ঢাকায় জাতীয় আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের সম্মেলন ২০২৩ অনুষ্ঠিত

0
364

হিল ভয়েস, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ঢাকা : আজ ১২ ই ডিসেম্বর ২০২৩ রোজ মঙ্গলবার ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে কাপেং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘‘আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের সম্মেলন ২০২৩’’ অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ, বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২৬০ জন আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মী অংশগ্রহন করেন। সারাদিন ব্যাপী এ সম্মেলন কয়েকটি অধিবেশনে বিভক্ত ছিল।

সম্মেলনের উদ্বোধনী সেশনে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল। এতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আচিক-মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং ।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানটি কাপেং ফাউন্ডেশনের সভাপতি মি. রবীন্দ্রনাথ সরেন এর সভাপতিত্বে এবং হিরন মিত্র চাকমা ও হ্লাম্রাচিং চৌধুরী রনি সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। এখানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইপিএইচআরডি নেটওয়ার্কের সহকারী সমন্বয়কারী হেলেনা তালাং।

প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে ফিলিমন বাস্কে এই অনুষ্ঠানের উদ্ভোধন করেন। তিনি বলেন আমরা প্রতিনিয়ত হারাচ্ছি আমাদের ভিটামাটি, আমাদের মা বোনদের সম্ভ্রম। আমরা একসাথে বলি আমাদের রক্ত বৃথা যাবে না। বাগদা ফার্মের দুই শহীদের হত্যার এখনো বিচার হয়নি। আমাদের প্রতিনিয়ত মিথ্যা মামলার দায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আপনারা সবাই এক হোন, পাহাড় সমতল মিলে রুখে দাড়ান, মানবাধিকার কর্মীদের সহয়তা করুন। এই অনুষ্ঠানের সফলতা কামনা করে বক্তব্য শেষ করেন।

মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশ এর সাবেক উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন- আজকে আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছি তা সবাই বলেছেন। মানবাধিকারের সুরক্ষা রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। সারা বিশ্বে মানবাধিকার কর্মীরা নানারকম হেনেস্থার মধ্যে যেতে হয়। আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের পরিস্থিতি আরো করুণ অবস্থা। বিভিন্ন নির্যাতনের, মিথ্যা মামলার মধ্যে থাকতে হয়। মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীরা সব সময় আতঙ্কে থাকে। যদি আমরা সংবিধান মানি তাহলে কেন মানবাধিকার নিয়ে ভাবতে হবে? কেন মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হবে? রাষ্ট্র নানা ভাবে মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের হেনেস্থার মধ্যে রাখতেছে। শুধু রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছে তারাও আমাদের বিভিন্ন হেনেস্থার মধ্যে রাখতেছে। তরুণ বন্ধুদের ধৈর্য্য না হারানোর জন্য বলেন।

জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান বলেন- মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য যারা কাজ করবে তারাই মানবাধিকার কর্মী। বিশ্বে নারী ও শিশুরা বেশি মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়। আদিবাসী বিষয়ক রির্পোটে বাংলাদেশের দুটি বিশেষ ঘটনার কথা বলেন। আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়েও কথা বলেন, সরকার যাই বলুক না কেন বাংলাদেশের যারা আত্ম পরিচয়ে আদিবাসী বললে তারা আদিবাসী। জাতিসংঘ আদিবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন বলেন। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন যেন পরিবেশ ধ্বংস না হয় তার দিকে খেয়াল রেখে কাজ করতে হবে এবং পরবর্তী ৯ম পঞ্চবার্ষকী পরিকল্পনায় আদিবাসীদের বিষয় উল্লেখ রাখতে সরকারকে বলেন।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন- আমরা যারা সংখ্যালুঘু আদিবাসী আছি কঠিন সময়ে দাড়িয়ে আছি এবং আদিবাসীদের জন্য আরো কঠিন সময়। রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য আদিবাসীরা কঠিন সময়ের মধ্যে যেতে হয়। একটি দেশ কতটুকু সভ্য হয় তা বুঝা যায় সে দেশের সংখ্যালুঘু জাতিগোষ্ঠীরা কেমন আছেন তা থেকে। পৃথিবীর কোথাও কোনো আদিবাসীদের উপর নির্যাতন করা যাবে না। তরুণ বন্ধুদের এই পরিস্থিতে কি করবেন তা নিজেদের ভাবতে হবে তরুণ বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলেন। আদিবাসীদের এই পরিস্থিতে জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় আদিবাসী সুরক্ষা কমিশন হোক। একটা ভূমি কমিশন হোক।

আদিবাসীদের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে পল্লব চাকমা বলেন- যারা ভূমি, বন রক্ষার জন্য কাজ করেন তাদের কাজে বাধা প্রদান করা হচ্ছে। নানা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন আদিবাসীদের উপর সকল প্রকার নিপীড়ণ বন্ধে একটি আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশনসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরো বলেন মানবাধিকার লংঘনের সবচেয়ে বেশি ঘটনা পার্বত্য এলাকায় ঘটছে। আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের মানবাধিকার নিশ্চিত হয় তার জন্য সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান।

আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং বলেন- যেখানে আদিবাসী আছে সেখানেই মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে। আমরা আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে যাব এবং প্রতিজ্ঞা করেন।

কাপেং ফাউন্ডেশনের সভাপতি মি. রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন যারা আদিবাসীদের ধ্বংস করতে চাই তাদের বিরুদ্ধে ফিলিমন বাস্কে কাজ করেছেন। তিনি এখন বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত এবং জীবন সংকটে আছেন। তিনি আরো বলেন আদিবাসীদের ভূমি বেদখল হয়ে গেছে। আদিবাসী নারী শিশুরা ধর্ষন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আদিবাসীদের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দিতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

বাংলাদেশে আদিবাসীদের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন বিআইডব্লিউএন-এর কো-অর্ডিনেটর ফাগুনী ত্রিপুরা। এবং সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সহ-সভাপতি বিচিত্রা তির্কী, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য জনক দেববার্মা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কক্সবাজার শাখার সাধারন সম্পাদক মংথেহ্লা রাখাইন , ভারত প্রথ্যাগত জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতি সাধারন সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বুকুল, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ প্রমুখ।

তৃতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন হেলেনা তালাং । সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী সাইয়িদ আহম্মেদ, সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক-এর সাধারন সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা, আইপিএইচআরডি নেটওয়ার্কের সদস্য জন ত্রিপুরা প্রমুখ।

সাইয়িদ আহম্মেদ বলেন আমাদের চ্যালেঞ্জ এর মধ্যে নিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে। এই নিরাপত্তা কারা দিবে? যারা নিরাপত্তা দিবে তারাই তো আমাদের বিপরীত পক্ষ। আমরা যাদের কাছে সুরক্ষা আশা করি তারাই আমাদের বিপক্ষ। জাতিসংঘ মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের সুরক্ষার কথা বলে। ১৯৫৮ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কর্মীদের জন্য একটি ঘোষনা দেয়। যে কেউ মানবাধিকার কর্মী হতে পারেন যদি তিনি মানবাধিকারের সপক্ষে কাজ করেন। মানবাধিকারের সমস্ত ইস্যুকে সম্মান করতে হবে। একজন স্পেশাল রিপোটিয়ার আছে তিনি শুধু মানবাধিকার বিষয় নিয়ে কাজ করে। আমাদের একে অন্যের হাত ধরে একত্রে চলতে হবে।

সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক-এর সাধারন সম্পাদক শান্তি বিজয় চাকমা বলেন মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীরা কি অবস্থায় আছে তা সবাই জানেন। আমাদের এখন সীমিত সুরেই কথা বলতে হয়। আমাদের মিথ্যা মামলা নিয়ে কাজ করা দরকার। বিভিন্ন হুমকির মাধ্যমে কাজ করে যেতে হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা দরকার।

ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের খুব নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হয়। আপনি অবশ্যই সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন কিন্তু সতর্কতার সাথে ব্যবহার করবেন। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে যেখানেই ধর্ষনের ঘটনা ঘটুক সে এলাকায় ভেক্টিম উপস্থিত থাকলে অবশ্যই মামলা নিতে হবে। এম এন লারমা ও কল্পনা চাকমা আমাদের লড়াই সংগ্রাম করতে শিখিয়েছেন। আদিবাসীদের এলাকায় সংগঠন করা দরকার। সংগঠনের মাধ্যমে ঐক্যতা থাকা যায়।

সমাপনি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অজয় মৃ এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমি, দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার পার্থ শংকর সাহা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম-এর সহ-সাধারন সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো প্রমুখ।

শাহনাজ সুমি বলেন বাংলাদেশের যেকোনো মানুষ যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার তাদের নিয়ে কাজ করি। ২৬ বছর হয়ে গেল আমাদের পার্বত্য চুক্তি কিন্তু এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারকে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।

পার্থ শংকর সাহা বলেন -আমরা যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করব তখন মনে রাখতে হবে অনুসন্ধানি মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। মানবাধিকারের নিয়ে স্পষ্ট ধারনা থাকা, কারিগুরি জ্ঞান থাকতে হবে। তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে জানতে হবে। এখন আমরা কি শুধু হতাশা নিয়ে থাকব? আমাদের উন্নয়নের বিভিন্ন দিক আছে সেগুলো বের করতে হবে। মানবাধিকার কর্মীদের চিন্তার কেন্দ্রকে বড় করতে হবে। মানুষ হিসেবে পিছিয়ে থাকার অনেক দিক আছে কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার দিকও আছে। আমাদের টিকের থাকার লড়াই করতে হবে।

সভাপতি অজয় মৃ বলেন আমরা যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করি তখন বিভিন্ন হেনেস্থার মধ্যে যেতে হবে। যুবদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান করেন। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

সর্বশেষ সম্মেলন ২০২৩-এর ঘোষনাপত্র পাঠ করেন পল্লব চাকমা এবং আইপিএইচআরডি নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী কমিটি ঘোষণা করেন হিরন মিত্র চাকমা।

সম্মেলনের অন্যান্য অধিবেশনে উপস্থিত আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীরা তাদের নিরাপত্তাসহ আদিবাসীদের মানবাধিকার বিষয়ে সজাগ ও কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা বাংলাদেশে এসডিজি’র বাস্তবায়ন ও জাতীয় নীতিমালা গুলোতে আদিবাসী জাতিসত্ত্বার অধিকার বিষয়ে সরকারের যে অঙ্গীকার তার বাস্তব প্রতিফলন চান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আদিবাসী বক্তারা তাদের স্ব স্ব এলাকার মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এছাড়াও সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে সারাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়-২০২২ সালেই ২৬৭ জনের মত আদিবাসী মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্বীকার হয়েছে। গত বছরে প্রায় ২১টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, এতে প্রায় ২২জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা ও অপহরণের শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উপর ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যা ; ২০১৭ সালের জুনে সংঘটিত রাঙ্গামাটির লংগদু হত্যা ও সাম্প্রদায়িক হামলা এবং ১৯ আগস্ট ২০২২ সালে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মুন্ডা আদিবাসী গ্রামে অতর্কিত হামলা ও ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ হত্যার এখনো কোনো বিচার না হওয়ায় নিন্দা জানানো হয়।

সম্মেলনে বক্তারা আরো বলেন- স্বাধীনতার ৫২ বছরেও দেশের ৪০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। দেশে আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি এতোটাই করুণ যে, আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি দখল, উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা অনবরত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার ৭ম ও ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র, আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ ও ১৬৯ আদিবাসীদের যে অধিকার সে বিষয়ে সরকার নিরব ও নির্বিকার।

এ সম্মেলনে আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীরা আদিবাসীদের মানবাধিকার সুরক্ষা, সম্মান ও প্রতিষ্ঠার জন্য নিম্নলিখিত দাবিসমূহ উত্থাপন করেন-

১. আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে তাদের আত্মপরিচয়, মর্যাদা ও মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
২. জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করতে হবে।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত, যথাযথ ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য একটি সময় সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন কার্যকর করতে হবে।
৪. সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে ।
৫. আদিবাসীদের উপর সকল প্রকার নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি আদিবাসী অধিকার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৬. আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং আদিবাসী নারী, শিশু ও জনগণের প্রতি সকল ধরণের সহিংসতামূলক কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
৭. সকল ধরণের সহিংসতায় শিকার আদিবাসী ভিকটিমের জন্য আইনি সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের দ্রুত ও ন্যায় বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দিতে হবে।
৮. স্থানীয় আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ব্যতীত তাদের প্রথাগত ভূমি থেকে জোর পূর্বক উচ্ছেদ এবং সংরক্ষিত বন, সামরিক-আধা সামরিক ঘাঁটি, ন্যাশনাল ইকোপার্ক, পর্যটন কমপ্লেক্স, উন্নয়ন প্রকল্প ও সরকারি স্থাপনার নামে যে কোন ধরনের ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ করতে হবে।
৯. টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রমের সাথে নারীসহ আদিবাসীদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
১০. সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য মন্ত্রণালয় ভিত্তিক বা খাতভিত্তিক পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে এবং বরাদ্দের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার সাথে আদিবাসীদের সরাসরি সম্পৃক্ত করতে হবে।
১১. আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১২. আদিবাসী মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে অযথা হয়রানি, মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা বন্ধ করতে হবে।
১৩. আদিবাসী মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে এবং যেসব আদিবাসী মানিবাধিকার সুরক্ষাকর্মীগণ নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছেন তাদেরকে সহায়তা প্রদান করতে হবে। যেমন-
(ক) অস্থায়ী স্থানান্তর; (খ) আইনি সহায়তা; (গ) নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা; (ঘ) পরিবারের সদস্যদের পাশে থাকা ও (ঙ) বস্তুগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা ইত্যাদি।