জুম্মদের উপর প্রতিটা আক্রমণে নেতৃত্বে রয়েছে সেনাবাহিনী

0
3040
ফাইল ছবি: সাজেক-বাঘাইহাট সাম্প্রদায়িক হামলা

                 পাইচিংমং মারমা                    

     ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক মেজরের ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে অনলাইন মিডিয়া সরগরম হয়ে ওঠে৷ তিনি তাঁর পোস্টে আদিবাসী জুম্মদের ‘উপজাতি-খাপ্পা’ সম্বোধন করে তাদের যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন!

তিনি লিখেছিলেন, ‘সরকারের একটা আদেশ পেলেই হলো, উপজাতিদের ‘অ্যানিহিলেট’ করতে’ তাঁদের নাকি মাত্র এক মাস সময় লাগবে৷ তাঁর পোস্টের সূত্র ধরে ‘খাপ্পা-উপজাতি’ নন এমন অনেকেই সরব হয়ে ওঠেন৷ সুস্থ বিচার-বিবেচনা বোধ সম্পন্ন সকলেই সেই পোস্টের কড়া সমালোচনা করেন৷ তারপর বাংলাদেশ আর্মির সেই মেজর মো. রেজাউর রহমান নামের সেই ‘আইডি’টি আর ফেইসবুকে দেখা যায়নি৷ যেহেতু এ ধরনের কোনো আইডি এখন আর নাই, সুতরাং এ রকম কোনো বক্তব্যের দায় আর কে নেবে! অর্থাৎ এখন হয়ত সবই মিডিয়ার সৃষ্টি৷

‘খাপ্পাদের’ নিয়ে একজন আর্মি অফিসারের এমন বক্তব্য সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে বেখাপ্পা শোনালেও, আমাদের কাছে তা বেখাপ্পা নয়৷ আমরা যারা পাহাড়ের মানুষ, আমাদের কাছে আর্মি অফিসারের এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত নয়৷ একজন আর্মি অফিসার সাধারণত আর্মির সাংগঠনিক সংস্কৃতি এবং সেখানে বিদ্যমান চিন্তা, রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিনিধিত্ব করেন৷ একটি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নীতিরও প্রতিফলন ঘটে, কেননা রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী, সেনাবাহিনী তার অফিসারদের যেভাবে ভাবাতে চায়, তাঁরা সেভাবেই ভাবেন৷

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার সব স্তরের ও সকল কর্মক্ষেত্রের (মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সসহ মিলিটারি নেতৃত্বাধীন প্যারা-মিলিটারি ফোর্সসমূহ) কর্মকর্তার মনন যে ছাঁচে গড়ে দেয়, তাতে করে এমন ‘বেফাঁস’ বক্তব্য হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকট হতেই পারে৷ আসলে সেদিনের সেই পোস্ট দেখে অনেকের মুখে শোনা এক সেনা কর্মকর্তার বক্তব্য মনে পড়ছে৷ এক জনসভায় তিনি নাকি বলেছিলেন, তাঁরা পাহাড়ের মাটি চান, পাহাড়ের মানুষদের নয়৷

১৯৭৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘কাউন্টার ইনসারজেন্সি’ অপারেশনের শুরুতে এক জেনারেল নাকি পাহাড় থেকে পাহাড়ি নির্মূল করার এমন মনোবাঞ্ছা ব্যক্ত করেন৷ জেনারেল সাহেব পাহাড়কে পাহাড়িমুক্ত করতে যা যা করা দরকার সবই করেছিলেন৷ আর তাঁরা যা যা করেছেন – তা আমরা দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে আর বলতে বলতেই বড় হয়েছি৷

এ সব কথা কখনোই মিডিয়ায় আসে না৷ মিডিয়ার ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং ‘সেন্সরশিপ’-এর অন্ধকারে পাহাড়ের খবর কখনোই আলো দেখেনি৷ গণমাধ্যমের ওপর সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব খাটানোর সাম্প্রতিক নজির হচ্ছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া৷ সব খবর বন্ধ করে দেবার পাশাপাশি বাইরে থেকে সব খবর দেওয়া-নেওয়া এবং পাহাড়ে রিসার্চের কাজও বন্ধ হবার পথে। কেননা, ইতিমধ্যে ২০১৫ সালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে সেনাবাহিনী বা প্রশাসনের প্রতিনিধি ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সাথে বিদেশিদের কথা বলাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷

‘পাহাড়ে বিচারহীনতা ও ত্রাসের সংস্কৃতি বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে’। সেই জেনারেল সাহেব মাটির জন্য মাটির মানুষদের ধ্বংস করতে কী কী করেছিলেন – তা দেশের অনেক মানুষই জানেন না৷ আমরা জানি৷ কিন্তু সেসব বলতে গেলে তার ‘ভ্যালিড’ প্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত দিতে পারবো না৷ তবু সত্য কোনো দিন চাপা থাকে না৷ মাটির নীচে থাকা হাজার বছরের পুরোনো ‘ফসিল’ থেকেও সত্য উঠিয়ে আনা যায়৷

সেই জেনারেলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে তাঁর উত্তরসূরিরা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন৷ আর তাঁদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরতেই আমি এই লেখাটা লিখছি৷ এই লেখাটি মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিবরন৷ লেখাটিতে পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ তবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে ইনসারজেন্সির সময়ের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে৷

লেখার বেশিরভাগ তথ্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইনডিজেনাস অ্যাফেয়ার্স’, ‘শিমিন গাইকো সেন্টার’ এবং ‘অর্গানাইজিং কমিটি সিএইচটি ক্যাম্পেন’-এর যৌথ রিপোর্ট ‘মিলিটারাইজেশন ইন দ্য চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস, বাংলাদেশ – দ্য স্লো ডিমাইজ অফ দ্য রিজিয়ন্স ইনডিজেনাস পিপল’ থেকে নেওয়া হয়েছে৷ ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা অধিদপ্তর ‘নোরাড’-এর অর্থায়নে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়৷

পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসার কথা ছিল৷ কিন্তু চুক্তির পর জেএসএস (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) গেরিলা যুদ্ধ থেকে নিরস্ত হলেও, রাষ্ট্র তথা সেনাবাহিনীর ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা ছিল৷ আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ২০০১ সালে জারিকৃত সেনাবাহিনী ‘অপারেশন উত্তরণ’ বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর জোরালোভাবে কার্যকর করে৷ এর ফলে এরশাদ আমলের ‘অপারেশন দাবানল’ রদ হয়ে যায়৷ কিন্তু সেনাবাহিনীর কার্যক্ষমতা ও কর্মসূচি আগের মতোই রয়ে যায়৷ পাহাড় থেকে পাহাড়িদের নির্মূল করতে চুক্তির পূর্বে ১৫টি বা কারো কারো মতে ১৩টি গণহত্যা সংঘটিত করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী৷

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকার কাউন্টার ইনসার্জেন্সির পদক্ষেপ হিসাবে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু করেন৷ বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় ৪ লাখ বাঙালি মুসলিম পাহাড়ে পুনর্বাসন করা হয়েছিল, যাঁদের ‘সেটলার’ বলা হয়৷ শান্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ ঠেকাতে সেটলারদের ‘মানবঢাল’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাথে শান্তিবাহিনীর যুদ্ধকে জাতিগত সংঘাতে রূপ দেওয়া হয়েছে সেটলারদের মাধ্যমে৷ দু’টি জনগোষ্ঠীকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে৷ সেটলারদের মধ্য থেকেই ভিডিপি ও আনসারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ আদিবাসীদের উপর প্রতিটা আক্রমণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে সেনাবাহিনী৷ কিন্তু হত্যাযজ্ঞে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সেটলারদের৷ সেনাবাহিনী, প্যারা-মিলিটারি বাহিনী (সাবেক বিডিআর), পুলিশ, আনসার, ভিডিপির নেতৃত্বে সংঘটিত এ সব হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্র প্ররোচিত হত্যাকাণ্ড হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে৷

চুক্তি পরবর্তীকালে পার্বত্য অঞ্চলকে আদিবাসীদের জন্য ত্রাসের জনপদ বানাতে সেটলারদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে সেনাবাহিনী৷ যেমন সেটলারদের সংগঠন ‘পার্বত্য বাঙালি সমঅধিকার আন্দোলন’, ‘বাঙালি গণ পরিষদ’ ও ‘পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ’ গড়ে তোলা, পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটা বাতাবরণ তৈরি করে রাখা ইত্যাদি৷ এছাড়া আদিবাসীদের তাঁদের পূর্ব-পুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা এখন প্রতিদিনের সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

চুক্তি পরবর্তী সময়ে আদিবাসীদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন, যেমন ধর্ষণ, জাতিগত হামলা, অগ্নিকাণ্ড, লুটপাট, ত্রাস সৃষ্টিসহ সব ধরনের জাতিগত আগ্রাসন ও নিপীড়নের যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে সেটলারদের৷ পাহাড়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ত্রাসের সংস্কৃতি বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা আছে৷ লেখার শেষে রিপোর্ট থেকে নেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের দু’টি তথ্য বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে৷ এ লেখার তথ্য কেবল ২০১১ সাল পর্যন্ত৷ তারপর ২০১২ সালে রাঙ্গামাটিতে, ২০১৩ সালে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায়, ২০১৪ সালে নানিয়ারচরে বড় ধরনের জাতিগত হামলা হয়েছে৷ আইন-বহির্ভূতভাবে সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, হয়রানি, সেনা হেফাজতে শারীরিক অত্যাচার ও মৃত্যু প্রতি বছর বাড়ছে৷ সামরিক কর্মকর্তা ও সেটলারদের ভূমি বেদখলের ফলে আদিবাসীরা প্রান্তিকতার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে৷ সেনা-সেটলার কর্তৃক আদিবাসী নারীদের ধর্ষণের পরিসংখ্যান প্রতিবছর বেড়েই চলেছে৷

এ লেখায় শুধু ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর চালানো বড় সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোর উল্লেখ রয়েছে৷ এ সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল, তার আগে ছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার আর এখন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ৷ লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, কোনো আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা হামলা মুক্ত নিরাপদ জীবনপায়নি৷ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০১১-র মধ্যে সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ১৫ জন, আহত ৩১ জন, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪৬৪ জন, পাঁচটি বাড়ি পোড়ানো আর সাতটা মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে, উচ্ছেদ করা হয়েছে ২৮৫ জনকে, মারধোর করা হয়েছে ১৫৪ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৭৪ জন আদিবাসী৷ অন্যদিকে ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাঙালি সেটলারদের চালানো কিছু হামলায় ৭ জন নিহত, ৪২ জন আহত, ৩৮টি লুট, ১০টি ধর্ষণ এবং ১,০৭০টি বাড়িঘর পোড়ানোর ঘটনা ঘটে৷

লেখার শুরুতে বলেছিলাম যে, সেনাবাহিনী রাষ্ট্র চরিত্রকেই ধারণ করে৷ ২২ বছর আগে পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে আদিবাসী জুম্মরা গেরিলা যুদ্ধ থামিয়েছে বটে, কিন্তু সেনাবাহিনী আজও যুদ্ধ থামায়নি৷ সেই জেনারেল সাহেবের আদেশ যেন আজও মেনে চলেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী৷ কিন্তু তখন জুম্মদের পক্ষে লড়াই করার জন্য শান্তিবাহিনী ছিল, আজ আর কেউ নেই। তবে নতুন করে নয়া শান্তিবাহিনীকে আবার জেগে উঠতে হবে।