি, অপহরণ, মারধর, হুমকি-ধামকি ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। এমনকি কেএনএফের নির্যাতন থেকে খ্রীষ্টান পাদ্রীরাও রেহাই পাচ্ছেন না।

গত বছর থেকে এ যাবৎ কেএনএফ বম জনগোষ্ঠীর ১১ জনসহ ২৬ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে অপহরণ, বম জনগোষ্ঠীর ৩ জনসহ কমপক্ষে ৭ জনকে হত্যা, প্রায় দুই ডজন গ্রামের এক হাজারের বম, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা ও মারমা অধিবাসী উচ্ছেদ করেছে। বমপার্টির উচ্ছেদের শিকার হয়েছে বম জনগোষ্ঠীর প্রায় ছয় শত গ্রামবাসী শরণার্থী হিসেবে মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে গিয়ে সেনাবাহিনী যে বমপার্টিকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, সেই ষড়যন্ত্র আজ সেনাবাহিনীর জন্য বুমেরাং ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সেনাবাহিনীর পোষ্যপুত্র বমপার্টি আজ ইসলামী জঙ্গীদেও প্রশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক ইসলামী সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছে এবং সেনাবাহিনী ও নিরীহ জুম্ম গ্রামবাসীদের উপর একের পর এক হামলা, গুলি বর্ষণ ও হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য সম্পূর্ণভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীই দায়ী বলে নির্দ্বিধায় বলা যায়।

বলাবাহুল্য, এভাবে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক ষড়যন্ত্র হাতে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি ও মদদ দেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রাসারণের জন্য মদদ দেয়া, পর্যটন কেন্দ্র ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল ও উচ্ছেদ করা, জুম্মদের জায়গা-জমি দখলে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগে সেটেলার বাঙালিদের মদদ প্রদান, চুক্তি মোতাবেক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারে বাধা প্রদান এবং প্রত্যাহৃত ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ, আইন-শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে সেনা অভিযান ও নিপীড়ন-নির্যাতন, চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্মদেরকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ হিসেবে অপরাধীকরণের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম হাতে নিতে থাকে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর এধরনের কার্যক্রমের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতো আবারো সংঘাতময় হয়ে উঠছে। আর তার জন্য সেনাবাহিনী উল্টো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার জুম্ম জনগণের উপর দায় চাপাচ্ছে৷

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, সেনাবাহিনী আজ এধরনের একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্র হাতে নেয়ায় সেই ঐতিহাসিক সুযোগ ধুলিস্যাৎ হতে বসেছে, যা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না বলে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল অভিমত ব্যক্ত করেছেন।