‘পাহাড়ের মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর এবং চরম নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে’ -জেএসএসের জাতীয় সম্মেলনে ঊষাতন তালুকদার

0
324
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার

হিল ভয়েস, ২৮ জুলাই ২০২৩, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটিতে শুরু হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) ১১তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দলের সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেছেন, আজকে পাহাড়ের মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর এবং চরম নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

আজ শুক্রবার (২৮ জুলাই) সকাল ১০:৩০ টায় রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউটে জনসংহতি সমিতির ১১তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলন আগামীকাল ২৯ জুলাই পর্যন্ত চলবে।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন মেঞোসিং মারমা। উদ্বোধনী সভার শেষদিকে সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা একগুচ্ছ বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। তবে তিনি এসময় কোনো বক্তব্য রাখেননি।

জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য মাধবীলতা চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন জনসংহতি সমিতির সহ সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার এবং বক্তব্য রাখেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক ও কবি শিশির চাকমা।

সমিতির সহ সভাপতি ঊষাতন তালুকদার তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও, সমাবেশের অধিকার, রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার অধিকার থাকা সত্ত্বেও কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারছি না। বিশেষ করে চুক্তির পরে আমরা আশা করেছিলাম, পাহাড়ের মানুষ আশা করেছিলো, সুন্দর জীবন হবে, গণতান্ত্রিক জীবন হবে এবং আমরা আমাদের কর্মকান্ড যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারবো। কিন্তু বিধি বাম। তা করা সম্ভব হয়নি। যার কারণে আজকে ২৬ বছর পরেও পার্বত্য চুক্তি অধরা রয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে চুক্তির বাস্তবায়ন। যার কারণে আজকে পাহাড়ের মানুষ, জুম্ম জনগণ, ওনাদের চেহারা দেখলে বোঝা যায়, এখানে যারা এসেছেন তাদের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, আজকে পাহাড়ের মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর এবং চরম নিরাপত্তাহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আজকে যেমন চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না, অপরদিকে সারা বিশ্বের টালমাটাল অবস্থা। ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কখন যে পারমানবিক যুদ্ধ শুরু হয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তা বলা যাচ্ছে না। অপরদিকে, এ যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। তারই প্রভাবে বাংলাদেশেও আজকে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। যার কারণে আজকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে মানুষ দূর্বিষহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

তিনি বলেন, আজকে যে প্রতিপাদ্য বিষয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হোন’-এই শ্লোগানকে সামনে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো। নতুন করে এই চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যাবো এবং চুক্তি বাস্তবায়ন না করে ছাড়বো না। এই পার্বত্য চুক্তি করতে গিয়ে পার্টির ও জুম্ম জনগণের অনেক রক্ত দিতে হচ্ছে। এই রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না এবং পার্টি ও জুম্ম জনগণ চুক্তির অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য বদ্ধপরিকর।

সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, সবাইয়ের পক্ষ থেকে আমার আহ্বান- আসুন, আর গড়িমসি নয়, কালক্ষেপণ নয়, কোনো অজুহাত নয়, ইগো নয়, আমরা কেউ বিদেশি নই, আমরা এই বাংলাদেশেরই নাগরিক, পার্বত্য চুক্তি করেছি আপনাদের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে, এই আস্থা ও বিশ্বাস যেন বৃথা না যায়।

তিনি বলেন, পাহাড়ের মানুষ শান্তিপ্রিয়। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। নিজেদের জাতীয় অস্তিত্ব, ভূমির অধিকার এবং আমাদের যে মৌলিক অধিকার, আমাদের প্রথা-রীতি নিয়ে আমরা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই। এর বাইরে কিছু নয়। চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই এর সমাধান হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।

প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি চাপিয়ে রাখার বিষয় নয়, লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। এটা সারাবিশ্বে প্রচারিত হয়েছে এবং পরিচিত হয়েছে। এই চুক্তি শুধু আমাদের দেশে নয়, আমাদের প্রতিবেশি আশেপাশের বন্ধুপ্রতীম দেশসহ ইউরোপ-আমেরিকায়ও এই চুক্তি গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদের একত্রিত হতে হবে।

শিশির চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা যারা আছি তারা মহাসংকটের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর অতিবাহিত হতে চললো। এর আগে জনসংহতি সমিতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রয়োজনে, জুম্ম জনগণের অধিকারের প্রশ্নে, মানবাধিকারের প্রশ্নে, দেয়ালে যখন পিট ঠেকে গিয়েছিল, তখন সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে তাদের। দীর্ঘ সময়ে তাদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, রক্ত এবং জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। জনসংহতি সমিতির যিনি প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁকেও পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতি প্রয়োজনে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এক বিশেষ অবস্থায় করতে হয়েছে এবং জনসংহতি সমিতি প্রয়োজন মনে করেছে, পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। কিন্তু আজকে ২৬ বছর অতিবাহিত হতে চললো, সরকার সেই চুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে এবং এই চুক্তিকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে।

শিশির চাকমা আরও বলেন, এই পার্বত্য চট্টগ্রামে, পাহাড়ে নিরাপদে ঘোরার, চলাফেরা করার অধিকার আমরা হারিয়েছি। আজকে সেই অধিকার আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আজকে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে আমরা অনিরাপদে আছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অবশ্যই কাটিয়ে ওঠা যাবে। এজন্য দরকার শুধু জেএসএস কেন, এখানকার প্রতিটি মানুষের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য থাকতে হবে।

জনসংহতি সমিতির সূত্রে জানা গেছে, জনসংহতি সমিতির জেলা, থানা ও ইউনিয়ন শাখার প্রতিনিধি এবং সমিতির অঙ্গ সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠী, পাহাড়ি শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের পর্যবেক্ষক মিলে প্রায় সাড়ে চারশত প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক এই জাতীয় সম্মেলনে যোগদান করছেন।

সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০১৫ সালে জনসংহতি সমিতির ১০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিন বছর পর পর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের বিধান অনুসারে ২০১৮ সালে ১১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়সূচি ছিল। কিন্তু বিরাজমান পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে ৮ বছর পর সংগঠনের ১১তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সমাজহিতৈষী বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজাকে সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত ও তৎকালীন গণপরিষদের সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে সাধারণ সম্পাদক করে জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।