চট্টগ্রামে পিসিপির সম্মেলন ও কাউন্সিল: পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে অধিকতর সামিল হওয়ার আহ্বান

0
191

হিল ভয়েস, ৪ মার্চ ২০২৩, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে ‘সংকীর্ণতাবাদ ও আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হোন’ শ্লোগান নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, চট্টগ্রাম মহানগর শাখা ও চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখার বার্ষিক শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল-২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল ৩ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার ৩:০০ টায় চট্টগ্রাম নগরস্থ প্রেসক্লাব ভবনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি তাপস হোড়, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি দিশান তঞ্চঙ্গ্যা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য উলিসিং মারমা।

সম্মেলনের সভায় সভাপতিত্ব করেন পিসিপির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা এবং সঞ্চালনা করেন পিসিপির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখার সাধারণ সম্পাদক নরেশ চাকমা। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার তথ্য ও প্রচার সম্পাদক অম্লান চাকমা এবং প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হ্লামিও মারমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সুভাষ চাকমা ও চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখার সদস্য উখিং সাই মারমা। অনুষ্ঠানের শুরুতে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এযাবৎ যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ছাত্রনেতা সুমন মারমা বলেন, “দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালে একটা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। সেই চুক্তিকে বাস্তবায়ন করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত কর্মসূচীগুলো আরও জোরদার করতে হবে। এভাবে আমাদের এই আন্দোলনের বার্তা প্রসারিত করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান যে পরিস্থিতি, শাসকগোষ্ঠীর একের পর এক অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা, বঞ্চনা, ভূমি থেকে উচ্ছেদ জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান সরকার যেমন বাঙালিদের উপর শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্য জারি রেখেছিল, আজ বাংলাদেশ সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাথে নিয়ে একই কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে।”

তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের অগ্রজরা চুক্তি এনে দিয়েছেন এবং আজও এই চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তারা একটি মুহূর্তের জন্যে হতাশ-নিরাশ হননি। আজকে আমরা তরুণ ছাত্র সমাজ ধৈর্য হারাবো কেন!”

তিনি বলেন, “সেই আন্দোলনে ছাত্র সমাজের মুখ্য ভূমিকা খুবই জরুরী। অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই-সংগ্রামে তরুণ ছাত্র সমাজের ভূমিকা সময়ে দাবি। এজন্য প্রত্যেককে জ্ঞানের গরিমায় গড়ে তুলে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে আত্মকেন্দ্রিকতা ও সংকীর্ণতাবাদের চিন্তাচেতনা থেকে বের হয়ে জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থের জন্য কাজ করতে হবে।”

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি তাপস হোড় বলেন, “বর্তমান বাংলাদেশে শাসকগোষ্ঠী সত্য কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আপনি চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বললে আপনাকে সরকারের বিশেষ নজরে পড়তে হবে। যদি বলেন পাহাড়ে অঘোষিত সেনাশাসন, নির্যাতন-নিপীড়ন-বৈষম্য হচ্ছে তখন আপনার উপর হুমকি আসবে। অথচ বাংলাদেশে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিনিয়ত হরণ হচ্ছে। আপনি এর বিরুদ্ধেও বলতে পারছেন না। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সরকারের নিকট যে পাঁচ দফা দাবি করছে তার মধ্যে পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও দ্রুত বাস্তবায়ন অন্যতম।” এছাড়াও তিনি সরকারের নিকট পার্বত্য চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নসহ ঐক্য পরিষদের পাঁচ দফা দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের নাজুক পরিস্থিতি বিষয়ে আমরা সবাই জানি। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পাহাড়ি জনগণের পাশাপাশি দেশের সকল সচেতন নাগরিককে এগিয়ে এসে সারাদেশে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই এই অঞ্চলের দীর্ঘ দিনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।”

এছাড়াও উপস্থিত অন্যান্য বক্তারা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার এখন ভূমি বেদখল, হত্যা-ধর্ষণ, পর্যটন স্থাপন, ইসলামিকরণসহ জুম্মদের স্বার্থ পরিপন্থী নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে। একটা মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যদি লড়াই করে তবে সে সন্ত্রাসী হয়ে যায় না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ও অধিকার আদায়ের জন্য অস্ত্র হাতে না তুললে আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করলে সন্ত্রাসী হবে কেনো? পার্বত্য চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।”

আলোচনা শেষে সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি, হ্লামিও মারমাকে সাধারণ সম্পাদক ও অম্লান চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে পিসিপির চট্টগ্রাম মহানগর শাখা, নরেশ চাকমাকে সভাপতি, অন্তর চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও অন্বেষ চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং সেতু চাকমাকে সভাপতি, উখিং সাইন মারমাকে সাধারণ সম্পাদক ও সুমন চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখার নতুন কমিটি ঘোষণা ও কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়। এসময় শপথ বাক্য পাঠ করান পিসিপির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি থোয়াক্যজাই চাক। এরপর সভার সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যার বক্তব্যের মাধ্যমে শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিলের সমাপ্তি ঘটে।