গাইবান্ধা সাঁওতাল হত্যা মামলায় কোন পুলিশ ও সাবেক এমপি চার্জশীটভুক্ত হননি!

0
586

হিল ভয়েস, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বুধবার, গাইবান্ধা:  স্থানীয় জনগণের অভিমত অনুসারে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর এর ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক সংসদ সদস্যসহ কোন পুলিশ সদস্যের নাম ব্যতিরেকেই পুলিশের তদন্ত বিভাগ ‘পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ (পিবিআই) ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই একটি চার্জশীট দাখিল করে। ঐদিন নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় বখাটেদের এক হামলার পর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে তিন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হন। সাঁওতাল নেতাদের দাবি, চার্জশীটটি পক্ষপাতদুষ্ট এবং এতে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। চার্জশীটটি বাতিল করার এবং পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রিট পিটিশন দাখিলের পূর্ব পর্যন্ত, সাঁওতাল জনগণ প্রতিবাদ কার্যক্রম, গণমিছিল, সড়ক অবরোধ ইত্যাদি শুরু করে।  

সাঁওতাল নেতৃবৃন্দের দাবি, হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের বাদ দিয়ে ছেঁচোরদের অন্তর্ভুক্ত করে চার্জশীট একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অভিসন্ধি। মামলায় চার্জশীটভুক্ত অন্যান্যদের মধ্যে আছেন রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড এর জেনারেল ম্যানেজার (অর্থ) নাজমুল হুদা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাকিল আহমেদ বুলবুল, মিলস লেবার ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি মুস্তাফিজুর রহমান দুলাল, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য শাহ আলম। তাছাড়া, পিবিআই উদ্দেশ্যমূলকভাবে চার্জশীটে ঘটনার শিকার ২০ জন আদিবাসীর নাম অন্তর্ভুক্ত করে। অপরদিকে প্রকৃত অভিযুক্ত ও মূল পরিকল্পনাকারী; পুলিশ সদস্য ও সাবেক এমপি এবং অন্যান্য অপরাধীদের চার্জশীটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে, ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালরা চার্জশীটটি প্রত্যাখ্যান করে এবং এটি একটি পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত বলে অভিহিত করে।

জানা গেছে, ঐ সময়ের একটি ভিডিও ফুটেজ, যা আল জাজিরাসহ স্থানীয় কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয়, তাতে দেখা যায় যে, কিছু পুলিশ সদস্য; গোবিন্দগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর (গোয়েন্দা শাখা) মাহবুবুর রহমান ও কনস্টেবল সাজ্জাদ হোসাইন গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ বাগদা-ফারমন এ সাঁওতাল বাড়িতে অগ্নিসংযোগে জড়িত ছিলেন। পরে, ১০ মার্চ ২০১৭ হাইকোর্টে দাখিলকৃত এক পুলিশী তদন্ত প্রতিবেদনে সাঁওতাল বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে দুই পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়। এর পূর্বে ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ গাইবান্ধা চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ শহিদুল্লাহ হাইকোর্টে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন, যাতে উল্লেখ রয়েছে যে, সাঁওতাল বাড়িতে অগ্নিসংযোগের হামলায় ৩ পুলিশ সদস্য ও কয়েকজন স্থানীয় দুস্কৃতিকারী জড়িত ছিলেন। এছাড়াও, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নেতারা দাবি করেন, গাইবান্ধা-৪ এর আওয়ামীলীগের সাবেক সাংসদ আবুল কালাম আজাদ, ২নং কাটাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ রেজাউল করিম রফিক সশীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সাঁওতালদের উপর হামলার জন্য স্থানীয় বখাটে ও পুলিশকে নির্দেশনা প্রদান করেন। অথচ, রহস্যজনকভাবে পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের নাম আসেনি।

সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাসকে বলেন, ‘আমাদের দায়েরকৃত মামলায় (শ্রী টমাস হেমব্রম কর্তৃক দায়েরকৃত, জিআর নং-২৩/২০১৬, তারিখ: ২৬/১১/২০১৯) সাবেক এমপি মোঃ আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সদস্য, ৩৩ জনের নাম মূল অভিযুক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভিডিও ক্লিপটি আমাদের উপর জঘন্য হামলায় তাদের সম্পৃক্ততা দেখিয়ে দিয়েছে। দুঃখজনকভাবে তাদের নাম চার্জশীট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা এই চার্জশীট প্রত্যাখ্যান করেছি।’

এই কারণে, গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও অন্যান্যরা, সাহেবগঞ্জ বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী ও বাঙালি চাষীদের পক্ষে, চার্জশীটটি বাতিল এবং নিরপেক্ষ কমিটি পুনর্গঠনের পর সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য ও অন্যান্য অভিযুক্তদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গোবিন্দগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে একই আদালতে ৪ নভেম্বর ২০১৯।

আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলস লিমিটেড ও গোবিন্দগঞ্জ থানা কর্তৃক দায়েরকৃত মামলার পরিস্থিতি
১. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে মোঃ আবদুল আউয়াল, ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি), রংপুর সুগার মিলস লিসিটেড কর্তৃক দায়েরকৃত একটি মামলা। জিআর নং: ২৯২/২০১৬, তারিখ: ৩০/০৭/২০১৬। নামে ১৬ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে অনেকের বিরুদ্ধে এই মামলা চলমান রয়েছে। ১৬ জন জামিন পেয়েছে।
২. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে মিস আক্তার জাহান, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডেপুটি এমডি), রংপুর সুগার মিলস লিসিটেড কর্তৃক দায়েরকৃত একটি মামলা। জিআর নং: ৩৯৩/২০১৬, তারিখ: ২৫/০৯/২০১৬। নামে ৫০ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে ৫০০/৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫০ জন জামিন পেয়েছেন।
৩. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোঃ আখতারুজ্জামান কর্তৃক দায়েরকৃত দায়েরকৃত একটি মামলা। জিআর নং: ৩০৩/২০১৬, তারিখ: ১২/০৭/২০১৬। নামে ৩৭ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৭ জন জামিন পেয়েছেন।
৪. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোঃ আবদুল গাফ্ফার কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা। জিআর নং: ৩৩৭/২০১৬, তারিখ: ০৮/০৮/২০১৬। নামে ৩৩ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে ৩০০/৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৩ জন জামিন পেয়েছেন।
৫. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোঃ আবদুল গাফ্ফার কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা। জিআর নং: ২২৪/২০১৬, তারিখ: ০৬/১১/২০১৬। নামে ৪২ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ৪২ জন জামিন পেয়েছেন।
৬. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে গোবিন্দগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর কল্যাণ চক্রবর্তী কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা। জিআর নং: ৫৫১/২০১৬, তারিখ: ০৭/১১/২০১৬। নামে ৩৮ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে অনেক জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৮ জন জামিন পেয়েছেন।
৭. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডেপুটি এমডি) মিস আক্তার জাহান কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা। জিআর নং: ২৫/২০১৭, তারিখ: ১৫/০১/২০১৭। নামে ১৩ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে ১০/১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন জামিন পেয়েছেন।
৮. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডেপুটি এমডি) মিস আক্তার জাহান কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা। জিআর নং: ২১৮/২০১৭, তারিখ: ০৫/০৪/২০১৭। নামে ১০ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে অনেক জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ জন জামিন পেয়েছেন।
৯. সাইবগঞ্জ-বাগদা-ফার্ম এর আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের বিরুদ্ধে এক আদিবাসী শ্রী চরণ মুর্মু কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা। জিআর নং: ৫৪২/২০১৭, তারিখ: ১৪/০৯/২০১৭। নামে ২০ জন আদিবাসী ও বাঙালি চাষী এবং বেনামে ১০/১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ জন জামিন পেয়েছেন।

আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা
১. ৬ নভেম্বর ২০১৬ ঘটনার বিষয়ে রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড ও গোবিন্দগঞ্জ থানা কর্তৃক সমর্থনপুষ্ট হয়ে এক আদিবাসী শ্রী স্বপন মুর্মু কর্তৃক একটি মামলা দায়ের করা হয়। জিআর নং: ২৩/২০১৬, তারিখ: ১৫/০৯/২০১৬। ১০ দিন পর ঘটনার বিষয়ে প্রভাবিত করার জন্য সাবেক এমপি মোঃ আবুল কালাম আজাদ কর্তৃক সমর্থনপুষ্ট হয়ে স্বপন মুর্মু এই মামলাটি দায়ের করেন। উল্লেখ্য, তিনি সাঁওতাল প্রতিনিধি নন। পিবিআই এই মামলার ভিত্তিতে ঘটনার তদন্ত করে এবং ২৮ জুলাই ২০১৯ চার্জশীট দাখিল করে। চার্জশীটটি ক্ষতিগ্রস্ত; আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।
২. ৬ নভেম্বর ২০১৬ ঘটনার বিষয়ে এক আদিবাসী নেতা শ্রী টমাস হেমরম কর্তৃক স্থানীয় বখাটে, রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড ও গোবিন্দগঞ্জ থানার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। জিআর নং: ২৩/২০১৬, তারিখ: ২৬/১১/২০১৯। ২১ দিন পর ক্ষতিগ্রস্ত; আদিবাসী জনগণ ও বাঙালি চাষীদের পক্ষে টমাস হেমরম এই মামলাটি দায়ের করেন। উল্লেখ্য, তিনিই ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক প্রতিনিধি। গোবিন্দগঞ্জ থানা এটি পৃথক মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেনি, বরং এটা তারা স্বপন মুর্মুর মামলার সাথে সম্পূরক হিসেবে গ্রহণ করে। পিবিআই সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ, এবং পুলিশ ও অন্যান্য বখাটেদের নাম বাদ দিয়ে এই মামলাটি সম্পূর্ণভাবে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগায়। এই মামলার ভিত্তিতে তারা গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ চার্জশীটটি বাতিলের জন্য একটি রিট পিটিশন দাখিল করে।

সূত্র: কাপেং ফাউন্ডেশন