করোনার অজুহাতে কোন হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন ঢাবি’র আদিবাসী ছাত্র সুমন চাকমা

0
1027
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী সুমন চাকমা চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন

হিল ভয়েস, ৭ এপ্রিল ২০২০, ঢাকা:  পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি থেকে আসা সুমন চাকমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২২তম ব্যাচের এক আদিবাসী মেধাবী ছাত্র। ফুসফুসজনিত ক্যান্সার থেকে তিনি প্রায় সুস্থই হয়ে উঠছিলেন। সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসার পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে পড়াশোনার উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকাতেই অবস্থান করছিলেন তিনি। হঠাৎ শরীরে অসুস্থতা বোধ করলে এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে ঢাকার হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন তিনি। কিন্তু কোন পরীক্ষা ব্যতিরেকেই করোনা সন্দেহে কোন হাসপাতালই তাকে ভর্তি করেনি। তিনি দৃঢ়তার সাথে নিজেকে করোনা আক্রান্ত নয় বলে দাবি করলেও কোন ডাক্তারই তার চিকিৎসায় গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসেনি। অথচ কোন হাসপাতাল ও ডাক্তার তার করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থাও করেনি। অগত্যা হতাশ হয়ে, শারীরিক কষ্ট নিয়ে তাকে ফিরতে হয় খাগড়াছড়িতে নিজের গ্রামের বাড়ি। অবশেষে ৬ এপ্রিল ২০২০ সকাল ৮:৩০টার দিকে বিনাচিকিৎসায় মারা গেলেন তিনি।

গত ২৬ মার্চ ২০২০ নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে সুমন চাকমা গভীর উদ্বেগ ও আক্ষেপ নিয়ে লেখেন, ‘আমার করোনা হয়নি, অথচ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে করোনার জন্যেই আমাকে মারা যেতে হবে।’ তাই যেন সত্য হলো। তিনি যেন নিজেই নিজের অসহায় মৃত্যুকে দেখলেন এবং দেখলেন এদেশের চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসাব্যবস্থার নির্মমতাকে। হাসপাতালে সামান্য স্থান পেলে বা ডাক্তারদের সামান্য আন্তরিক সেবা পেলে তিনি হয়তো এই কয়েকদিনে সুস্থ হয়ে উঠতেন। হারাতে হতো না তার পরিবারের, সমাজের ও দেশের এক সম্ভাবনাময় শিক্ষিত তরুণকে।

সুমন চাকমার বাবা সুপেন চাকমা বলেন, ‘আমি ভাবলাম, ঢাকায় থাকলে তো বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে হবে। তাহলে ঢাকা থেকে বাড়িতে মরে গেলেও ভালো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরে তাকে বাড়ি নিয়ে আসি। চট্টগ্রামের এক হোমিও চিকিৎসক ২৪ দিনের কিছু ঔষধ দেন। ঔষধ শেষ হয়ে যায়। যান চলাচল বন্ধ থাকায় ঔষধও আনতে যেতে পারেননি। তবে আজ (৬ মার্চ) বেলা ১১:০০ টার দিকে ঔষধ আনতে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই সুমন সব ছেড়ে চলে গেছে।’

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধ্যয়নরত অবস্থায় সুমন চাকমা ফুসফুসজনিত জটিল রোগে আক্রান্ত হন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তিন মাস চিকিৎসার পর, এক পর্যায়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার পর তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেন এবং ২০১৯ সালের জুন মাসে দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন।

গত ১১ মার্চ ২০২০ সুমন চাকমা হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। এরপর তার বন্ধুরা তাকে নিয়ে একে একে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে যান। ফুসফুসজনিত রোগের কারণে তার শ্বাসজনিত সমস্যা দেখে করোনা সন্দেহ করে কোন হাসপাতালেই দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করতে রাজী হননি। গত ১১ মার্চ ২০২০ হতে ১৬ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন চিকিৎসার সুযোগ না পেলে এবং উপায়ান্তর না দেখে গত ১৮ মার্চ ২০২০ তাকে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার দাতকুপ্যা আগালাশিং পাড়ায় তার গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।

সুমন চাকমার চিকিৎসার কাজে যুক্ত থাকা অনুপম চাকমা হাম্মো নামে ঢাকার এক ছাত্র তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘খবরটি শোনার পর সত্যি ভীষণ খারাপ লাগছে।.. পার্থিব পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে তুমি কী পরিমাণ চেষ্টাটাই না করেছিলে আর তোমার পরিবার ও আমরা অন্যান্যরা যথাসাধ্য কীভাবেই না চেষ্টা করে গিয়েছিলাম। না, তবু তোমাকে হেরে যেতে হলো। আসলে তুমি হারোনি, এই রাষ্ট্র-রাষ্ট্রব্যবস্থা হেরেছে তোমাকে প্রাপ্য নাগরিক সুবিধা দিতে না পেরে।’

অনুপম চাকমা আরও লেখেন, ‘..তারপর তুমি ল্যাব এইড হাসপাতালে গিয়েছিলে এবং করোনা রোগী ভেবে তারা কোন টেষ্ট না করিয়ে কিছু ঔষুধ দিয়ে বিদায় করে দিলো। তারপর সন্ধ্যা ৮টা নাগাদ তোমাকে এ অবস্থায় দেখতে পাই। তারপর শরীর মুছে দিয়ে কিছু ফল খেতে দিই, তখনো তুমি ঘাড় সোজা করতে পারছিলে না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। প্রায় তিন ঘন্টা ঘাড়পিঠ মালিশ করে দিয়ে কিছুটা ভালোবোধ করলে আমি এবং একবন্ধুকে নিয়ে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়েও কোন লাভ হয়নি। পেয়েছি শুধু জ্ঞানগর্ব অনুপ্রেরণা ও শ্বাসকষ্টের জন্য একটা টেবলেট।’

অনুপম চাকমা আরও লেখেন, ‘১৪ মার্চ বিকাল ২টায় পিজিতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। সেখান থেকে পরামর্শ দেয়া হল সিটিস্ক্যান করে রিপোর্টসহ আরো উন্নত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে। সিটিস্ক্যান রিপোর্ট ল্যাব এইড হাসপাতাল থেকে করিয়ে নিই। ১৬ মার্চ সেই রিপোর্ট নিয়ে আবার পিজি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে দেখা করি। সেখান থেকে পরামর্শ দেয়া হল জরুরী ঢাকা মেডিকেল অথবা জাতীয় বক্ষ ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে। তারপর ঢাকা মেডিক্যালে পুনবার ভর্তির জন্য গেলে সেখানে করোনা সন্দেহে আবারও ভর্তি করা হয়নি। আমি স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে কিছু তর্ক-বিতর্কও করি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তারপর সেখান থেকে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চলে যায়। সেখানে পৌঁছতে প্রায় রাত ৯টা বেজে যায়। সেখানে গিয়ে বলা হলো ভর্তির জন্য সিট খালি নেই। একসময় পুরো হাসপাতাল সিট ভর্তি থাকা সত্ত্বেও রোগীদের ভর্তি করিয়ে বারান্দায় রেখে দেয়া হয়, অথচ সিট খালি থাকার পরও মিথ্যা বলে পাঠিয়ে দিলো। সত্যি দাদা সেদিন তোমাকে দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল।’

তিনি লেখেন, ‘তবু বেঁচে থাকার জন্য সারাদিন না খেয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌঁড়েছিলে। কিন্তু তোমার এই বেঁচে থাকা যুদ্ধের মূল্য রাষ্ট্রের কাছে তুচ্ছ। দাদা তুমি এই রাষ্ট্রে জন্ম নিয়ে খুবি ভূল করেছো, যে রাষ্ট্র উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে, সেই উন্নয়নের জোয়ারে তোমাকে চিকিৎসার অভাবে মরতে হলো। ভালো থেকো, যেখানেই যাও।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, আই.ই.আর সুমনের মৃত্যু নিয়ে তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘বিগত ১০-১২ দিন যাবৎ সে খাগড়াছড়িতে তার বাসায় ফুসফুসের সেই জটিলতা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলেও করোনার ভয়ে তাকে ভর্তি করানো হয়নি। এই চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় তিনি আজকে সকাল ৮:৩০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। সুমনের মত এমন উদ্যমী যোদ্ধাকে হারিয়ে আই.ই.আর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার শোকাহত।’