ড. আর এস দেওয়ানের মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় শোকের ছায়া

0
1211
ছবিতে ড. আর এস দেওয়ান

৬ জুলাই ২০২১, হিল ভয়েস, বার্তা ডেস্ক: ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান এখন আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি দুই মাস আগে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টার শহরের নিজ এ্যাপার্টমেন্টে বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ৮৯ বছর বয়সে মারা যান। ড. আর এস দেওয়ান ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র। তিনি ছিলেন একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, মানবাধিকার সুরক্ষা কর্মী ও সংগ্রামী মানুষ। তিনি ছিলেন জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারকার্যের অন্যতম পুরোধা।

নিপীড়িত-নির্যাতিত ও অধিকারকামী জুম্ম জনগণের মধ্যে ড. দেওয়ানের মতো এমন একজন ত্যাগী, দৃঢ়চেতা ও আপোষহীন সংগ্রামী ব্যক্তির মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা শোক প্রকাশ করেছেন। কিছু নেটিজেনের মন্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো-

বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব শক্তিপদ ত্রিপুরা লিখেছেন, “ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একজন নিবেদিত প্রাণ। তিনি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জন্য সমস্ত যৌবন-জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন মাতৃভূমি, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের মায়া। তিনি জ্ম্মু জনগণের প্রিয় নেতা এম এন লারমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাতৃভূমির সকল মায়া ত্যাগ করে জুম্ম জনগণের আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণার কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান এবং বৃটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করে জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র হয়ে আন্দোলনের পক্ষে সারা পৃথিবীতে প্রচারণার কাজ শুরু করেন।”

শক্তিপদ আরো লেখেন, “তিনি নীরবে-নিভৃতে, নিরলসভাবে আজীবন-আমৃত্যু জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচারণার কাজ চালিয়ে গেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি ও সমর্থনলাভের পেছনে রয়েছে শ্রী দেওয়ানের অনন্য অবদান। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য শ্রী দেওয়ান জ্ম্মু জনগণের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”

আমেরিকা প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. মংসানু মারমা বাথোয়াই লিখেছেন, “এই হিরোকে তরুণদের অনেকেই চিনবেন না। সবার আঁড়ালে থাকা এই হিরো নীরবে মহাপ্রস্থান করলেন। তাঁর মতো পাহাড়ে আর একজনও ছিল না।”

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার কর্মী চন্দ্রা কালিন্দী রায় এক মন্তব্যে লেখেন, “রামেন্দু বাবু যেন পরলোকে শান্তি পান” তার কামনা করেছেন। তিনি আরো লিখেছেন, “তিনি আমাদের জাতির জন্য সবকিছু দিয়েছেন। এটা আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।”

ডা: বাবুল কান্তি চাকমা তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, “তিনি নেই শুনে খুব খারাপ লাগলো। আর তাঁর প্রয়াণে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।” তার বাবা ড. আর এস দেওয়ানের সহপাঠি ছিলেন এবং একসাথে ১৯৫২ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে মেট্রিক পাশ করেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। ড. দেওয়ানের সাথে তার কয়েকদিন কাটানোর সুযোগ হয়েছিল বলে

ডা. বাবুল তার মন্তব্যে উল্লেখ করেন। তিনি আরো লিখেন, তাঁর সাথে কয়েকদিন থেকে তাঁর জাতিপ্রেম দেখে তিনি খুবই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। জুম্ম জাতি তাঁর অবদান কোনদিন ভুলবে না। পরিশেষে তিনি তাকে সহস্র সালাম জানান।

কানাডা প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী ও হিল ভয়েসের নির্বাহী সম্পাদক চাঙমা পিবি বলেন, “যুক্তরাজ্য প্রবাসী যিনি জাতির জন্য নিবেদিত প্রাণ সেই ড. আর এস দেওয়ানের মৃত্যু খুবই শোকাবহ। যেহেতু তিনি একা বাস করেন, তাই তিনি কখন মারা গেছেন কেউ সঠিকভাবে জানা যায়নি। আমরা তাঁর মুত্যুতে শোকাহত। তাঁর মহান অবদান ও ত্যাগের প্রতি জানাই সালাম।”

চাঙমা পিবির স্ট্যাটাসে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা দিলীপ কর্মকার ড. আর এস দেওয়ানের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা ব্যক্ত করেন।

কানাডা প্রবাসী অজয় ত্রিপুরাও তার মন্তব্যে তাঁর অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শোক প্রকাশ করেন।

সঞ্জয় ধর নামে একজন ব্যক্তি তাঁর মন্তব্যে ড. দেওয়ানের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।

ডা. পরশ খীসাও তাঁর মন্তব্যে লিখেন, “একটা যুগ শেষ হলো। ড. দেওয়ান সম্পর্কে তিনি তাঁর মা থেকে শুনেছেন। তিনি তার মায়ের ভাই সম্পর্ক হন। কিন্তু তিনি কখনোই তাঁকে দেখেননি” বলে জানান।

চাকমা বিপিন রবিদাস তাঁর মন্তব্যে “ড. দেওয়ানের মৃত্যুতে জুম্ম জাতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে” বলে জানান।

অরুণ চাকমা (মুকুল) তাঁর মন্তব্যে বলেন, “ড. দেওয়ানের অবদান অনস্বীকার্য, পূরণ হবার নয়।” তিনি বিনম্র চিত্তে প্রয়াতের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

বোধিপ্রিয় চাকমা নামে একজন তার মন্তব্যে বলেন, “ড. দেওয়ানের মহান কর্ম জুম্ম জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা লিখেছেন, “জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তোমার আজীবন ত্যাগ ও অবদান হৃদয়ের সবটুকু বিপ্লবের উত্তাপ দিয়ে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।”

কৃষ্ণ চাকমা নামে এক ব্যাক্তি লিখেছেন, “জুম্ম জাতি তথা পার্বত্যবাসী এক অভিভাবককে হারালো। তাঁর শূন্য স্থান কোনদিন পূরণ হবার নয়। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।”

ত্রিদিব দেওয়ান লিখেছেন “জুম্ম জাতির অধিকারের জন্য নিবেদিত কর্মী ছিলেন। আর এস দেওয়ান স্নেহ কুমার, ভাগ্যচন্দ্রকে জুম্মজাতি কখনো ভুলতে পারবে না।”

উচিংনু তালুকদার লিখেছেন, “জুম্ম সমাজের একজন রত্ন অভিভাবককে হারালো, যা অপূরণীয় ক্ষতি হলো।”

কেএম তপন চাকমা লিখেছেন, “জুম্ম জাতির উজ্জ্বল নক্ষত্র… তোমার ঋণ হতভাগা জুম্মরা কখনো শোধ করতে পারবে না…।”

প্রবীর চাকমা লিখেছেন, “জাতির উজ্জ্বল নক্ষত্র জুম্ম জাতি তোমায় ভবিষ্যতে স্মরণ করবে।”

অচিন্ত বিকাশ চাকমা নামে একজন লিখেছেন, “এমন প্রতিভাবান জুম্ম নেতা হারানো সত্যিই খুবই দুঃখজক ব্যাপার! জুম্ম জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। পরিশেষে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। সাথে তাঁর শোকসন্তপ্ত আত্মীয়বর্গের সমবেদনা জানাচ্ছি।”

বিশ্বরূপ চাকমা লিখেছেন, “আদিবাসী জুম্ম জাতির আকাশ থেকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন।”

জে চাকমা নামে একজন লিখেছেন, “জুম্ম জাতি আরেক বিশ্বস্ত ও ত্যাগী অবিভাবককে হারালো।”

জুম্ম ইন্ডিজিনাস উত্তম লিখেছেন, “আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সুগভীর ভালোবাসাসহ শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা।”

বসন্ত চাকমা লিখেছেন, “স্যারকে বিনম্র শ্রদ্ধা। স্যারের প্রয়াণে গভীরভাবে শোকাহত। তিনি জুম্ম জাতির নক্ষত্র।”

প্রিন্স চাকমা লিখেছেন, “স্যারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি।”

ধর্মজ্যোতি নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন, “জুম্মো জাতির প্রথম সারির অগ্রদূত, এ জাতি কোনো দিন ভুলবে না। শত শ্রদ্ধা জানাই।”

জুম্ম আরি নামে একজন ব্যক্তি লিখেছেন, “একটা জাতে জ্ঞানী ও বিদ্বান লোকের জন্ম হয় বটে, কিন্তু নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, জাতপ্রেমিক ও বিপ্লবী নেতার জন্মটা জাতের ভাগ্যে দুর্লভ। ড. আর এস দেওয়ান জুম্ম জতির একজন জ্ঞানী, বিদ্বান, দেশ ও জাত প্রেমিক শুধুই নন, তিনি একজন আপোষহীন বিপ্লবী ছিলেন। জুম্ম জাতি মুক্তির আন্দোলনে নিজেকে সদা ব্যাপৃত রেখেছিলেন। তাঁর মহাপ্রয়াণে জুম্ম জাতির এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। আমি তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি ও তাঁর বিদেহী আত্মার সৎ গতি কামনা করছি এবং তাঁর শোকাহত আত্মীয়বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।”

তুঙোবী চাকমা লিখেছেন, “এনাদের মতো বিজ্ঞ ব্যক্তি যেন আরো পাহাড়ীর ঘরে জন্ম নেয় এমন প্রত্যাশা করছি।”

জুয়েল চাকমা লিখেছেন, “বিনম্র শ্রদ্ধা, জুম্ম জাতি একটি নক্ষত্র হারালো আজ আমরা তাকে জানাই আমার পক্ষ থেকে লাল সালাম”

নবশীষ চাকমা লিখেছেন, “জাতির ক্রান্তিলগ্নে তাঁর মতন মহান ব্যক্তির শূণ্যতা সত্যিই পূরণ হবার নয়। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার পারলৌকিক সদ্গতি কামনা করছি। শেষান্তে লাল সালাম হে বীর!”

পহর চাকমা লিখেছেন, “জুম্মরা তাঁর অবদান আজীবন স্মরণ করবে। গভীর শ্রদ্ধা, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি!”

বিজয়গিরি লিখেছেন, “বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁর এই আত্মত্যাগ জুম্ম জাতির বুকে বেঁচে থাকুক আজীবন।”

ধনপ্রিয় চাকমা লিখেছেন, “উনার মহাপ্রয়াণ হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে , দুর্দিনে, দুঃসময়ে মহৎ জাতীয়তাবাদী চেতনাসম্পন্ন ও ঘুনেধরা, পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর, অবহেলিত, অসহায়, অধিকার হারা জুম্ম জাতির মহাকাশে এক আলোক বর্তিকা স্বরূপ ধ্রুবতারার পতনে সমগ্র জুম্ম জাতি শোকাহত। স্বার্থ সর্বস্ব পুঁজিবাদী যুগে সংকীর্ণমনা, প্রতিক্রিয়াশীল, লেজুরবৃত্তির রোষাণলে দগ্ধ আজ জুম্ম সমাজ। ছন্নছাড়া, গতিহীন, দিশেহারা আজ জুম্ম জাতি তথা অধিকার আদায়ের সংগ্রামের গতিধারা….। জাতির এ দুঃসময়ে এ ধরনের অধিকার প্রেমী উচ্চ মাপের নেতৃত্বের বড় প্রয়োজন।”

প্রভাত চাকমা লিখেছেন, “উনার শুন্যস্থান পূরণ হবার নয়, জুম্ম জাতি নিয়ে যে কয়জন ব্যক্তি চিন্তা করতেন, কথা বলতেন ড. শেখর ছিলেন তার অন্যতম। বলতে হবে জাতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হলো।”

ইংগলোন চাকমা লিখেছেন, “আমি দিল্লীতে ১৯৮৩ সালে তাঁর নাম ও খ্যাতি শুনেছি। আজ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিকৃতি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের এরকম প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের মৃত্যু সত্যিই দু:খজনক, বিশাল ক্ষতিও।”

দিল্লী থেকে সুহাস চাকমা লিখেছেন, “ড. আর এস দেওয়ান – এক মানুষ যিনি শুধুমাত্র তাঁর জনগোষ্ঠীর জন্য তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। গতকাল যুক্তরাজ্যে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যুর খবর শুনে আমি সত্যি চরমভাবে বিমর্ষ। তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল হামবুর্গে ১৯৯১ সালে। তিনি ছিলেন চমৎকার এক মানুষ এবং সত্যিকারের ভদ্রলোক। ড. দেওয়ানই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর উপর মানবাধিকার লংঘনের বিষয়সমূহ ১৯৮২ সাল হতে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপ সহ আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে আসেন। অন্য সকলের আগেই তিনি ছিলেন সেখানে। একসময় এক অর্থে তিনিই ছিলেন ওয়ার্কিং গ্রুপে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে এশিয়ার আদিবাসী জাতিসমূহের আলোকবর্তিকা, যখন এশিয়ার অধিকাংশ সরকার কেবলমাত্র পশ্চিমের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে এশিয়ায় আদিবাসী জাতিসমূহের অস্তিত্বকে অস্বীকার করত। ১৯৮০ দশকের শেষভাগ ও ১৯৯০ দশক হতে এশিয়া থেকে ব্যাপক সংখ্যক আদিবাসী নেতা তাদের দুর্দশা তুলে ধরতে জাতিসংঘের সভাগুলিতে যোগদান শুরু করার পূর্বে তিনিই ছিলেন সেখানে অনেক কিছু।”

সুহাস চাকমা আরো লিখেছেন, “পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম তাঁর, পিএইচডি সমাপ্ত করেন যুক্তরাজ্যে। তিনি যুক্তরাজ্যে কোনো চাকরিতে মন:স্থির করেননি, কিন্তু কেবল তাঁর জনগোষ্ঠী – আদিবাসী জুম্ম জাতিসমূহের জন্য কাজ চালিয়ে যান। কয়েক দশক ধরে, তিনি আদিবাসী জুম্ম জাতিসমূহের পরিস্থিতি সম্পর্কে নৃতত্ত্ববিদ, মানবাধিকার সংগঠন, সংসদ সদস্য, বিদেশী সরকার ইত্যাদিকে অবহিত করেছেন। তিনি নিজেই নিজ হাতে প্রত্যেকটি চিঠি টাইপ করতেন। তাঁর কাজে তিনি অর্থ পেতেন না – তিনি তাঁর নিজের টাকা, যেমন একজন নাগরিক হিসেবে যুক্তরাজ্যের সরকার থেকে পাওয়া সামাজিক সহায়তা, খরচ করতেন।”

মি. চাকমা যোগ করেন যে, “তিনি অক্ষরে অক্ষরে একজন সন্ত/ঋষির জীবন পরিচালিত করেন – যা বিশ্বাস করতেন তার প্রতি উৎসর্গিত ছিলেন এবং তিনি যা উপার্জন করেন বা তাকে যা দেওয়া হতো তার সবকিছু একজন ব্যাচেলর হিসেবে কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য তিনি ব্যয় করতেন এবং বাকী অংশ আদিবাসী জুম্ম জাতিসমূহের উপর দু:খজনক মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে প্রচারকাজের জন্য ব্যয় করতেন। আর কিছু নয়।”

পরিশেষে সুহাস চাকমা লিখেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পরবর্তীতেও, তিনি তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় হারাননি, যা তিনি বিশ্বাস করতেন এবং একই কাজ তিনি অব্যাহত রাখেন। ড. আর এস দেওয়ান সম্পর্কে একটি মন্দ কথা উচ্চারণ করতে কারো কাছ থেকে কখনো শুনিনি। সকলের কাছেই তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি যুদ্ধে মৃত্যুবরণ না করতে পারেন, যা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ বলে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু জুম্ম জাতি আজ পর্যন্ত পুরোপুরি কাউকে পায়নি যিনি আর এস দেওয়ানের চেয়ে অধিকতর অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাঁর বিদেহী আত্মা নির্বাণপ্রাপ্ত হোক।”

মৃণাল কান্তি চাকমা লিখেছেন, “ড. আর এস দেওয়ান,একজন সত্যিকারের মানতবাদী। যে নিজের সমস্ত জীবন সোপে দিয়েছেন,জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের তরে। সুভাষচন্দ্র বোসের মতন তিনিও অমর হয়ে থাকবেন। সেই সাথে তিনি আরএস দেওয়ানের জন্মভূমি খবংপুজ্জ্যে গ্রামে তার প্রতিকৃতি স্থাপনের দাবী জানান।”

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী সঞ্চয় চাকমা লিখেছেন, “আমার ছাত্র রাজনৈতিক জীবনে আন্তর্জাতিকভাবে জুম্মো জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে আমি অনেক কিছু শুনেছি। ১৯৯৪ সালে আদিবাসীদের নিয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপের সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে জেনেভা সুইজারল্যান্ডে তার সাথে দেখা হয়েছিল। আমাদের সাথে দেখা করার পরে তিনি খুব খুশি ও উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং বিশেষত রাঙ্গামাটির যেখানে তিনি পড়াশুনা করেছেন এবং বড় হয়েছেন তার চমকপ্রদ স্মৃতি প্রকাশ করেছেন। তিনি সত্যই সত্যনিষ্ঠ, খাঁটি এবং অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। সে কারণেই তিনি মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং কর্মকর্তাদের সমস্ত কোণ থেকে শ্রদ্ধার যোগ্য ছিলেন।”

সঞ্চয় চাকমা আরো লিখেছেন, “আমাদের সবার উচিত আন্তর্জাতিক স্তরে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর উৎসর্গ এবং অবদানকে সম্মান করা। আমি জুম্মো জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর বিশাল উৎসর্গ এবং অবদানের জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। তিনি মারা গেছেন, তবে তাঁর উৎসর্গ এবং অবদানগুলি এখনও জীবিত। তিনি একজন যোদ্ধা ছিলেন এবং চিরকাল যোদ্ধা হয়ে থাকবেন। ইতিহাসের জুম্ম মানুষ আপনাকে কখনই ভুলতে পারে না!”

সঞ্চয় চাকমার স্ট্যাটাসের উপর মতামত দিতে গিয়ে শ্রীমৎ নাগসেন ভিক্ষু লিখেছেন যে, “তিনি (ড. আর এস দেওয়ান) একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। আমি তাঁর ইচ্ছা ও কর্মশক্তিকে শ্রদ্ধা করি। সম্ভবত এধরনের তাঁর সর্বোচ্চ কর্মশক্তি দিয়ে তাঁর প্রিয় মানুষদের জন্য কাজ করতে পারেন এবং কথা বলতে পারেন বলে কোন ব্যক্তিকে কল্পনা করা যায়।”

নাগসেন ভিক্ষু আরো মন্তব্য করেন, “তিনি সবসময় তাঁর কাজ ও বিশ্বাসের প্রতি আশাবাদী, অনুপ্রেরণামূলক ও বিনয়ী ছিলেন এবং সবসময় অদম্য মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন। তাঁর কর্মশক্তি তুলে ধরার মত ভাষা আমার নেই। ড: ইন্দু চাকমা তাঁকে ঠাকুর (ভান্তে) বলে ডাকতেন। কারণ তিনি খুবই সাধাসিদে জীবন যাপন করতেন। যুক্তরাজ্যে তাঁর চেয়ে কেউই এত সাধাসিদে জীবন যাপন করতে পারতেন না। …তিনি (ড. দেওয়ান) বলতেন: কেন আমার কম্পিউটার বা স্মার্টফোন দরকার, যেহেতু লেখার জন্য আমার একটি টাইপ রাইটার রয়েছে এবং কথা বলার জন্য বাড়ির ফোন রয়েছে।”

শ্রীমৎ ভিক্ষু আরো লিখেছেন, “তিনি ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি, কিন্তু তিনি গাড়ি পেতে চান না। তিনি বলতেন, আমি যদি এখানে বিলাসবহুল জীবন যাপন করি, তাহলে আমি কীভাবে আমার স্বল্প আয় বা অর্থ আমার জুম্ম জনগণের স্বার্থে ব্যয় করতে পারব? তিনি প্রতিদিন ম্যানচেষ্টার সিটি পাঠাগারে যেতে লোকাল বাস ধরতেন এবং সারাটা দিন পড়াশোনা ও রিপোর্ট লেখা নিয়ে সেখানে সময় ব্যয় করতেন। একটি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস বিবিসি রেডিও ছাড়া তার কখনোই কোনো টিভি ছিল না।”

“তিনি আরও বলতেন: ‘আমার কাজ হচ্ছে জুম্ম জনগণের মানবাধিকার সম্পর্কে অনুসন্ধান করা, পড়া এবং লেখা, পাঠাগারে যা চাই তাই সবকিছু করতে পারি। আমি প্রায় সন্ধ্যা ৬:০০ টায় বাসে চড়ে পাঠাগার থেকে বাড়িতে ফিরে আসি।‘ তিনি বলতেন: ‘টিভি, স্মার্টফোন অথবা আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে নিজে বিনোদন করার মত কোনো সময় আমার নেই, যেহেতু আমরা কাজ এখনও সফল হয়নি।‘ তিনি আরও বলতেন যে, তিনি আনন্দ বিহারে শেষ পরিদর্শন করে রাঙামাটি ছেড়ে আসেন, যেখানে তিনি বুদ্ধের সম্মুখে গভীর শপথ নিয়েছিলেন – ‘আমি আমার মিশন (অভিযান) সফল না হওয়া পর্যন্ত এই ভূমিতে ফিরব না।”

নাগসেন ভিক্ষু লিখেছেন যে, “তিনি বার্মিংহাম পরিদর্শনে যেতেন, বিশেষ করে যখন ড: ইন্দু চাকমা জীবিত ছিলেন। তিনি জুম্মদের জন্মভূমি সম্পর্কে তাঁর কার্যক্রম, রূপকল্প (ভিশন) ও মিশন (অভিযান) নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে আলাপ করতেন। জুম্মদের জন্মভূমি থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য দিয়ে এবং তিনি ও তাঁর মানবাধিকার কর্মীরা জুম্মদের স্বার্থে কী করছে তা দিয়ে তিনি পাক্ষিকভাবে নিউজলেটার (রিপোর্ট) পাঠাতেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ রিপোর্ট, মাঝে মাঝে বড় ম্যাগাজিন আকারের রিপোর্ট, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পাঠাতে কেবল ডাক মাশুলের জন্য কয়েক শ’ পাউন্ড ব্যয় করতেন।”

শ্রীমৎ ভিক্ষু আরো যোগ করেন যে, “সুরেশ চাকমা, এখন যুক্তরাষ্ট্রে, তাঁর অহিংস দর্শন, তবে ইউরোপীয়, ব্রিটিশ ও অন্যান্য পশ্চিমা মানবাধিকার গোষ্ঠীর সাথে তাঁর কাজের উপর তাঁর অনেক বক্তব্য রেকর্ড করতেন। তিনি বলতেন: আমরা আগামী বছর সুফল পাব, এবং অপেক্ষা কর এবং দেখ, ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে, অথবা জেনেভায় আমরা কী করেছি।”

পরিশেষে নাগসেন ভিক্ষু লিখেন যে, “এমন আশাবাদী, বিনয়ী, সৎ, সরল, শিক্ষিত, যুক্তিবাদী ও উদ্যমী ব্যক্তি অন্তত আগামী পাঁচ দশকে বা তারও বেশি সময়ে আমাদের জীবনকালে আর দেখতে পাব না; যদি না তিনি আবার ফিরে আসেন। তাঁর রূপকল্প ও আদর্শ জুম্ম জনগণের সাথে চিরকাল থাকুক।”

সঞ্চয় চাকমার স্ট্যাটাসের উপর রোনেল চাকমা ননি উল্লেখ করেন যে, “খুবই দু:খজনক। আমি প্রস্তাব রাখতে চাই যে, তাঁর (ড. দেওয়ানের) স্মৃতির উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অথবা লন্ডনে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হোক।”

উথোয়াই খই মারমা তাঁর মন্তব্যে উল্লেখ করেন যে, “এটা সকল জুম্ম জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত দু:খজনক। পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁর অমূল্য অবদানের জন্য আমরা তাঁর কাছে ঋণী রইলাম।”

অপরদিকে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যুতে অনেকে তাদের ফেসবুক ওয়ালে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যও প্রকাশ করেছেন।

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী সঞ্চয় চাকমা লিখেছেন, “ড. আর এস দেওয়ান কারোর যত্ন না নিয়ে নিজের বাসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এমনকি, তিনি কখন মারা গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। এই বার্তাটি আমার জন্য এবং সমস্ত জুম্ম মানুষের জন্য সত্যিই বেদনাদায়ক এবং নিষ্ঠুর। যে ব্যক্তি জুম্ম জনগণের আত্ম-সংকল্পের জন্য দীর্ঘায়িত জীবনযাপন করেছিলেন, তিনি নিরব অবস্থায় মারা গেলেন। কেউই কেবল তাঁর মৃতের সংবাদ প্রকাশ করে এবং নিজেদের ঐতিহ্যবাহী উপায়ে তাঁর মৃতদেহকে কবর দিতে বা পোড়াতে পারে না। এ কেমন বেদনাদায়ক খবর!”

সঞ্চয় চাকমার সাথে সুর মিলিয়ে অরুন্য চাকমা নামে এক ব্যক্তি লেখেন যে, “এটা অত্যন্ত অত্যন্ত অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমাদের জুম্ম জাতি সত্যিই অকৃতজ্ঞ।”

সঞ্চয় চাকমার স্টাটাসের সাথে সুর মিলিয়ে নিকোলাস চাকমা লিখেন যে, “ড. দেওয়ান ছিলেন এধরনের বিপ্লবী পার্টির জন্য মাত্র একজন আন্তর্জাতিক মুখপাত্র, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তাঁর দায়িত্ব নিতে পারলো না।”

সঞ্চয় চাকমার স্ট্যাটাসের প্রত্যুত্তরে মেজর রাকিব নামে একজন ব্যক্তি মতামত দেন যে, “অত্যন্ত দু:খজনক জুম্ম সমাজের প্রাপ্য স্বীকৃতি ও যত্ন ব্যতীত ড. আর এস দেওয়ান মারা গেছেন বলে জানতে পেরে অত্যন্ত দু:খ হয়েছে। তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এবং পথিকৃত ছিলেন যিনি জুম্ম সম্প্রদায়ের পক্ষে তাঁর পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মি. সঞ্চয়, আপনার মতো তথাকথিত জুম্ম রাজনীতির কিছু লোক নেতারা সুইটজারল্যান্ড, জাপান এবং কানাডায় পালিয়ে এসেছিলেন, যারা জুম্ম রাজনীতি ব্যবহার করে এবং জুম্ম জনগণের পিছনে গর্ত খুঁড়ে, ধন-সম্পদ, অর্থ লাভ করেছিলেন। দিল্লি এবং ভারতেও জমি বাড়ি কিনেছেন, নিজের লাভ এবং জীবন সুইটজারল্যান্ডে উপভোগ করেছেন পুরো সম্প্রদায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং জুম্মো ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিয়ে। যদি আপনার সাহস ও দেশপ্রেম থাকে, বাংলাদেশে আসুন রাজনীতি করুন এবং আপনার কণ্ঠস্বর উচ্চ করুন। বিদেশ থেকে বড় বড় বক্তৃতা দেবেন না, কারণ আমরা সবাই আপনার কুণ্ডলী জানি।”

অন্যদিকে ভদ্রসেন চাকমা নামে জনৈক ব্যক্তি সমালোচনা ও দুঃখের সাথে লিখেছেন, “এত উপচে পড়া কৃতজ্ঞতা এতদিন কোন আড়ালে লুকিয়ে ছিল যে, জাতির এতবড় সন্তান নীরবে নিভৃতে মরে-পঁচে ভূত হয়ে গিয়েছে, তবুও তার ত্যাগের সুফলভোগী জনজাতির মহাপুরুষরা কেউ টেরই পেল না? বেঁচে থাকা অবস্থায় যে রত্নটিকে অযত্নে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছিল, বেঁচে থাকতে যে হিরন্ময় পাত্রটিকে মূল্য দেওয়ার মনস্তাত্বিক দৈন্যতা ছিল, তার নিথর জড়দেহটাকে নিয়ে এত মায়াকান্না কেন দেখাতে হচ্ছে?”

এসব নেতিবাচক মন্তব্যের বিপক্ষে সজীব চাকমা (এস চাকমা) লিখেন যে, “আমাদের জুম্মরা বোধ হয় আবেগে, বুলিতে ও বিশ্লেষণে সবসময়ই একটু বেশিই এগিয়ে থাকি! এটাও একধরনের সমস্যা! আবার প্রয়োজনীয় জায়গায় ও সময়ে সেটার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। সম্প্রতি প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ও জুম্ম জাতির অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব রামেন্দু শেখর দেওয়ান (আর এস দেওয়ান) এর প্রয়াণের পর ফেবুতে যা দেখছি, তা আরও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।”

এস চাকমা আরো অভিমত ব্যক্ত করেন যে, “আমরা অপেক্ষা না করেই, ভালো করে যাচাই, বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণ না করেই সিদ্ধান্ত বা ফলাফল ঘোষণা করে ফেলি! অনেকেই এত এত গবেষণা করে এত এত তথ্য বের করে ফেলি যে, আসল জিনিসটাকেই গুলিয়ে ফেলি। ঘন্ডচক্র পাকিয়ে ফেলি। অথচ সময়কালে কে, কি, কেন, কোথায়, কিভাবে আছে তার কোনো খোঁজ রাখি না। যারা তাঁর প্রয়াণে প্রাণের অকৃত্রিম সমবেদনা ও শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ও জানিয়েছেন তাদের প্রতি রইল আমার অনেক ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা!”

অমিত হিল নামে একজন লিখেছেন, “বেঁচে থেকো অনন্তকাল- শিখুক প্রজন্ম। খুবই দূঃখজনক ব্যাপার। কেউ তার মত্যু সম্পর্কে জানলো না! কখন কিভাবে মারা গেছেন! পুলিশরা পঁচার গন্ধ পেয়ে ঘরে এসে তুলে নিয়ে গর্তে ফেলেছিল! তাও জানা গেলো ২-৩ মাস পরে! তাঁর মৃত্যুর ২-৩ মাসে পরে আমরা হা হুতাশ করছি! যে ব্যক্তিটি সারাজীবন জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন! স্বপ্ন দেখেছিলেন এক স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের। চুক্তির পরবর্তীকালে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিলেন মান অভিমানে! যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন- আর কাজ করেছেন কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পেরে কিছুটা ক্ষোভ-অভিমানে নিজেকে একেবারে একাকিত্ব জীবনে ঠেলে দিয়েছিলেন বলে তার মৃত্যুকে ও জানা গেলো না – জুম্ম জনগণের এই চাইতে বেশি দু:খ পাবার কি আছে?”

এসব নেতিবাচক মন্তব্যের বিরুদ্ধে মাওরুম সম্পাদক দীপায়ন খীসা তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেন যে, “ডক্টর রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যুতে একশ্রেণীর জুমিয়া নাগরিক হা হুতাশ করছেন। অনেকে কপাল ফাটিয়ে ফেলছেন। ফেসবুকের নিউজফিডে নানান বয়ান উদগীরণ করছেন। উদ্দেশ্য অন্য জায়গায় নিহিত। এটা শোক কিংবা ভালোবাসা নয়। নিছক ঈর্ষা। কারণ মিঃ দেওয়ান তাদের মতো আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করেননি। লড়াইয়ের মাঠ থেকে পালিয়ে নিরাপদ জীবন বেছে নেননি। তাই আর এস দেওয়ানের মৃত্যু তাদের কাল্পনিক মৃত্যুর মতো রাজসিক হয়নি। আর এস দেওয়ান ম্যানচেস্টার শহরে থেকেও বিদ্যুৎ সংযোগ নেননি। টেলিফোন (ল্যান্ড ফোন) ব্যবহারও ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে এসে আরও অধিক কৃচ্ছসাধন করেছেন। এই জীবন মহান এক ত্যাগী মনীষীর জীবন। পলায়নবাদীদের ভোগবাদী জীবন উপভোগ করেননি মিঃ দেওয়ান। সেই কারণে আর এস দেওয়ানকে নিয়ে পলায়নবাদীদের এখন মায়াকান্না। লক্ষ্য একটাই। আর এস দেওয়ানের নির্মোহ ও নির্লোভ জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। যেন জুম পাহাড়ের তারুণ্য আর এস দেওয়ান হতে পিছপা হয়। লড়াইয়ের ময়দান থেকে পলায়ন করে নিরাপদ ও ভোগবাদ বেছে নিয়ে আর এস দেওয়ানের জন্য অশ্রু ঝরানো শোভা পায়না হে পলাতক বন্ধুগণ।”

চিজিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজন ব্যক্তি তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেন যে, “কিছু সংখ্যক জুম্ম, বিশেষ করে কিছু সংখ্যক চাকমা, যারা নিজেদেরকে জুম্মদের মধ্যে সবচেয়ে সংগ্রামী, সচেতন, উচ্চ শিক্ষিত ও মহাজ্ঞানী মনে করেন, তারা নিজেরাই জাতির জন্য তেমন কোন কিছু করতে প্রস্তুত নয়। বরং অন্য কেউ জাতির জন্য কিছু করলে তাদের মন:পুত হয় না। তাদেরকে প্রতিনিয়ত খুঁত ধরেন, মহা মহা উপদেশ দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না। মহান ব্যক্তিত্ব, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার কর্মী ও জাতির জন্য নিবেদিত প্রাণ ড. আর এস দেওয়ানের মৃত্যুতেও তারা অন্যকে নানা ভুল ধরতে, দোষ চাপাতে, তুলোধুনো করতে যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।”

চিজিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা আরো জানান যে, “ড. আর এস দেওয়ান এমন এক ত্যাগী, সাধাসিধে জীবনে অভ্যস্ত ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, যিনি কৃচ্ছতা সাধনের জন্য তাঁর এ্যাপাটমেন্ট থেকে টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছেন, বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন, সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে জাতির জন্য কাজ করার জন্য। এমনকি আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার না করে কেবল সেকেলে একটি ম্যানিয়েল টাইপ রাইটারে রিপোর্ট লিখতেন ও সেই রিপোর্ট ডাকযোগে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও কর্তৃপক্ষকে পাঠাতেন। কম্পিউটার কিনে দিয়ে তাঁকে দিতে গিয়েও তিনি গ্রহণ করেননি। বিদ্যুত বিল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় খরচপাতির অর্থ প্রদান করতে গিয়েও তিনি গ্রহণ করেননি। সেসব অর্থ আন্দোলনের জন্য ব্যয় করতে অনুরোধ করতেন। ব্রিটিশ সরকার থেকে যে ভাতা তিনি পান, সেই অর্থ দিয়ে তিনি চলতে পারেন এবং অনায়াসে তাঁর প্রচারাভিযানের খরচ নির্বাহ করতে পারেন বলে তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করতেন।”

শ্রী তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর স্ট্যাটাসে আরো উল্লেখ করেন যে, “আমি যতটুকু জেনেছি, জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে, লন্ডন প্রবাসী জুম্মদের পক্ষ থেকে ড. দেওয়ানকে নিয়মিত খোঁজখবর ও যোগাযোগ রাখতেন। জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদল ক্যাম্পেইনের কাজে যতবার যুক্তরাজ্য তথা ইউরোপে গিয়েছেন, ততবার সরেজমিন আর এস দেওয়ানের সাথে দেখা করেছেন বা টেলিফোনে যোগাযোগ করেছেন। সর্বশেষ জনসংহতি সমিতির সহ সভাপতি ঊষাতন তালুকদার এবং তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা ২০১৬ সালের জুন মাসে এবং উষাতন তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক প্রণতি বিকাশ চাকমা ২০১৭ সালের জুন-জুলাই মাসে যুক্তরাজ্য সফরকালে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে ম্যানচেস্টারে দেখা করেছিলেন। জানা গিয়েছে যে, সেসময় তিনি জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলের কাছে জনসংহতি সমিতি আন্দোলনের সঠিক লাইনে আছে বলে তিনি দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন এবং বর্তমানে অনেক ব্যক্তি সফলভাবে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে উচ্চসিত প্রশংসা করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে সেসময়েও তিনি টাইপ রাইটারে রিপোর্ট লিখে ৩০০ জন ব্যক্তি, সংগঠন ও কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট পাঠাতেন বলে ড. দেওয়ান জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছেন। কাজেই ‘চুক্তির পরবর্তীকালে ড. দেওয়ান মান-অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন’ বলে কিছু লোকের অভিযোগ কখনোই সঠিক নয়” বলে চিজিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন।