পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকায় ছাত্র-যুব সমাবেশ ও মিছিল

0
230

হিল ভয়েস, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ঢাকা: আজ বুধবার (২৯ নভেম্বর ২০২৩) সকাল ১১:০০টায় ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে আদিবাসী ছাত্র যুব সংগঠনসমূহ একটি ছাত্র যুব সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করে।

সমাবেশে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ’র সভাপতিত্বে ও পিসিপি, ঢাকা মহানগর শাখার তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হ্লামংচিং মারমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্তনী রেমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি নিপন ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি চন্দ্রিকা চাকমা, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীল, ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি অতুলন দাশ আলো, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জন জেত্রা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস’ কাউন্সিল ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ক্যংজ মারমা প্রমুখ।

সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি নিপন ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান রাজনৈতিক সমস্যাসহ সকল সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। এই ২৬ বছরে চুক্তির ২৫টি ধারা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলেও ১৮টি ধারা আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে ও ১৯টি ধারা বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামে গিয়ে বলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। চুক্তিকে নিয়ে সরকারের এই ধরনের তালবাহানা, অপপ্রচার কখনও সফলতা বয়ে আনবেনা। কয়েকদিন আগে আপনারা স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখেছেন কুকিমারা বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার জুম্মদের অনুষ্ঠানে গিয়ে লাথি মেরে ফানুস পুড়িয়ে দিয়েছিল। তাই বলতে চাই, পাহাড়ে নিরাপত্তার নামে সেনাশাসন অব্যাহত রাখা হলে এর পরিণাম হবে ভয়ংকর।

সংহতি বক্তব্যে বাংলাদেশ ছা্ত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীল বলেন, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা মনে করেছিলাম আদিবাসীরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে। আজকে চুক্তির ২৬ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে আমাদেরকে আজকেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল, সমাবেশ করতে হচ্ছে। এতে সরকারের লজ্জ্বা হওয়া দরকার যে, আমরা এই বর্ষপূর্তিতে আনন্দ উৎসব করতে পারছি না।

তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে যত হত্যা, খুন, ভূমি বেদখল সবকিছতে সেনাবাহিনী যুক্ত। চুক্তি করে লাভ হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। তার বদলে পাহাড়ের জনগণ কিছুই পায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি কমিশন গঠিত হলেও এই পর্যন্ত সেখানে জমা হওয়া কোনো আবেদনের একটিও ফয়সালা হয়নি। গোবিন্দগঞ্জে বাগদাফার্মে সান্তাল হত্যাকান্ডের মূল মাষ্টার মাইন্ড আবুল কালাম আজাদ। এইবারে আওয়ামী লীগ সরকার তার হাতে নমিনেশন পেপার ধরিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে আওয়ামীলীগ সরকার এভাবে আদিবাসী বিরোধীদের সংসদে নিয়ে যাওয়ার  আয়োজন করছে।

সংহতি বক্তব্যে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি অতুলন দাশ আলো বলেন, এই রাষ্ট্র নির্মাণে বাঙালির যেমন রক্ত আছে, তেমনি আদিবাসী মানুষেরও রক্ত আছে। বিগত ৫২বছরে যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারাই আদিবাসীদেরকে ব্যবহার করেছে। সরকারের আজ লজ্জা হওয়ার কথা। চুক্তির আজ ২৬বছর পরেও এই চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সমাবেশ করতে হচ্ছে আমাদের। কিন্তু সরকার যদি নিজেদেরকে আদিবাসী বান্ধব প্রমাণ করতে চায়, তবে আমি অনুরোধ করব যেন তারা তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করে। শুধু মুলা ঝুলিয়ে আদিবাসীদের ব্যবহার কথা থামাতে হবে। অন্যথায় সকল প্রগতিশীল সংগঠনকে সাথে নিয়ে আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মু্ক্তা বাড়ৈ বলেন, এই পর্যন্ত যারা যারা ন্যায়ের পথে লড়াই করেছেন তাঁদেরকে আমি শ্রদ্ধা জানাই আর যারা ক্ষমতার সিংহাসনে বসে শোষণ করেছেন তাদেরকে আমি ধিক্কার জানাই। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে যেভাবে ভেবেছিলাম তার উল্টোটি এখন দেখতে পাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যাচ্ছে। জুম্মদেরকে কেন নিজভূমে পরবাসী করে রাখা হচ্ছে? সেখানে সেনাশাসন কেন? এই বিষয়গুলো সার্বভৌমত্বের সাথে পরিপন্থি।

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ বলেন, আমরা কতদিন শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে কিংবা  রাজু ভাস্কর্যর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব। আমাদের প্রতিবাদ সরকার শুনেও না শুনার ভান করে থাকে। এই দেশের সরকার নির্লজ্জ্ব। কেননা, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি এই সরকারের সাথে স্বাক্ষরিত হলেও তা যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সরকার চুক্তিতে নামে মাত্র স্বাক্ষর করেছে। বর্তমান সরকারের সাথে যাদের অর্থাৎ জেএসএসের চুক্তি সম্পাদিত হয়ে বর্তমানে সরকার বাস্তবায়ন না করার নানা তালবাহানা নিচ্ছে এবং জেএসসের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাদেরকে ঘরছাড়া করে রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করলেও যথাযথ ক্ষমতা প্রদান না করে উল্টো আঞ্চলিক পরিষদকে অথর্ব করে রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অ্যান্তনী রেমা বলেন, আদিবাসীদের সংকট দিন দিন বাড়ছে। নিরাপত্তার অজুহাতে পাহাড়ের জনজীবন কঠিন থেকে কঠিন অবস্থার সৃষ্টি করেছে বর্তমান সরকার। পাহাড়ের পাশাপাশি সমতলের আদিবাসীদেরকেও অনেক আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা পূরণ করা হয়নি। মধুপুরে ইকোপার্ক করার সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেই গিয়ে সমতলের আদিবাসীদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। সমতলে চা শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পায় না। আর কত প্রজন্ম পার হয়ে গেলে আদিবাসীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে? আর কত বছর পার হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন হবে?

স্বাগত বক্তব্যে বিএমএসসির ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক ক্যংজ মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রায় ২৬টি বছর পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু পাহাড়ে সেটেলারদের উপদ্রব, সেনাশাসন, নারী নির্যাতন, ভূমি বেদখল সমানে চলছে। এই চুক্তি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনার জন্য স্বাক্ষরিত হলেও তার বদলে এনেছে হতাশা।

সমাবেশের শেষে সভাপতি অলিক মৃ উপস্থিত সকল সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং সমাবেশের পরে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি শাহবাগ থেকে টিএসসি ঘুরে অপরাজেয় বাংলা হয়ে কলা ভবন ঘুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে গিয়ে শেষ হয় ।

উক্ত মিছিল ও সমাবেশ থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি চন্দ্রিকা চাকমা আদিবাসী ছাত্র যুব সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে ৪দফা দাবিনামা উত্থাপন করেন। দাবিনামাসমূহ হল:

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।

২. পাহাড় থেকে অপারেশন উত্তোরণসহ অস্থায়ী সেনা ছাউনি প্রত্যাহার করতে হবে।

৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্খী ও তার সহযোগী অঙ্গ সংগঠনসমূহের কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

৪. আদিবাসী নারী ও শিশুদের প্রতি সকল প্রকার সহিংসতার বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।