পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রযন্ত্রের চাঁদাবাজি, ঘুষ ও দুর্নীতি বাণিজ্য–২

0
1118
ছবি: সরকারি উন্নয়নের নমুনা সেগুলো সরকারি অফিস ও কর্তৃপক্ষের চাঁদাবাজি, ঘুষ ও দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্র
                           উদয়ন তঞ্চঙ্গ্যা                            
পূর্ব প্রকাশের পর….

◐ উন্নয়ন কার্যক্রমে ঘুষ, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি:
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, তিন পাবত্য জেলা পরিষদ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর ইত্যাদি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট, দালানকোঠা ইত্যাদি অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রমে সাধারণত সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারকে ৩% হারে এবং সংশ্লিষ্ট অফিসে ৫% হারে মোট ৮% টাকা ঘুষ দিতে হয়। বলা যায়, উন্নয়ন কার্যক্রমে এটা হলো বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অনেকটা সরকারিভাবে স্বীকৃত সুনির্দিষ্ট চাঁদাবাজি।

২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক মোট ২১৮ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উক্ত টাকার ৮% হারে ঘুষ বা চাঁদা দিতে হলে কেবল উন্নয়ন বোর্ডের ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে কমপক্ষে ১৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার চাঁদাবাজি বা ঘুষের লেনদেন করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০১৮-১৯)-এ বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা উল্লেখ করেছেন যে, উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে উন্নয়ন সহায়তা কোড নং-২২১০০১১০০-এর আওতায় ২৯৬টি স্কিমের ৯৫.০০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন সহায়তা কোড নং-২২১০০০৯০০-এর আওতায় ৩১টি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের মোট ১২৩.৪৯ কোটি টাকা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তদনুসারে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক মোট ২১৮ কোটি ৪৯ লক্ষ টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উক্ত টাকার ৮% হারে ঘুষ বা চাঁদা দিতে হলে কেবল উন্নয়ন বোর্ডের ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে কমপক্ষে ১৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার চাঁদাবাজি বা ঘুষের লেনদেন করা হয়েছে।

অপরদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ২০১৮-২০১৯ অর্থ-বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার উন্নয়ন সহায়তা (প্রকল্প কোড নং-২২১০০১০০০)-এর আওতায় ২৬১টি প্রকল্পের১৩ কোটি টাকা এবং (প্রকল্প কোড নং-২২১০০০৯০০)-এর আওতায় ২৩০টি প্রকল্পের ৪৫.৬৫ কোটি টাকা সর্বমোট ৫৮.৬৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। যেহেতু তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে প্রায় সমান অর্থ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে, সেহেতু ২০১৮-২০১৯ অর্থ-বছরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সর্বসার্কুল্যে কমপক্ষে ১৭৬ কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উক্ত টাকার ৮% হারে ঘুষ বা চাঁদা দিতে হলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে কমপক্ষে ১৪ কোটি ৮ লক্ষ টাকার চাঁদাবাজি বা ঘুষের লেনদেন করা হয়েছে।

এছাড়া রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি অধিদপ্তরের মাধ্যমেও কয়েক শত কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম, যেখানে একইভাবে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারকে ৩% হারে এবং সংশ্লিষ্ট অফিসে ৫% হারে মোট ৮% টাকা ঘুষ দেয়া একেবারেই অত্যাবশ্যকীয় প্রদেয় নির্ধারিত রেইট। তদনুসারে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কেবল ঘুষ বাবদে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করা হয়েছে।

এছাড়া রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও টেন্ডারবাজি। নিম্ন মানের কাজ, নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে অবকাঠানো নির্মাণ, কাজ না করে অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি দুর্নীতি ও অনিয়ম পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে একটি ওপেন সিক্রেট বিষয়। এ ধরনের দুর্নীতির ফলে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অন্তত শত কোটি টাকার অনিয়ম হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে রাঙ্গামাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭১ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন প্রতিকৃতি ও ম্যুরাল নির্মাণ প্রকল্প।

উক্ত প্রকল্প বাবদে ২০০৯ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক ৮৭ লক্ষ টাকা বাজেট করা হলেও শিল্পী শরিফুল ইসলাম সবুজের সাথে তিনজন ঠিকাদারের ২৬ লক্ষ টাকার চুক্তি হয়। পরে সেই ৮৭ লক্ষ টাকার প্রকল্প বিভিন্ন সময়ে বাজেট বাড়িয়ে ইতিমধ্যে ৪ কোটি খরচ করা হয়। প্রকল্পের কাজ এখনো অনেক বাকি রয়েছে। আরো ৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। যমুনা টিভির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে রাঙ্গামাটি উপজেলা অফিসের উপ-সহকারি প্রকৌশলী এরশাদুল হক মল্ডল একাই ১০ লক্ষ হাতিয়ে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও ম্যুরাল নির্মাণকারী শিল্পী শরিফুল ইসলাম সবুজের মতে, স্থানীয় অদক্ষ লোক দিয়ে নি¤œ মানের রড ও সিমেন্ট দিয়ে প্রকল্পের ঠিকাদাররা নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছেন। দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে অনুসন্ধানের সময় যমুনা টিভির অনুসন্ধানকারী প্রতিবেদককে প্রকৌশলী এরশাদুল হক মল্ডল ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করতেও উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায়।

রাঙ্গামাটি সেনা ব্রিগেড ও ডিজিএফআইয়ের অফিসের সন্নিকটস্থ এই প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই একেবারেই নীরব। পার্বত্য চট্টগ্রামে এধরনের অসংখ্য দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন উচ্চবাচ্য না করে সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, স্থানীয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে প্রতিনিয়ত কামান দেগে চলেছেন। এখানে শাসক মহলের মূল উদ্দেশ্যই হলো চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে অপপ্রচার চালিয়ে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের ন্যায্য আন্দোলনকে ক্রিমিনালাইজড করা, পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে নিজেদের পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী অপকর্ম ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা করা, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের পথকে নস্যাৎ করে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা।

◐ চাকরি ও নিয়োগ বাণিজ্য:
বর্তমান সরকারের আমলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি পদে কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ ও দুর্নীতির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে একটি পদের বিপরীতে ১০ থেকে ১৪ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়ে থাকে। ২০১৫-১৬ সালে তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় হাজার খানেক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। প্রতিটি পদে গড়ে ১০ লক্ষ টাকা ধরলে এক হাজার পদের বরাতে ১০০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে যা শাসকশ্রেণির সাথে যুক্ত লোকদের পকেটে চলে যায়। জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে নিয়োগ পেতে কমপক্ষে ৫/৬ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এমনিতর অবস্থায় বর্তমান সরকারের আমলে তিন পার্বত্য জেলায় অর্থের অভাবে খেটে খাওয়া গরীব মানুষের পক্ষে সরকারি বা আধা-সরকারি চাকরি পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

◐ সেনা-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর চাঁদাবাজিতে পার্বত্যাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অংশ লাভ:
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রক্রিয়াকে ভুণ্ডুল করতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা; জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে ধ্বংস করা, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত ও হানাহানিতে মদদ দেয়ার হীন উদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইসহ শাসক মহল সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র গ্রুপকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে চলেছে। তার পেছনে সেনাবাহিনীর আরো উদ্দেশ্য হচ্ছে- সশস্ত্র গ্রুপের উপস্থিতি দেখিয়ে ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অজুহাতে পার্বত্যাঞ্চলে তাদের উপস্থিতিকে বৈধতা প্রদান করা, তথাকথিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারী গ্রেফতারের মাধ্যমে পদোন্নতি লাভ করা, সর্বোপরি তাদের মদদপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর চাঁদাবাজির ভাগ বসিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।

হয়রানির ভয়ে সরাসরি সেনাবাহিনীর কথা উল্লেখ করা না হলেও ১৩ জুলাই ২০২০ সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে তার কিছুটা ইঙ্গিত মেলে। উক্ত সংবাদে বলা হয় যে, “ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের পেছনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ইন্ধন রয়েছে। অন্তর্কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি বিষয়টি মিডিয়ার সামনে এনে ঘটনার প্রকৃত কারণ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন না করার যুক্তি তৈরির জন্যই এসব সংঘাতের সৃষ্টি করা হয়।”

গত এপ্রিল-মে মাসে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা এসকর্ট দিয়ে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে খাগড়াছড়ি থেকে বরকলের সুবলঙে, রাঙ্গামাটির জীবতলীতে, দীঘিনালার বাবুছড়ায়, বান্দরবানের বাঘমারায় পৌঁছে দেয়। বান্দরবানের বাঘমারায় ৭ খুনের ঘটনার পর ৯ জুলাই ২০২০ দৈনিক পূর্বকোণের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে,“প্রভাবশালী একটি পক্ষ সংস্কারপন্থী গ্রুপটিকে বান্দরবানে তাদের তৎপরতা চালাতে সহায়তা করে।” সেনাবাহিনী সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে সেসব জায়গায় নিয়ে তাদেরকে অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে সুযোগ করে দেয়।

গত ৩ জুলাই ২০২০ সুবলং বাজার সেনা ক্যাম্প ও বালুখালির রাজমনি পাড়া সেনা ক্যাম্পের এক যৌথ সেনাদল রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বালুখালির কাইন্দা এলাকায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালে এক বৌদ্ধ বিহার ঘেরাও করে। সেসময় সেনা দলের কম্যান্ডার মো: সোলেমান এক গ্রামবাসীকে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জিজ্ঞেস করেন যে, ‘জেএসএসের সন্ত্রাসীদের চাঁদা দেয়া হয় কিনা?’ সেনা কম্যান্ডারের জবাবে উক্ত গ্রামবাসী বলেন, ‘হ্যাঁ দেয়া হয়েছে, সুবলং বাজরে সংস্কারপন্থীদের কাছে চাঁদা দেয়া হয়েছে। সেটা তো আপনারা জানেন। কাইন্দ্যা এলাকায় সকল গ্রামগুলো থেকে দেড় লক্ষ টাকা চাঁদা প্রদানের জন্য ফোনে সুবলং বাজারে অবস্থানরত সংস্কারপন্থী কম্যান্ডার পূর্ণাঙ্গ চাকমা নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে অনুসারে জুন মাসের শেষের দিকে সংস্কারপন্থী কম্যান্ডার আর্তিক চাকমা কাছে নগদ ৭২,৫০০ টাকা দেয়া হয়েছে।’

এরপর সেনা কম্যান্ডার কিছু না বলে, আারেক তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীকে জিজ্ঞেস করলে উক্ত তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসী বলেন যে, “স্যার, আপনারা সন্ত্রাসী খুঁজেন, চাঁদাবাজদের খুঁজেন? সুবলং বাজারে আপনাদের সামনে সংস্কারপন্থীরা নিরীহ জনগণের কাছ থেকে দিন দুপুরে যত্রতত্র চাঁদা উশুল করে থাকে। অন্যদিকে সংস্কারপন্থীরা জীবতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পাড়ায় নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে প্রতিদিন চাঁদা উশুল করে থাকে। তাদেরকেপ্রতিবোটে দুই হাজার করে দিতে হয়। সেগুলি কি সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির আওতায় পড়ে না?” এরপর উক্ত কম্যান্ডার কোন জবাব দেননি।

সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপের উত্তোলিত চাঁদাবাজির অর্থ সেনাবাহিনীর স্থানীয়ক্যাম্প থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে যে, সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপের উত্তোলিত চাঁদাবাজির অর্থ সেনাবাহিনীর স্থানীয়ক্যাম্প থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে।

◐ ক্ষমতাসীন নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি ও সম্পদের পাহাড়:
তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নজীরবিহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, টেণ্ডারবাজির মহোৎসব চলছে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। তার কিছু কিছু সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি, টেণ্ডারবাজির খবরও সময়ে সময়ে পত্রিকায় চলে আসে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ফুলে-ফেঁপে সম্পদ গড়ে তোলা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ ঘটনার কতিপয় সংবাদ নিম্নে দেয়া গেল-

গত ১২ জানুয়ারি ২০১৯ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত “আয় ও সম্পদ বেড়েছে বীর বাহাদুরের” শীর্ষক সংবাদে জানা যায় যে, “গত নির্বাচনের আগে রাবার ব্যবসা থেকে বান্দরবানের এই এমপির বার্ষিক আয় ছিল ৪৫ লাখ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এবার তার আয় বেড়েছে চারগুণ। বেড়েছে আয়ের উৎসও। বর্তমানে তার বার্ষিক আয় এক কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা।… ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তার ব্যাংকে ছিল এক কোটি ৩৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, এখন রয়েছে চার কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার টাকা।” এটা তো কেবল নির্বাচনী হলফনামায় দেখানো আনুষ্ঠানিক সম্পদের হিসাব। বীর বাহাদুরের অদৃশ্যমান আরো কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে অনেকের ধারণা।

৫ ডিসেম্বর ২০১৮ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত “বীর বাহাদুরের স্ত্রীর বাহাদুরি” শীর্ষক সংবাদে বলা হয় যে, “বৃহত্তর চট্টগ্রামের চার মন্ত্রীর মধ্যে সম্পত্তি এবং আয়ে অন্য সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এবং তাঁর স্ত্রী। ১০ বছরের ব্যবধানে বান্দরবানের এই সাংসদের আয় বেড়েছে ৯ গুণ, সম্পত্তি বেড়েছে ১৪ গুণ। তবে এই দুই ক্ষেত্রেই তাঁকে পেছনে ফেলেছেন স্ত্রী মেহ্লা প্রুর। তাঁর সম্পত্তি (স্থাবর ও অস্থাবর) ৭৫ গুণ এবং আয় বেড়েছে ৯৩ গুণ।”

২০ ডিসেম্বর ২০১৩ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত “ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সম্পদ” শীর্ষক সংবাদে বলা হয় যে, ‘২০০৮ সালে দীপংকর তালুকদারের অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ছিল মাত্র সাত লাখ ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু ২০১৩ সালে তার অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য দুই কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রীর নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ৪৯ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে তাঁর স্ত্রীর সম্পদের মূল্য ৬০ লাখ টাকার বেশি।’

২৯ জানুয়ারি ২০২০ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত “রাঙ্গামাটিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ মুখোমুখি” সংবাদে বলা হয়েছে যে, প্রকাশ্য কোন্দলে জড়িয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন রাঙ্গামাটি জেলা ছাত্রলীগ। মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে, পরস্পরবিরোধী দুই গ্রুপ। অবৈধ দখল ও টেন্ডারবাজি ঘিরে জেলা নেতাকর্মীরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন বলে জানা গেছে।” এমনকি এক সময় রাঙ্গামাটিতে পুলিশের হেফাজত থেকে আসামী কেড়ে নিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে ছাত্রলীগকে দেখা গেছে।

সিএইচটিটুডে.কম-এর ১৯ এপ্রিল ২০১৮ প্রতিবেদনে ‘তক্ষক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় যুবলীগ নেতা মোশারফ খুন হয়েছে’ বলে জানা গেছে। অপরদিকে ৫ এপ্রিল ২০১৪ বাংলানিউজ২৪.কমের রিপোর্টে বলা হয় যে, ফারুকের আমন্ত্রণে নান্টু আলী নামে এক সেনা সদস্য ২৯ মার্চ ২০১৪ শ্যামলী পরিবহনের একটি নৈশকোচে করে রামগড় বেড়াতে আসলে ফারুকসহ রামগড় উপজেলা ও পৌর যুবলীগের আরো নয়জন তাকে আটক করে পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। পরে ১ এপ্রিল পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে রামগড়ের ‘বনবীথি’ নামক বাগান থেকে নান্টুকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিন যুবলীগ নেতাসহ ৯ জনকে আটক করা হয়।

উপরোক্ত কতিপয় ঘটনাই প্রমাণ করে তিন পার্বত্য জেলার ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে কিভাবে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, টেণ্ডারবাজির মাধ্যমে উন্নয়নের অর্থ লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব মুসলিম সেটেলারদের মদদ দিয়ে জুম্মদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি, পর্যটন ও রাবার প্লান্টেশনের নামে জুম্মদের জায়গা-জমি দখল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা ইত্যাদি তৎপরতা লিপ্ত রয়েছে।

তথাকথিত উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি নয়; শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ, চাঁদাবাজি ও দুর্বৃত্তায়নই হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলার অন্যতম প্রধান সমস্যা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সহায়ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।

◐ উপসংহার:
এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সরকারি অফিস ও ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতা অপব্যবহারের স্বর্গরাজ্যে ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের উপর অব্যাহতভাবে চলমান সেনাশাসন ও দমন-পীড়নসহ নজীরবিহীন ঘুষ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে।

পক্ষান্তরে জাতি-বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জনসংহতি সমিতিসহ জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে আন্দোলনরত সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ও তিলকে তাল করে ‘চাঁদাবাজ’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যায়িত করে সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে আজ রাষ্ট্রীয় বাহিনী তথা সরকার জুম্ম জনগণের উপর এক তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর অস্তিত্ব ও পরিবেশ-বিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। তাই এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, তথাকথিত উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি নয়; শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ, চাঁদাবাজি ও দুর্বৃত্তায়নই হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলার অন্যতম প্রধান সমস্যা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সহায়ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।